'সৃষ্টিশীল ভালো অডিও রেকর্ডে প্রয়োজনীয়'

মামুনর রশীদ রাজু



মিডিয়া প্রোডাকশনগুলো নিজেদের সৃষ্টিকে ধ্বংস করছে যেভাবে তার একটা বড় কারণ ‘শব্দ’। সবচেয়ে দামী ভিডিও’কে একটা গরীব শব্দ যে ধ্বংস করে দিতে পারে, তা যেন তারা বুঝতে চাইছেন না। প্রচার এবং ভিডিও তৈরীতে তারা যেমন বাড়তি খেয়াল রাখেন, শব্দের ক্ষেত্রে ঠিক যেন তার বিপরীত চিত্র। এমনকি অনেক উন্নত মানের ও বিশেষ প্রয়োজনীয় ভিডিও আছে শুধুমাত্র শব্দের কারণে দর্শক তা দেখা থেকে বিরত থাকতেও বাধ্য হন এবং সেই সাথে আমরাও হেরে যায় মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যর্থতায়।

যদি আমরা আমাদের সৃষ্টিশীল কনটেন্ট এর মাধ্যমে মানুষের স্মৃতিতে জায়গা গড়তে চাই তবে মনে রাখতে হবে ভালো মানের শব্দের বিকল্প নাই, আর সর্বোত্তম মানের শব্দ সরবরাহে প্রথম প্রয়োজন ‘ক্লিয়ারেস্ট অডিও রেকর্ড করা’ এবং আরও ভালো অডিও রেকর্ড করতে সহায়ক এমন কিছু প্রয়োজনীয় পরামর্শ এখানে তুলে ধরছি।


১. মাইক্রোফোনের দূরত্ব নিয়ন্ত্রণ

একটি বক্তৃতা সম্পন্ন করতে ও গুরুত্ব বোঝাতে অনেকগুলো শব্দের ‘শব্দ জোর’কে ওঠা-নামা করানোর প্রয়োজন হয়। শব্দ জোর বাড়ালেই মাইক্রোফোন থেকে একটু দূরে এবং শব্দের জোর কমানোর সময় কাছাকাছি সরে আসা উচিৎ, প্রয়োজনীয় মান ঠিক রেখে।

এটি রেকর্ডিংয়ে সহায়তা করবে, যা পরবর্তীতে চুড়ান্ত অডিও ফাইলের জন্য প্রয়োজনীয় সংকোচনের পরিমাণকে হ্রাস করবে এবং শব্দের প্রকৃত রুপ ঠিক রাখতে সাহায্য করবে।


২. কিউ কার্ড ব্যবহার

শব্দের হোঁচট খাওয়ার মতো আর কিছুই নাই যা অডিওর প্রবাহকে ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারে। অনেকেই বিশ্বাস করেন যে স্ক্রিপ্ট এর উপর নির্ভরশীলতার থেকে স্মৃতি শক্তির উপর বিশ্বাস রেখে যারা পড়েন তাদের বক্তৃতা ভালো হয় এবং আরও স্বাভাবিক মনে হয়।

স্ক্রিপ্ট বক্তব্যের মাঝখানে ভুল করতে এবং আবার শুরু করতে সাহায্য করে। স্ক্রিপ ব্যবহার আর না ব্যবহার করার মাঝখানের দ্বন্দ মেটাতে কিউ কার্ড খুব উপকারি।

কিউ কার্ড বক্তৃতার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির প্রতি স্মৃতিকে সতেজ করে তোলে।


৩. ক্যামেরা জুম ফাংশন এড়িয়ে চলা

ক্যামেরায় দূরের বিভিন্ন বিষয়বস্তুকে দেখানোর জন্য জুম বৈশিষ্ট্যটি ব্যবহার করে থাকি, প্রায় দেখা যায় জুম করার সময় লেন্স যে শব্দটি করে অডিও রেকর্ডে তা স্পষ্ট শোনা যায়।

