অনুপ্রেরণা : যবে থেকে ছোটদের পেন্সিল ও ফাউন্টেন কলমে লেখার অভ্যাস কমিয়ে বা তুলে দেওয়া হয় তখন থেকে হাতের লেখার সৌন্দর্য্য অন্যরকম হয়ে যায়। এক সময় এমন অবস্থা হয় যে বই-খাতার সাধারণ দোকানগুলোতে ফাউন্টেন পেন ও কালি পাওয়া শক্ত হয় কারণ দোকানদার বলেন এগুলোর এখন কাটতি নেই।
বহু বছর পর …।
এদিন দোকানে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ভাল ফাউন্টেন পেন আছে? দোকানদার বললেন, অল্প দামেরগুলো আমার কাছে আছে। অবাক হয়ে বললাম, কারা কেনে? দোকানদার বললেন, এখন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ফাউন্টেন কলমে লেখা বাধ্যতামূলক। তারা সকলে কেনে।
মনে হলো এখনও কিছু মানুষ তাহলে হাতের লেখার প্রতি যত্নবান।
পুরানো দিনের কয়েকটি ফাউন্টেন কলমের নিব এখনও রয়ে গেছে । বিশেষ ধরণের নিব। শৈল্পিক লেখার জন্যই শুধু। এবার তাদের কাজে লাগিয়ে একটা প্রদর্শনী করার কথা মাথায় এলো। তা থেকে হস্তলেখাপ্রেমীদের হয়ত একজন কেউ ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি নেবে। আমাদের মত তাকেও হয়ত কোনো বর্ষীয়ান প্রখ্যাত গুণীজন বলবেন, আমার পাওয়া মানপত্রের অনুলিপি তুমি তোমার হাতের লেখায় করে দিও, কম্পিউটারে নয়।
প্রিয় বন্ধুরা, সকলকে হস্তলিপি শিল্প প্রদর্শনীতে স্বাগত জানাই।
Exhibition Countdown Timer
Calligraphy Exhibition
ক্যালিগ্রাফি (Calligraphy) বা লিখনশিল্প হল রেখাশিল্পের একটি অন্যতম দিক। লিখনশিল্পে কোনো ভাষায় ব্যবহৃত অক্ষরগুলিকে শৈল্পিকরূপে প্রকাশ করা হয়ে থাকে। এখানে শিল্পী তার অনুভবে অক্ষরগুলোকে প্রকাশ করেন । লিখনশিল্প টাইপোগ্রাফি নয় যেখানে অক্ষরগুলির খুব নিখুঁত জ্যামিতিকরূপ প্রকাশ পেয়ে থাকে। টাইপোগ্রাফিতে অক্ষরগুলো নিখুঁত হলেও, কিছু সময় দেখার পরে সেটি দর্শকের কাছে শিল্পরস হারিয়ে ফেলে। সেটিতে অধিক সময় রসাস্বাদন সম্ভব হয় না । কিন্তু লিখনশিল্পে জ্যামিতিক প্রকাশের সাথে আত্মিক অনুভব মিশে এক প্রাণবন্ত সৌন্দর্য্য পায়। চিত্রশিল্পের মতোই এখানেও শিল্পীর একটি অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য থাকে দর্শককে ভাবিত করা । শিল্পী যেন একটা অক্ষরে অথবা একটা শব্দে কিংবা একটা বাক্যে বিশ্বরূপের একটা অনুভূতির ইঙ্গিত দিয়ে থাকেন। শিল্পের রসগুণ অবশ্য শুধু অনুভব করা যায়, যথাযথভাবে ব্যক্ত করা যায়না। শুধু বলা যায় প্রকাশব্যঞ্জনা, অলঙ্কার ইত্যাদির মাধ্যমে লিখনশিল্পে শিল্পী অক্ষরমালার শিল্পরস ও তাৎপর্য বৃদ্ধি করেন।
PenMan at Work
Writing stuff
Detail of nib
Digital Calligraphy - First step
(শ্রী অশোক মিত্র রচিত পশ্চিম ইউরোপের চিত্রকলা গ্রন্থ থেকে এই অংশটুকু সংগৃহীত)
ফুলের শহর ফ্লরেন্সে সেন্ট মার্কস্ বলে একটি মনাস্টারি ছিল । সেন্টমার্ক বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্টের দ্বিতীয় পুস্তক লেখেন, তাঁরই নামে এই মনাস্টারি। এখানে একজন সন্ন্যাসী ছিলেন, অতি সাধু লােক । লােকে তাই তাঁর নাম দিয়েছিল দেবদূতের মত ভাই'। তাঁর ভাষায়, অর্থাৎ ইতালিয়ানে, দেবদূতােপম ভাই। এঁর নাম ছিলাে ফ্রা আঞ্জেলিকো ; ফ্রা মানে ভাই, আঞ্জেলিকো মানে স্বর্গদূতের মত । একটু অদ্ভুত লাগে ভাবতে যে একজন মাঙ্ক জগদ্বিখ্যাত শিল্পী হলেন, কিন্তু ফ্রা আঞ্জেলিকোর আঁকার হাত, রঙ দেবার হাত ছিলাে খুব পাকা, আর সেই হাতে তিনি মনাস্টারির ঘরের দেওয়ালে দেওয়ালে বাইবেলের ছবি এঁকে যেতেন।
