নির্মিত কাব্যকাহিনিটি পুরোপুরি অনৈতিহাসিক নয় কিন্তু ঈষৎ অপ্রাকৃত। সূর্যাস্তকাল। হীনগৌরবা, হৃতশক্তি, অসহায় নূরজাহান আসন্ন গোধূলিতে যমুনা তীরে একাকী পদচারণা করছেন, চারিদিকে সতর্ক গোপন পাহারা। এর কিছুদিন পর তিনি লাহোরে নির্বাসিতা হবেন। স্বপ্নের মতো স্মৃতি জীবন্ত হয়ে উঠতে থাকে। মৃত জাহাঙ্গীর যেন সশরীরে আসেন, তাঁর সঙ্গে বাক্যালাপ করেন, মৃত শের খাঁ-ও আসেন। বাক্যালাপে অন্তরলোক উন্মোচিত হয়। আলো পড়ে নতুন কৌণিকে, বিকীর্ণ হয় নবতর আভা। নতুন সময়ও এই আরশিতে নিজের মুখ দেখে নেয়।
এইতো দাঁড়িয়ে আছি
অস্তমিত সূর্যের বিভা চোখে এসে লাগে
ধুয়ে দেয় বাস্তবের ধুলো, সমস্ত ম্লানিমা
উচ্ছ্বসিত যমুনা, তরঙ্গের তুঙ্গে তুঙ্গে
রঙের মায়াবি খেলা, কলুষ মুক্ত এ যেন
স্বর্গের মায়া...
এ যেন আমি —
নিদাঘের খরসংঘাত পেরিয়ে আসা
জীবনপ্রান্তে অস্তগামী অন্তজ্যোতি
সূর্য নয়
আমি নূরজাহান — অস্তাচলগামী
ভারতের অবিস্মরণীয় পর্বনারী।
নির্মম কাল, মুদ্রিত রাখ
মরমের অন্তহীন তন্ত্রীকথা
কি আশ্চর্য!...
হীনগৌরবা, শক্তিহীনা ব্যাঘ্রিনী
তবু খুবসুরতির কী কারুকাজ!
মহাবৎ খাঁ, চিরশত্রু সে-ও
দিলো না কঠোর বিধান;
খুরম! সে-ও বৃত্তি দিয়ে
বাঁচিয়ে রাখে চিরঞ্জয়ীরূপবৃক্ষ।
বিস্ময়, বিস্ময়ের অপার এই
ঝঞ্ঝাবাতাহত অম্রিয়লাবণ্যতনুলতা ।
শহিয়ার, শুধু তুই অন্ধ নোস্ —
চোখ মেলে দ্যাখ (অন্ধরাও তো দ্যাখে!)
শুধু তুই নয়, আসমুদ্রহিমাচল অন্ধ
হ’য়ে আছে নূরলাবণ্যমায়ায়।
অন্ধ ভবিষ্যৎ তুই অন্তর মেলে দ্যাখ —
পারস্য থেকে ছুটে আসা শীর্ণ এক
রূপের বিজলি কীভাবে বিদীর্ণ করে
শষ্পশ্যামলা এই ভূমি, দ্যাখ —
সারে হিন্দুস্থানের প্রাণবাহী
দরিয়া কীভাবে ভ’রে রক্তের উৎসবে
অরণ্য জুড়ে দাউ দাউ লেলিহান দাবানল
রূপের হুতাশনে। বাংলার পাললিক মাটি
পুড়ে যায় দর্পপদপাতে, প্রেমহীন
সুচক্রী বহ্নির প্রকোপে
শাহিয়ার চোখ না খুলেও দ্যাখ —
রূপের গরল এই মিশে যাচ্ছে কণায় কণায়
কোষে কোষে রক্তে রক্তে অনন্ত ধারায়
ভাবী ভারত একদিন পুড়ে যাবে
অলীক রূপজমায়ায়
সূর্য অস্তে গেল, অন্ধকার...
ইস্পাতের মতো যমুনার জল
বহমান, জীবনের মতো চলিষ্ণু
নিরন্ত গতিশীল, জটিল ঘূর্ণি ওঠে
অনন্ত অন্তরে, চোরাস্রোত...