ক্যামেরায় যতটা সম্ভব জুম বৈশিষ্ট্যটি এড়িয়ে চলা শব্দ রেকর্ডের জন্য ভালো। জুম করার বিশেষ প্রয়োজনে কয়েক মুহুর্ত বিরতি নেয়া যেতে পারে, নইলে ধারণকৃত অডিওর গুরুত্বপূর্ণ অংশও বাতিল হয়ে যাবার সম্ভবনা থেকে যায়।


৪. পপিং এবং সিবিল্যান্স এড়িয়ে চলা

পপিং হ'ল বায়ুর অতিরিক্ত ধাক্কা যা P’s, B’s এবং বিশেষ করে মহাপ্রাণ ধ্বনি উচ্চারণে মুখ থেকে বের হয়। আর সিবিল্যান্স হলো হিজিং জাতীয় শব্দ যা Ss, Fs বা ছিছ, ফিছ উচ্চারণ করার সময় মুখ থেকে বের হয়।

পপিং এবং সিবিলেন্স উভয়ই রেকর্ডিংয়ে অতিরিক্ত স্পষ্টভাবে ছাপ ফেলে এবং অডিওকে নষ্ট করে। সুতরাং ঠিক কোথায় পপিং এবং সিবিল্যান্স সবচেয়ে কম, সে অবস্থান খুঁজে নিতে হবে- মাইক্রোফোন ও মুখের মাঝের কোণ এবং দুরত্ব বুঝে।

যা খুঁজে পেতে বিরক্তিকর কিছু সময় ব্যয় হয় ঠিকই, কিন্তু প্রয়োজন এবং একবার খুঁজে পাওয়ার পর স্থায়িভাবে কাজ করা যায়।


৫. শ্বাস নিয়ন্ত্রণ

শ্বাস প্রশ্বাস আরেকটি প্রধান কারণ যা পরিষ্কার রেকর্ডিংকে ব্যাহত করতে পারে। এ কারণেই অডিও রেকর্ড করার জন্য শ্বাস প্রশ্বাসের ব্যবহারটা জেনে রাখাও গুরুত্বপূর্ণ। রেকর্ডিংয়ে শ্বাসের সমস্যা এড়াতে- প্রতিবার শ্বাস নেওয়ার সময় মাইক্রোফোন থেকে বাহিরে মাথা সরিয়ে ফেলার অভ্যাস গড়ে নেওয়া উচিৎ।


৬. একটি নিয়মিত রুটিন অনুসরণ

আজকাল, বেশিরভাগ ভিডিওগুলি স্টুডিও’র বাইরে রেকর্ড করা হয়। অনেক পেশাদারেরা তাদের অডিও নিজের বাড়িতে রেকর্ড করতে পছন্দ করেন। যদিও এটি অবশ্যই ব্যয় হ্রাস করে, তবে এ কারণে কিছু অসুবিধাও হতে পারে।

বাড়িটি কোনও পেশাদার স্থান নয় এবং অসংখ্য ছোট ছোট ঝামেলা যুক্ত যা একটি মান সম্পন্ন রেকর্ডিং সেশনের জন্য উপযুক্ত নয়।

এই অনিশ্চয়তার যুদ্ধ থেকে মুক্তি পেতে, পছন্দ মতো একটি রেকর্ডিং স্টুডিও খুঁজে নেওয়া উচিৎ; ধারাবাহিক রুটিন মাফিক কাজ করার জন্য। নিজস্ব রেকর্ডিংয়ের পদ্ধতি উন্নত করে কাজ করার জন্য একটি নির্দিষ্ট ঘরে সরঞ্জামগুলি একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে সেটআপ এবং একটি নির্দিষ্ট রুটিন অনুসরণ করা প্রয়োজন।

এইভাবে, যখন বিশেষ ভুলগুলি ঠিক করতে অডিওর একটি অংশ একাধিকবার রেকর্ড করতে হয়, তখন সাউন্ড ব্যাকড্রপটি ধারাবাহিক ভাবে একই রকম থাকবে এবং অডিওর গুণমান নিয়ে বাড়তি চিন্তায় পড়তে হবে না ।