যে সব ঘরে মাঙ্করা শুতেন তাদের বলতাে সেল। ঘরগুলি হতাে একেবারে আসবাবপত্রবর্জিত, কোন শৌখিন বা আরামের জিনিস রাখা বারণ, প্রায় জেলখানার ছােট একা থাকার কুঠুরির মত । সেন্ট মার্ক মনাস্টারিতে প্রায় চল্লিশটা এই রকম সেল ছিল আর ফ্রা আঞ্জেলিকো সারা জীবন ধরে সেই সব সেলের দেয়ালে দেয়ালে ছবি একে কাটালেন, যাতে মাঙ্করা নিজের ঘরে বসে বাইবেলের কাহিনী আঁকা দেখতে পান, আর তারই ধ্যানে সময় কাটান। এই সব ছবি অবশ্য ফ্রেস্কোয় আঁকা। এ ছাড়াও ফ্রা আঞ্জেলিকো কাঠের পাটায় টেম্পেরায় ছবি আঁকতেন, পাটাগুলি এঘর থেকে ওঘরে, এখান থেকে ওখানে নিয়ে যাওয়া যেতাে। টেম্পেরা মানে ডিম বা গদ, বা কষ ধরনের আঠার সঙ্গে রঙ মিশিয়ে সেই রঙে যে ছবি হয়, তাকে বলে টেম্পেরা। টেম্পেরা মানে মেশানো, মিশ্র।
ফ্রা আঞ্জেলিকো জন্মান ইতালির ফিয়েজোলে বলে জায়গায়, ১৩৮৭ সালে। মারা যান রােমে, ১৪৫৫ সালে । অর্থাৎ জত্তোর প্রায় একশ বছর পরে তিনি আঁকতে শুরু করেন কিন্তু এতদিন পরে জন্মেও তিনি জত্তোর প্রভাবমুক্ত হতে পারেননি। জত্তোর ধাঁচেই প্রায় আঁকতেন। এতই বিরাট শিল্পী ছিলেন জত্তো। প্রবাদ আছে কোন ছবি আঁকার আগে ফ্রা আঞ্জেলিকো অনেকক্ষণ ধরে একাগ্র মনে প্রার্থনা করতেন, তারপর ছবি আঁকতে বসতেন। আর যা আঁকতেন তা কখনও মুছতেন না বা বদলাতেন না। যে রেখা বা রঙটি যেমন প্রথম এলাে সেটিই রাখতেন। বিশ্বাস করতেন, যে তিনি নিজের ইচ্ছেয় আঁকছেন না, ঈশ্বর তাঁর হাতকে চালিত করছেন, সুতরাং কোন কিছু বদলানাে অপরাধ হবে। এত যিনি ধর্মভীরু লােক, বলাই বাহুল্য তিনি ধর্মসম্বন্ধীয় ছবি ছাড়া আর কিছু আঁকেননি । সে সব ছবি সাধু সিদ্ধপুরুষদের, স্বর্গদূতদের । বলা অবান্তর যে, ছবি আঁকার জন্যে তিনি কখনও কানাকড়িও পাননি।
ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে, ইওরােপের দক্ষিণপুবে গ্রীকরা সবচেয়ে ভাল মূর্তি গড়তে পারতেন, আর স্থাপত্যে ছিলেন অদ্বিতীয়। কিন্তু ছবি আঁকার হাত তাঁদের ভাল ছিল না। তাঁদের ছবি অধিকাংশই এপ্রিল-ফুল-করা, অর্থাৎ বােকা-বানানাে ধাঁচের ছবি। তাঁরা এমন ছবি আঁকতে ভালবাসতেন, যাতে লােক বােকা বনে মনে করে যে ছবিটা ছবি নয়, জলজ্যান্ত মানুষ বা প্রকৃতি।
ঈজিপ্ট বা অসিরিয়ার ছবি আমরা জানি, দেখি, কিন্তু শিল্পীর নাম জানি না। গ্রীক ছবির বেলায় শিল্পীর নাম আমরা পাই, কিন্তু ছবির চিহ্ন নেই। জানাশােনার মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন শিল্পীর নাম আমরা জানতে পেরেছি। তিনি ছিলেন একজন গ্রীক। নামটা শক্ত। অধিকাংশ গ্রীক নামই খটমটে । কিন্তু যেহেতু তাঁকে গ্রীকচিত্রকলার আদিপুরুষ বলা হয়, সেহেতু নামটা জেনে রাখা ভাল। তাঁর নাম পলিগ্নোটাস্। তাঁর সমসাময়িক লেখকরা বলে গেছেন, পলিগ্নোটাস্ ছিলেন আশ্চর্য শিল্পী। কিন্তু তাঁর একটা ছবিও আজ নেই।