যমুনা,
এই দ্যাখো করতল!
যে মুষ্ঠিতে সাম্রাজ্যের জীয়নকাঠি
ধরেছিল রাজদণ্ড, সামান্য হেলনে
যার ধ্বংস হয়ে যেত জনপদ শস্যক্ষেত্র
যার বরাভয়ে কৃপাধন্য হাজার এতিম
দ্যাখো...
সেই তালুতে সহস্র যমুনা
অজস্র রেখায়, কত কাটাকুটি
বিস্মিত জিজ্ঞাসাচিহ্ন, উত্থান-পতন।
আমার জীবন যেন শত
সমুদ্রের কলধ্বনি উথাল-পাথাল...
তুমিতো সামান্যা নদী
আমি নূরজাহান,
জগতের আলো —
জাহাঙ্গীর-এর প্রবেশ,
অনেখানি আধার তাঁর অবয়বে
জাহাঙ্গীর।। সন্ধ্যা হয়ে এলো
প্রাসাদে ফিরে যাও নূর –
অনাবিল কিছু নেই আর
অনচ্ছ সব এই গোধূলির মতো
একাকীত্ব, নিজের সাথে আলাপ
অসম্ভব, অকল্পনীয়
চারিভিতে সহস্র সচেতন
মুক্ত মাঠ, নদী তীর
সবখানে অসুস্থ হাওয়ার
চক্রান্তের রাজ্যপাট এখন
নূর।। কে ?
বাদশাহ!
আসুন –
এখনই তো আসার কথা...
হাতে হাত, সান্ধ্যভ্রমণ...
বিস্মিত করুণ চোখের আর্তি আর
অন্তর রক্তিম করা কটাক্ষ
জীবন্ত হয়ে আছে যেন
ম্রিয়মাণ দিগন্তে ওই –
আসুন...
স্পর্শ দিন...
জাহাঙ্গীর।। এখনও মায়া! একি অন্তহীন!
নিজেকে এখনও বোঝোনি ?...
নূর।। শাহানশা,
নারীর নয়ন হতে মায়ার অঞ্জন যেদিন
মুছে যাবে
সেই ক্ষণে সে মৃত
সিংহাসনচ্যুত...
জাহাঙ্গীর।। তুমি কি এখনও স-প্রাণ
এখনও কি প্রাণপ্রিয়
পৃথিবীর বায়ু-জল, ফুল-ফল
প্রসাধন?
নূর।। বাঁচার কী বোঝেন আপনি...
এই যে অঙ্গুলি এখনও
চম্পক কলির মতন
হিল্লোলিত ভ্রূ-পল্লব
কী রেশমি এই ত্বক !...
গোলাপলাঞ্ছিত বিম্ব-অধর
কম্বুকণ্ঠে অভিজাত ঢেউ
আওয়াজে লজ্জানত যমুনার
কলতান...
কাশ্মীরি ঘাঘরা,
সজাগ নকরানি যেন,
কুজনের বদ্দৃষ্টি থেকে
মনিবানিকে আড়লে রাখে,
কী সযত্নে ঢেকেছে দেখুন
নবনীতা পায়ের পেলব...
এখনওতো আমি সেই নূর
আমি বেঁচে আছি
বেঁচে আছি নবাবজান,
বহাল তবিয়াৎ-এ
জাহাঙ্গীর।। এখনও কী প্রেমহীন তোমার হৃদয়?
ভেবে দ্যাখো, কত মৃত্যু কত হীন
হানাহানি, শোণিতউৎসব – তবু
প্রলয়ঝঞ্ঝার শেষে বিবিক্ত
প্রশান্ত চিত্ত সৌন্দর্য তোমার
প্রেম হয়ে জ্বলেনি চেরাগে
কোনও সমাহিত সন্ধ্যায় – স্নিগ্ধ,
অথবা মরূদ্যান, সাহারা পেরিয়ে আসা
ক্লান্ত পথিকের প্রাণে
তৃপ্তির মতো।
নূর।। জীবন মানে কী শুধু
ঘর বেঁধে থাকা, জীবন
মানে কী শুধু তৃপ্তির বদ্ধ জলাশয়
শুধু শান্তি, শুধু কপোত-কপোতীর
বিশ্রম্ভালাপ, দিনশেষে ঘরে ফিরে
মুখোমুখি বসা ...শুধু
সেবা, শুশ্রূষা, আর খুঁটে
খাওয়া দিনান্তের সুখী খাদ্যকণা
নির্বিবাদ ঊর্মিহীন শেওলাশীতল
বাহুলতার প্রাচীর বেষ্টনী...