৭. বাহ্যিক মাইক্রোফোন ব্যবহার

ক্যামেরা এবং স্মার্টফোনগুলির মধ্যে যে মাইক্রোফোনগুলি ইন্সটল করা থাকে তা একক ব্যক্তির সাথে ভিডিও চ্যাটের জন্য যথেষ্ট উপযুক্ত। তবে বিস্তৃত দর্শক শ্রোতাদের জন্য রেকর্ড করা এই অডিওগুলি সাধারণত যথেষ্ট ভালো নয়।

শব্দের পেশাদার মান অর্জনে অবশ্যই একটি বাহ্যিক মাইক্রোফোনে বিনিয়োগ করা প্রয়োজন। বাজারে বিভিন্ন ধরণের রেকর্ডিং সেশন বিবেচনায় অনেক ধরণের মাইক্রোফোন রয়েছে।

নির্দৃষ্ট কাজের জন্য কোন ধরণের মাইক্রোফোন সবচেয়ে উপযুক্ত হবে তা খুঁজে পেতে হবে এবং সময় নিয়ে। মাইক্রোফোন কেনার সময় কি কাজে ব্যবহার করা হবে তার শর্তগুলো মিলিয়ে নেবার কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে ।


৮. পরিবেষ্টনের শব্দ দূষণ এড়ানো

চারিদিকের গোলমালে শব্দগুলি বিভ্রান্তির একটি ধ্রুব উৎস। আবার পুরোপুরি সাউন্ডপ্রুফ এমন জায়গা খুঁজে পাওয়া বেশ অসম্ভব। তবুও, রেকর্ডিং অবস্থান থেকে পরিবেষ্টিত শব্দ কমিয়ে আনার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করা উচিত। এটি করার কয়েকটি উপায় হলো:

  • · পাখা, ওয়াশিং মেশিন এবং অন্যান্য ডিভাইসগুলি বন্ধ করতে হবে যা পটভূমির শব্দে অবদান রাখে।

  • · কম্পিউটার চলাকালীন সিপিইউ ফ্যান থেকে রেকর্ডারটি দূরে রাখতে হবে।

  • · রেকর্ডিংয়ের সময় চারপাশে বাড়তি মানুষ না থাকাই ভালো, থাকলে তাদের কণ্ঠস্বরটি কম রাখার অনুরোধ করতে হবে।

  • · প্রতিবেশীদের কারণে তৈরী হওয়া শব্দকে আড়াল করতে মেঝেটি কার্পেট দিয়ে মুড়ে নিতে হবে।

  • · দেয়ালগুলি বা যেদিক দিয়ে বাইরের শব্দ আসছে সে জায়গাগুলি কাপড় দিয়ে মুড়ে দেওয়া এবং তোয়ালে, বই, লিনেন ইত্যাদির মতো জিনিসগুলিও প্রাকৃতিক ইনসুলেটর হিসাবে ভালো কাজ করে।


৯. ভালো শব্দের নির্বাচন ও ব্যবহার

শ্রোতা কত সহজে বুঝতে পারে তা স্থির করে বক্তার শব্দ নির্বাচন করা জরুরী। যেহেতু আধুনিক ভিডিও বিশ্বব্যাপী শ্রোতাদের পরিবেশন করে, তাই নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন যে মানবতার বৃহত্তর প্রশস্ত স্তরের কথা মনে রেখেছি কিনা। মনে রাখার জন্য কয়েকটি উপায়:

  • · স্পষ্টভাবে এবং তাড়াহুড়া না করে কথা বলা।

  • · দীর্ঘ শব্দগুলি সাবধানে এবং তোতলানো বা নিন্দা করাকেও এড়ানো।

  • · যদি বক্তার স্থানীয় উচ্চারণে অভ্যস্ততা থাকে তবে তাদের বক্তৃতা স্পষ্টভাবে উচ্চারণের উপর আরও বেশি চাপ সহ রেকর্ড করা উচিত।

