সংস্কার শেষেও জাতীয় স্টেডিয়াম কতটুকু প্রস্তুত? সৌন্দর্যের আড়ালে অনিয়ম আর অব্যবস্থানা
সংস্কার শেষেও জাতীয় স্টেডিয়াম কতটুকু প্রস্তুত? সৌন্দর্যের আড়ালে অনিয়ম আর অব্যবস্থানা
আবু তালহা
২৪ মে, ২০২৫
পাঁচ বছর ধরে চলেছে সংস্কারের কাজ। সময়ও লেগেছে, অর্থও খরচ হয়েছে বিপুল পরিমাণে। দীর্ঘ অপেক্ষার পর দেশের ফুটবলের আতুরঘর হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ জাতীয় স্টেডিয়াম এখন নতুন সাজে সেজে প্রস্তুত এএফসি এশিয়ান কাপ বাছাইয়ের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ আয়োজনে।
নতুন গ্যালারি, ঝকঝকে চেয়ার, অত্যাধুনিক ফ্লাড লাইট, জায়ান্ট স্ক্রিন, ছাদসহ চমৎকার এক অবকাঠামো। ঢাকার ব্যস্ত ইট-পাথরের শহরের বুকে মাথা উঁচু করে অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে স্টেডিয়ামের নবনির্মিত শেড। মাঠের সবুজ গালিচা যেন অপেক্ষার প্রহর গুনছে হামজা ও সমিতদের বরণ করে নেয়ার জন্য।
ছবিঃ সংস্কারের পর জাতীয় স্টেডিয়াম
আলোর নিচে অন্ধকার
কিন্তু এই উজ্জ্বল চিত্র শুধুই স্টেডিয়ামের দেয়ালের ভেতর পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। একবার বাইরে চোখ রাখলেই চিত্র পাল্টে যায় সম্পূর্ণ। একদিকে মাঠের আলো ঝলমলে সৌন্দর্য, আর অন্যদিকে বাইরের পরিবেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ময়লার স্তূপ—যা দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার জন্য যথেষ্ট।
স্টেডিয়ামের চারপাশ যেন পরিণত হয়েছে এক বিশাল ময়লার ভাগাড়ে। বিভিন্ন জায়গায় খোলা ড্রেন, নোংরা পানি আর মশা-মাছির উৎপাত। অথচ ক’দিন পরই এখানে অনুষ্ঠিত হবে আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচ।
সমর্থকদের প্রতিক্রিয়া: “এটা পরিস্কার করা উচিত। বিদেশ থেকে দর্শকরা আসলে তখন খারাপ একটা ইমপ্রেশন আসবে।”
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সচিবকে এই ব্যাপারে প্রশ্ন করতেই তিনি স্বীকার করেছেন, বিষয়টি সত্য। এবং নিশ্চিত করেন, আইন মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সিটি কর্পোরেশন থেকেও সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে।
সচিবের বক্তব্য: “এই ইস্যুটা সঠিক। এই ইস্যু থেকেই বুঝা যাচ্ছে, আমরা দেশটাকে সুন্দর ইমেজে দেখতে চাই।গত পরশু আমরা সচেতনতামূলক মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেছি। আমরা প্রত্যেককে সচেতন করেছি। এটা নিয়মিতভাবে অব্যাহত থাকবে। এরপর আইন মোতাবেক ব্যবস্থা নিবো। এছাড়া আমরা সিটি কর্পোরেশনের সহায়তাও চেয়েছি।”
প্রশ্ন থেকেই যায়: কেন বড় কোনো ইভেন্ট ঘিরে নাড়াচাড়া না হলে কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে না?
ভিতরের সৌন্দর্যের মধ্যেও ব্যবস্থাপনার অভাব
এদিকে মাঠ বাইরে থেকে দেখে সৌন্দর্য মন্ডিত মনে হলেও, সেই চাকচিক্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে একাধিক গলদ। কিছু অপরিকল্পিত ও অব্যবস্থাপনার জন্য ভাটা পড়ছে স্টেডিয়ামের এই সৌন্দর্য। ফুটবল ভক্তদের জন্য গ্যালারিতে নতুন চেয়ার বসানো হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেই আসনে পৌঁছানোর জন্য রাখা হয়নি করিডোর। রাখা হয়নি নির্দিষ্ট পথ। ফলে দর্শকদের চলাচলে তৈরি হচ্ছে বিভ্রান্তি ও ভোগান্তি।
মাঠের সবুজেও লুকিয়ে আছে সমস্যা
মাঠের মধ্যেও রয়েছে সমস্যা। দেখতে সবুজ হলেও ভেতরের বাস্তবতা ভিন্ন। এবড়োখেবড়ো জায়গা, কিছু অংশে বালি দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে, ফলে কোথাও নরম, কোথাও শক্ত। আর তাই, এই ধরনের মাঠে আন্তর্জাতিক মানের ম্যাচ আয়োজনেও উঠেছে প্রশ্ন।
মাঠ পরিদর্শন ও উদ্যোগ
বাফুফে ইতোমধ্যেই মাঠ পরিদর্শন করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পর্যবেক্ষণ জমা দিয়েছে। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সচিব জানিয়েছেন, “বাফুফের নিকট থেকে আমরা অবজারভেশন পেয়েছি। অবজারভেশনকে দুই ভাগে ভাগ করেছি। উন্নয়ন প্রকল্পের কনসাল্টিং ফার্মের সঙ্গে কথা বলেছি। দ্রুততার সঙ্গে মাঠের মান উন্নয়নের কাজ চলছে।”
বারবার বিলম্ব ও ব্যক্তিমালিকানার ছায়া
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন—পাঁচ বছর ধরে সংস্কার কাজ চলার পরও কেন স্টেডিয়াম এখনো পুরোপুরি প্রস্তুত নয়? কেন প্রতিবারই কাজ বিলম্বিত হয়? এই নিয়ে ক্রীড়া মহলে চর্চা অব্যাহত।
ফুটবলপাড়ার একাংশের দাবি, ব্যক্তিমালিকানাধীন একটি প্রতিষ্ঠানের অতিরিক্ত প্রভাব ও স্বার্থসংশ্লিষ্টতা সংস্কার কাজকে বিলম্বিত করেছে। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানটি বারবার কাজের গতি কমিয়ে নিজেদের ফায়দা লুটছে।
ইনফোগ্রাফিকঃ স্টেডিয়ামের সংস্কার কার্যক্রমের সময়কাল
অদক্ষতা ও স্বার্থপরতায় প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে জাতীয় ভাবমূর্তি
জাতীয় স্টেডিয়াম শুধু একটি খেলার মাঠ নয়—এটি দেশের ক্রীড়া সংস্কৃতির অন্যতম বড় প্রতীক। সেই জায়গায় যদি এমন অদক্ষতা, অব্যবস্থা ও স্বার্থান্বেষী দৃষ্টিভঙ্গি ছায়া ফেলে, তাহলে তা শুধু ক্রীড়াঙ্গন নয়, বরং গোটা জাতির সম্মানকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।
স্টেডিয়ামের দৃষ্টিনন্দন ভেতরটা যতটা গর্বের, বাইরের চিত্রটা ঠিক ততটাই বিব্রতকর। আন্তর্জাতিক আসরের আগে শুধু মাঠ নয়, পুরো পরিবেশকেই করতে হবে প্রস্তুত—অন্যথায় উজ্জ্বল আলোর নিচেই থেকে যাবে অন্ধকার।