জীবন মানে কী শুধু
গোলাবের পাপড়ি ছেঁড়া
বাদশাহী হর্ষউল্লাস,
সরাব, আতর খুশবু
আর দেহে দেহে ভ্রমরবিলাস
শিশ্নোদরপরায়ণতা শুধু!
কেন বিস্মৃত হন, পারস্যের বেদুইন
ধুলো লেগে আছে এই কিসমতে
জন্মক্ষণে ঝঞ্ঝাবার্তা লিখে রেখে গেছে
একই সাথে গোলাপ বাগিচা আর
উদ্দাম অশ্বখুরধ্বনি
রক্তের গহীনে...
জাহাঙ্গীর।। নূর...
নূর।। হ্যাঁ, নূরজাহান আমি...
জগতের আলো।
নূরমহল আমি
আপনার আদরের...
যে দীপ্তিতে পুড়ে গেছে
সাম্রাজ্যের সীমা, হৃদয়ের দু’কূল
ধ্বসে গেছে দারুণ আঘাতে
তবু ভোলো না...
ভুলতে পার না আমায়, বিস্ময়
অপার বিস্ময় আমি –
মনে পড়ে !
দীর্ঘ প্রতীক্ষার শেষে
প্রথম সাক্ষাত সেই –
কী আমার প্রার্থনা ছিল ?
জাহাঙ্গীর।। মনে আছে...
নূর।। হৃদয়ের সাম্রাজ্য নয়
হাতের সাম্রাজ্যদণ্ড ছিল প্রার্থিত।
দু’দণ্ড অপলক ...
কী বিস্ময় আপনার – ও!
সে-দিন কী বিস্ময় আপনার !
জানি, সে-দিন থেকে
ঘৃণার পাত্রী আমি
জাহাঙ্গীর, ভারতের বাদশাহ
করুণায় ছুড়ে দিলে সাম্রাজ্যের
চাবিকাঠি, অপ্রেমের পায়ে
কেন? কেন?
পরাজয় না-কি আত্মগ্লানি
না-কি অভিমান ... স্বপ্নভঙ্গ
পৌরুষের পরাজয়!
হতাশার শাস্তি নিলেন নিজে
রাজ্য; সে কী এতই অর্থহীন
প্রেম না পেলে!
জাহাঙ্গীর।। ভালোবাসা চিরদিন প্রতিদানে
ভালোবাসা চায়।
মহব্বতধন্য পৃথিবীপতি দ্বিধাহীন
কামানের মুখে বুক পেতে
নস্যাৎ করে বেবাক বিরাসত।
অর্থ যশ সম্মান সম্পদ কী হবে
কী হবে বলো?
পুরুষের কাছে সাম্রাজ্য
সে-ও এক নিদারুণ শিল্প কলাকাজ
প্রেয়সীর মতো তাকেও সাজাতে
হয় প্রেম দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে।
তুমি কী বোঝোনি নিজে, কৃষিকাজ
কারুকাজ যথার্থ না হলে
কণ্টকে ভ’রে যায় সমস্ত
উঠোন, আর মাশুকার অন্তর যদি
প্রেমহীন হয়...
সে বড়ো যন্ত্রণা।
সমস্ত দিনের শেষে ক্লান্ত
শ্রান্ত চিত্তের যদি
না মেলে আশ্রয় কোনও প্রশান্ত
অন্তরে... পণ্ড মনে হয়
মনে হয় সব কিছু মৃত...
রাজত্ব, রাজধানী, রাজমুকুট
বৈভব জৌলুস...স - ব...
নূর।। তবে কী মরেছেন সেই দিন
জাহাপন! সেই ক্ষণে...