  • · কথাসাহিত্যে অতিরিক্ত সময় ব্যবহার করা।

  • · কৌতুকপূর্ণ অংশগুলো জোরে জোরে পড়া এবং যে নির্দিষ্ট শব্দ বা বাক্যগুলির দ্বারা সমস্যার মুখোমুখি হই সেগুলির একটি মানসিক নোট তৈরী করা।

  • · জিহ্বা টুইস্টার বা র‌্যাপ গানের অনুশীলন মুখের জটিল শব্দ উচ্চারণে আরও আরামদায়ক করে তোলে।

  • · বক্তৃতায় একটি প্রাকৃতিক, অহমহীন স্বরপ্রবাহ বিকাশের জন্য শ্বাস এবং ধ্যানের কৌশল অনুশীলন করা।

  • · দাঁড়ানো বা বসে থাকার সময় সোজা হয়ে কথা বলা কণ্ঠকে আরও বেশি শক্তি এবং স্পষ্টতা যোগায়।

  • · রেকর্ডিং সেশনের সময় জিহ্বা বা মুখ শুকিয়ে যাওয়া এড়াতে নিয়মিত সাধারণ পানি সঙ্গে রাখা ও চুমুক দিয়ে মুখে ভেজা ভাব ধরে রাখা, বড় স্ক্রিপ্টের ক্ষেত্রে জরুরী।


১০. সহজ বহনযোগ্য সাউন্ড বুথে বিনিয়োগ করা

হোম-রেকর্ড করার উপর তৈরী ভিডিও দেখে অডিও রেকর্ড করার ‘বহনযোগ্য সাউন্ড বুথ’ তৈরি করা বুঝে নেওয়া, যা বারবার রেকর্ডিং স্টুডিও ভাড়া নেওয়ার চেয়ে বিনিয়োগে সস্তা। যার বেশ কয়েকটি সহায়ক বৈশিষ্ট্য রয়েছে:

  • · উচ্চ শব্দ শোষণ করে এমন ফোম দিয়ে বুথটি ঘেরা থাকে, যা অপ্রয়োজনীয় শব্দগুলিকে মাইক্রোফোনের কাছে পৌঁছানো থেকে বিরত রাখে।

  • · রেকর্ডিং স্পট পরিবর্তনে ডিভাইসটি সহ এক স্থান থেকে অন্য জায়গায় চলে যাওয়া সহজ সুযোগ থাকে।

  • · একটি ‘রিয়ার প্যানেল’ থাকে যা পরিষ্কার ইনস্টলেশনের জন্য পিছন দিকে তারগুলিকে সাজাতে সাহায্য করে এবং জায়গা অবরুদ্ধ না করে বুথের ভিতরে বেশিরভাগ ধরণের মাইক্রোফোন সেট করার জন্য প্রচুর জায়গা খোলা রাখে।

আরও ভালো অডিও রেকর্ডিংয়ে প্রয়োজনীয়

মানসম্পন্ন সাউন্ড রেকর্ড তৈরি করতে বেশ কয়েকটি সংমিশ্রিত বিষয়ের দিকে খেয়াল রাখার প্রয়োজন হয়। প্রাথমিকভাবে, মান ঠিক রেখেই রেকর্ডিং সরঞ্জামগুলিতে বিনিয়োগ করতে হবে এবং একটি মানসম্মত রেকর্ডিংয়ের জায়গা বেছে নিতে হবে। তবে এর বাইরেও করা যেতে পারে এমন সাধারণ উপায় রয়েছে, উপরে সে বিষয়ে বেশ আলোচনা করাও হয়েছে।



(০১ জানুয়ারি ২০১৯)

..............................

লেখক পরিচিতি

মামুনর রশীদ রাজু। জন্ম. ১৯৭৬, বৃহত্তর যশোর। সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার, চ্যানেল আই ও ইমপ্রেস টেলিফিল্ম লিমিটেড। ব্যান্ড: ‘প্রায়শূন্য’ (fb.com/pryshunnoband)