খুব কম গ্রীক ছবিই এখনও আছে। তার একটা কারণ যে গ্রীক ছবি দেয়ালে আঁকা হতাে না ; এখন যেমন, তেমনি তখনও এমন জিনিসে ছবি আঁকা হতাে যা এক জায়গা থেকে অন্যত্র বয়ে বেড়ানাে যায়। ফলে ঠাঁই নাড়ানাড়ি করতে করতে ছবি যায় নষ্ট হয়ে, হারিয়ে। এইভাবেই প্রায় সব গ্রীক ছবি নষ্ট হয়ে গেছে।
গ্রীকদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ চিত্রশিল্পীর নাম অপেলিজ। তিনি ছিলেন সম্রাট আলেকজাণ্ডারের বিশেষ বন্ধু । তিনি আলেজাণ্ডারের ছবি একেছিলেন । কিন্তু ছবির জন্যে তিনি আজ যত না বিখ্যাত, তার চেয়ে তাঁর খ্যাতি তাঁর সম্বন্ধে দুটো-তিনটে গল্প ।
অপেলিজ অসম্ভব খাটতেন। তাঁর প্রতিজ্ঞা ছিল প্রতি দিনই কিছু-না-কিছু কাজের মত কাজ করবেনই। তিনি বলতেন 'লাইন নেই, দিন নেই' । অর্থাৎ এমন দিন যাবে না যেদিন আমি একটিও ভাল লাইন আঁকতে পারবাে না । দু হাজার বছরের উপর হয়ে গেলাে, আমরা এখনও তাঁর এই সব কথা বলি। এসব কথা প্রবাদ হয়ে গেছে। কথাগুলি থেকে গেছে, ছবি একটিও নেই। কিন্তু জীবদ্দশায় তাঁর খ্যাতি ছিলাে অসীম।
তাঁর সূক্ষ্ম কাজের একটি গল্প প্রবাদ হিসেবে চলিত আছে এতে বােঝা যায় তুলি ধরায় অপেলিজ কত ওস্তাদ ছিলেন। গল্প আছে, তিনি একদিন এক শিল্পী বন্ধুর বাড়ীতে বেড়াতে গেছেন । বন্ধু বাড়ীতে ছিলেন না। তাই অপেলিজ তাঁর তুলি তুলে নিয়ে সেটি রঙে ডুবিয়ে তাঁর আঁকার ইজেলে খুব সূক্ষ্ম একটি লাইন শুধু এঁকে রেখে চলে গেলেন। ইচ্ছেটা দেখা বন্ধুর নজরে পড়ে কিনা, এবং লাইনটা দেখে তিনি বুঝতে পারেন কিনা কে এসেছিলাে । বন্ধু পরে ফিরে এলেন, রেখাটা তাঁর নজরে পড়লাে, আর চেঁচিয়ে উঠলেন —
অপেলিজ এসেছিলেন। আমি ছাড়া পৃথিবীতে আর একজনই এত সূক্ষ্ম রেখা আঁকতে পারে। সে অপেলিজ।
তখন তিনি অপেলিজের রেখা ধরে, তার তলা টেনে তুলির ডগায় সেই রেখাটি চিরে দুটি সূক্ষ্মতর রেখা করলেন ।
অপেলিজ আবার এলেন। এসে যখন দেখলেন তাঁর রেখাটি টেনে দুভাগ করা হয়েছে, তখন তিনি আবার সেই দুভাগের প্রত্যেক ভাগটি টেনে আরও সূক্ষ্ম দুভাগ করলেন, তাদেরও আবার তুলি দিয়ে টেনে প্রত্যেকটিকে আরও সূক্ষ্ম দুভাগ করলেন। বার বার করে 'চুল চেরা' আর কি ! বড় দুঃখের কথা গ্রীকদের এমন ছবি আর একটাও নেই।
Calligraphy is considered not only an art form, but also a way to improve the body and spirit.
যদিও ক্যালিগ্রাফারেরা এখনও পর্যন্ত প্রথাগত পদ্ধতিতেই ক্যালিগ্রাফি করে থাকেন কিন্তু বর্তমান যুগে ক্যালিগ্রাফি কাজে কম্পিউটারকে ব্যবহার করা যায়। ফটোশপ (Photoshop) অথবা জিম্প (Gimp) এর যেকোনো একটি ইমেজ এডিটিং সফটওয়্যার ব্যবহার করে ক্যালিগ্রাফি কাজ করা যায়। এক্ষেত্রে লেখাটি আগে লিখে নিয়ে ইমেজ এডিটিং সফটওয়্যার এর সাহায্যে লেখাটির আরও নিখুঁত জ্যামিতিক গঠন তৈরি করা যায়। ইঙ্কস্কেপ (Inkscape) জাতীয় সফটওয়ারের সাহায্যে আপনি নিজস্ব ফন্ট তৈরি করতে পারেন।
পাশে ইমেজ এডিটিং সফটওয়্যার-এ আমাদের করা ডিজিটাল ক্যালিগ্রাফির একটা ছবি দেওয়া হল ।
VISIT ON YOUTUBE