জাহাঙ্গীর।। জানি, বোঝোনি
লুব্ধতার উর্ণজালে আবৃত আগুন
বোঝোনি, দ্যাখোনি আমার
মৃতদেহ ভাসে লিপ্সাকুটিল কালো
কালযমুনার জলে।
নূর।। তাহলে যে প্রশ্রয় পেয়েছি
সবই কী অভিনয় ?
প্রাণহীন মুখোশের চুম্বন...
জাহাঙ্গীর।। জানি; বোঝোনি
তুমি জগতের আলো –
পারস্যের ঘূর্ণিবাতাহত সুগন্ধি
গোলাপ, নারী সূর্যমণি
মনে করে দ্যখো, সে-দিনের পর
সুরাপাত্র হাতে না নিয়ে
সংলাপ করেছি কবে?
কোন্দিন ঐ বিলোল আঁখিতে
রেখেছি নজর সুরার তাণ্ডবে
না হয়ে মশগুল?
মনে করো কোন্দিন স্থির
পায়ে স্ফীতবক্ষে গিয়েছি হারেমে
সুগন্ধি মহলে বা বিনোদ উদ্যানে।
মনে করো, মৃত্যুর সীমায়ও চেয়েছি
ভালোবাসো –
স্বার্থহীন, সম্পদসম্মানহীন কৃষাণীর
মতো, যা শুধু একান্ত আমার...
নূর।। আঃ...
ভালোবাসা, প্রেম, আশনাই
রাজকীয় রোগ
উনিশ রমণীতেও ভালোবাসার
ভাটা...
জাহাঙ্গীর।। সহস্র ঝিনু্ক খুঁজে মুক্তো
ক’টি মেলে?
অরণি ও অগ্নিতে কতটা তফাৎ
নিছক মৈথুনে মনের তৃষ্ণা মেটে ?
তুমিই পারতে নূর
রাজনীতিজর্জর জীর্ণ
চিরপ্রেমতৃষিত বীরানা কলিজায়
ভালোবাসার আতর ভ’রে দিতে...
নূর।। সেই ভালোবাসা !! ...
এ-কি বাগিচার গোলাব
ইচ্ছা হলে তুলে এনে দেবো?
সমস্ত অন্তরউদ্যান তন্ন-তন্ন করে
ফিরেছি সন্ধানে...
ফোটেনি, কুঁড়িও আসেনি...
আমিও কী প্রেম চাইনি?
তুমিইতো আগুন চেনানো
শাহজাদা আমার...
মানুষ কী এত নিষ্ঠুর হতে পারে
প্রেমহীন জীবন কার যাচনীয়!
জানি, অবিশ্বাস্য মনে হবে।
প্রশ্নে জাগি বিনিদ্র রজনী –
প্রেম কী তবে রূপের সতীন!
জাহাঙ্গীরের অবয়ব ধীরে মিলিয়ে যেতে থাকে অন্য পাশে স্পষ্টতর হয়ে উঠতে থাকে
আধো-আলোকিত শের খাঁ
শের খাঁ, তাহলে সে-ও কেনো
পেলো না আমায়, আমার হৃদয়
যে আমাকে প্রাণের থেকেও
মূল্য বেশি দেয়...
হাঃ
আমি তবে কী?
আমি তবে কী!
শের খাঁ।। আমার স্বপ্নসীমাহীন
মেহের...
নূর।। আপনি!
শের খাঁ।। আমি... আলি কুলি
তোমারই মতন এক
মরুভূ ঝটিকা
মরীচিকা সন্ধানী ...
নূর।। লজ্জায় সম্মুখে দাঁড়াতে
না পেরে চলে গেল
ভূতপূর্ব ভারতেশ্বর
নুরুদ্দিন মহম্মদ সেলিম, জাহাঙ্গীর
গুপ্তঘাতক...
কেন এলেন আপনি
আপনিওতো মৃত...
শের খাঁ।। প্রেম কখনো মরে না মেহের
অনন্ত প্রতীক্ষায় থাকে,
আগামীর দিকে চেয়ে থাকে
আজন্ম, জন্মান্তর পেরিয়ে যায়
অরোধ্য গতি...
নূর।। ঘৃণা কেন করো না আমায়?
শের খাঁ।। ঘৃণা করি যদি, মৃত্যুর পরও
যে মৃত্যু আছে তাই যেন
সমুদ্যত নেমে আসে...
দোজখে হয় অনন্ত কয়েদ।
অভিমান করি পর্বতপ্রমাণ
সান্ত্বনা খুঁজি...
ব্যর্থতায় ভালোবাসা পূর্ণতা পায়...
নূর।। দয়া করে তুলে রাখুন এইসব
শব্দ-বাক্যবন্ধাবলী, প্রেম
ভালোবাসা ভুলে যান –
মাতা যার জন্মলগ্নে নির্মম
ফেলে যায় তরুচ্ছায়াতলে
একাকী, তার কাছে প্রেমতো
তৃষ্ণার জল...
... তবু আমি ভাবি
আমার এ তুরঙ্গগতি
কেন তবে, কিসের সন্ধান?
কোন প্রাণনায় উত্তেজিত নারী
শিশু কোলে নিয়ে যুদ্ধে যায়
নিষ্কোষিত তরবারি সম্মুখে
আরও তীক্ষ্ণতর খরদৃষ্টি
বাজি রাখে জীবনের দান!
আত্মীয় যার, ভাই যার বিরুদ্ধে
দাঁড়ায়, অকাল বৈধব্য নামে
সন্তানের যৌবনে। কেন এই
আত্মখননের উল্লাস, ক্ষমতার
অলিন্দে উদ্দাম ছুটে চলা
রণ থেকে রণে
প্রেম দিয়ে, মদহোশি দিয়ে
কল্পনার মহক উড়িয়ে
এর কতটুকু বোঝা যায়?
শের খাঁ।। আমার জীবনও নয় কুসুমাস্তীর্ণ
আমি শের খাঁ...
তুমি তো দেখেছ মেহের
বুকজোড়া তীব্র নখরাঘাত
বাহুতে শ্বাপদের হিংসাচিহ্ন
আমাদের দুজনেরই ললাটজোড়া
মরুভূমি, যাযাবর বালির তিলক
জীবন আমার কাছে শুধু মোহময় নয়
বসন্তবাহার বা গুলাল আশনাই...
নূর।। তোমার প্রশস্ত বুকে তাই
মাথা রেখে, দৃপ্ত পরুষস্কন্ধে
নির্ভয়ে অস্তিস্ত্ব দিয়ে, প্রবল
বাহুর বাঁধনে সঁপে, সন্ধান
করেছি ভূমি, উর্বরা জমি
গোলাপ বাগিচার স্বপ্নে মশ্গুল...
শের খাঁ।। !!
বলো, বলো
জীবনের অব্যক্ত গহীনকথা
শুনে রাখি জীবনের পার হতে...
নূর।। ...পারিনি
পারিনি আমি, ব্যর্থ –
বিফলে গেছে প্রচেষ্টার সব
শের খাঁ।। মেহের!
নূর।। কোথা থেকে অপরূপ আলিঙ্গন
রঙিন মেহফিল ফিরে ফিরে আসে...
জীবনে প্রথম, যৌবনপ্রত্যুষের সেই
শ্বাসরোধী উদ্দাম চুম্বন।
প্রকাশ্যে ভাবী শাহেনশাহ
এই ওষ্ঠ-অধরে রেখেছে যে
মোহময় মদিরা পেয়ালা
যেন এক অমৃত-গরল
সে আমাকে ছাড়েনি কখনো
শের খাঁ।। মেহের!
নূর।। গোপন কোটরে আমারই
আজান্তে আমি ভাবনা বুনেছি
... প্রাদেশিক কুটীর নয়
সীমিত সম্পদ নয়...
অধনস্তের অবোধ প্রেম
দৃপ্ত পৌরুষ নয় শুধু...
শের খাঁ।। মেহের!
নূর।। ...আমার প্রকৃত মঞ্চ
ঐশ্বর্যের মহল, হীরার চমকে
মঞ্জুলিত হবে যেথা হৃদয়ের দ্যুতি
সহস্র কিরণে, রেশমি আবেগে
ভ’রে দেব প্রাণের পেয়ালা
সম্রাজ্ঞীর হাত থেকে
ভারতের বাদশাহ ভ’রে নিয়ে
অন্তরের সুধা দেশে দেশে
বেটে দেবে রাজবৈভব
অতুল মহিমা
একই সাথে একচ্ছত্র সম্রাজ্ঞী
হব হৃদয়ের, – সাম্রাজ্যের।
লেখা হবে নতুন লায়লাগীতি
যাকে ফেলে যাও পথের ধুলায়,
বিস্ফারিত করে দ্যাখো তার রবরবা
শক্তিমত্তা, সুদূরপরাহত পরাক্রম ...
তাও পারিনি আমি
নিজেকে নিজের কাছে
আচেনা অস্পষ্ট লাগে
তোমরা ভাবো নারী বড়ো
কুহকী, কচাল, দুরারোহ
দ্বন্দ্বময়, জানে না কী চায়
আজ মনে হয়, সব কিছু
আমাদের হাতে নেই
নারী বড়ো অসহায়...
শের।। এভাবে বিমর্ষ হওয়া
খুব বেমানান তোমার...
নূর।। এতই বেমানান যদি
আমার মৃত্যুদণ্ড হোক।
এতই বেমানান যদি
নারী কেন অনায়াসে
দ্যূতক্রীড়া, যুদ্ধ, কূটনীতি
রাজনীতি সবখানে কেন্দ্রে
চলে আসে...
যে নারী যুদ্ধ করে
যে নারী রাজ্য চালায়
যে নারী শিল্পশিক্ষাবতী
সুচক্রী, ক্ষমতাপ্রিয়, উচ্চাশী
উদ্যমী – সে কেন বিচার-ঊর্ধ্বে!
নয় সাধারণ বা পুরুষের মতো?
নিজের কবর খুঁড়েছে সদর্পে
তবু তাকে ছুঁতে পৃথিবীর
হাত কাঁপে...
পৌরুষের দোহাই লাগে...
প্রেম ছলে ধর্ষণে পেষণে
মনুষ্যত্বে লাগে না ?
দেখুন, আলি কুলি আসতাজলুর
রূপের কী মহিমা – কী আগুন!
শের খাঁ।। যে আগুনে প্রেমও পোড়ে
অনির্বাণ...
(স্বগত) কে জানে
আমার চেয়ে বেশি ?...
নূর।। ... দেখুন, অন্ধ ভবিষ্যৎ গায়
নূরের রোশনাই, পারস্যের বুলবুল
দিলরুবা রবাবের গান
আর যমুনার তীরে তীরে
শস্যক্ষেতে, প্রাকশ্যে -নিরালায়
পুড়ে যায় শ্বাপদের প্রেমে খাওয়া
রূপের শরীর...
শের খাঁ।। এত দূরদৃষ্টি তোমার –
আর কী কী দ্যাখো নূর?
নূর।। ... রূপের কবর খোঁড়া ক্ষমতার পাশে।
শের খাঁ-র হৃদয়ের কোমল ঘাসে
নূর নেই, প্রেম নেই ভবিষ্যতে।
মেহেরের কাছে, নূরের আচেনা
আজনবি এক নূরের পাশে শুয়ে আছে
শত্রু সহোদর... শুয়ে আছে
সরফুন্নেসার প্রেমিক ...তবু তুমি নেই
যতদূরে চাই...
শের খাঁ।। দেখতে পাও না, হয়তোবা
এ তোমার আত্মপ্রবঞ্চনা...
আমার আরেক মেহের ( * লাডলি বেগম)
আমাদের দ্বৈত স্বপ্নে গড়া,
যে তোমাকে আমৃত্যু ঘিরে আছে,
যার নীরব শোক, গোপন অশ্রু
তোমার হৃদয়ের শেল,
তোমারই ক্ষমতার আরিশে যার
সব পুড়ে যায়,তবু সে-ই
তোমার শেষের আশ্রয়।
সেখানে কী আমি নেই
তার চোখ দিয়ে কে দ্যাখে তোমায়?
শোকতাপতৃষ্ণানিদাঘে
প্রেম ঘিরে থাকে গোপনে-প্রকটে
তারে দ্যাখো বা না দ্যাখো
সবথেকে শেষ সত্য প্রেমের জাতক
তাকে তুমি ছাড়ো বা না ছাড়ো
সে কখনো ভোলে না তোমাকে
আমি কী সেখানে নেই!
তার বিগলিত অশ্রু
তার দীর্ঘশ্বাস, অব্যক্ত বেদনা
নিরন্তর শুশ্রূষাসেবা
তোমাকে বিদ্ধ করে
সে তো তার ক্ষমা, তোমার
ক্ষমতালিপ্সার দিকে অপার করুণা...
সেখানে কী আমি নেই!
ভুলো-না মেহের
যেখানে পড়েছে ভালোবাসার
ভগ্নাংশ কণা, সে-মাটিও
কখনো বিফলে যাবে না।
নূর।। আপনারা কেন আসেন
ফিরে ফিরে জীবনে আমার!
প্রণয়ের ধ্বজাধারী
করুণা সহানুভূতির অজুহাতে
শস্ত্রপাণি, রক্ত পিপাসুর মতো...
শের খাঁ।। জীবনের স্মৃতির উঠোন জোড়া
মৃতদের সাম্রাজ্যপাট,
আর কোথা যাবো?
উৎখনন ছাড়া ইতিহাস মূক...
নূর।। বাক্যহীনতা তবুও শ্রেয়
এই ক্ষমা, করুণা, সহানুভূতির চেয়ে...
শের খাঁ।। ইতিহাস চিরকাল বাচনে উন্মুখ
চুপিসারে ইঙ্গিতে প্রকটে...
নূর।। আপনি চির প্রেমিকের যশ নিয়ে
ইতিহাস হবেন, জাহাঙ্গীর তিনি-ও
ব্যর্থতার গ্লানিতে লিখে যাবেন
পরাজয় খাতা। আমি কোন্
পরিচয় তুলে দেবো আগামীর হাতে
প্রেম নিয়ে প্রত্যাখ্যান নিয়ে
যে যাহার পথে চলে যাবে
সকলের প্রেম আছে, প্রত্যাখ্যানে
অভিমান, অনুযোগ, বিক্ষোভ আছে
আমার কী আছে?
আমি কোন্ ত্রিশঙ্কুজাতক
শের খাঁ-র অবয়ব মিলিয়ে যায় ধীরে ধীরে
অস্তমিতপ্রায় চিরপলাতক
আলেয়া রূপলাবণ্য শুধু
নূরজাহানের পরিচয় হবে!
খুরমের দয়ার মতো
অবোধ সময়ের ভাতা’র
অনুগ্রহপ্রার্থী আমি?
পৃথিবীর কাছে যোষিৎ-এর
আর কোনও মাত্রা নেই!
তার যন্ত্রণা, তার অপারগতা
তার প্রচেষ্টা, অন্বেষা, শূন্যতা
দ্বন্দ্বদ্বিধা, আত্মখনন, নির্জনতা
সবই মিশে যাবে ওই
সর্বদ্রাব্য মুহব্বতের জলে!
আগতরাত্রির তীরে
প্রসারিত হাত, এই প্রশ্ন
প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরুক
বন্দরে ইথারে...
তোমার আদরের মেহের,
কারোর-বা নূর; আরও শত
মানবীর সারিতে দাঁড়িয়ে
ঐশ্বর্যের বলয় হতে বহুদূরে
অপেক্ষায় থাক যুগ যুগ
তৃপ্তিহীন, শান্তিহীন, সংজ্ঞাহীন
প্রশ্নপত্র হাতে –
আর কোন্ পরিচয়, – আলো
জ্বলে দেখি ভবিষ্যপ্রদীপে
লাডলি আসে
লাডলি।। আম্মা!
প্রাসাদে চলুন
নিরাময়ী অন্ধকার
নীরবতার রাত্রি গভীরতর হল ...
নূর।। চলো
আরও কিছু কাল সুপ্ত থাকি,
একান্তে শায়েরি লিখি
প্রতীক্ষাআঁধারে...
–