Smt. Arpita Chatterjee

Professional Assistant,

Central Library, Visva-Bharati

Email: chatarp@gmail.com 

শিশুদের ছবিমন, অবলোকন 

আমার মেয়ে খুব ছোটবেলায় আঁকার খাতা জুড়ে অনেক পাখি আঁকত। টিয়া, বুলবুলি, শালিক, কাক আর ছাতারে অনেক পাখির নাম বলত ঠিকই কিন্তু সবই পাখি প্রায় একই রকম দেখতে হত।  শুধু বুলবুলির ঝুঁটি, টিয়ার লাল ঠোঁট, কাকের গায়ের কালো রঙ দেখে আমাদের বুঝতে হত এরা কোন পাখি। একটা বিষয় খেয়াল করতাম যখনই পাখির চোখ আঁকত পেছনের পাতাটা উল্টে আলোর দিকে কি যেন দেখত। তারপর ঠিক ঐ চোখের জায়গাটাতে পেছনের পাতায় চোখের মত একটা ছোট কালো ফুটকি আঁকত। সেই ফুটকি আঁকা পেছনের পাতার এক কোণায় থাকত খুব ছোট একটা লঙ্কা, পেঁপে বা পেয়ারা। খাতার পাতা শেষ হয়ে গেলে আমি যখন বকতাম আর বলতাম –“কালো ফুটকি দিয়ে দিয়ে পাতাগুলো সব নষ্ট করেছ”  তখন গুঞ্জা খুব অবাক হয়ে আমাকে বলত – “ মাগো, আমায় কানা পাখি আঁকতে বোলোনা। দূরে গাছের ডালের খাবার ওরা এক চোখে দেখবে কেমন করে”?

ছোটদের স্বাধীন চিত্রাঙ্কনের ধারার চলন এতো বৈচিত্রময় হয় যে কোন ছবিকে এককথায় বাতিল করে দেওয়া ধৃষ্টতা হয়ে দাঁড়ায়। একবার আমার মেয়ে তখন ক্লাস ফোর পিকনিকের পরেরদিন ওদের স্কুলের  আঁকার শিক্ষক আঁকার ক্লাসে সবাইকে পিকনিক আঁকতে বলেন। সেদিন আমি অফিস থেকে বাড়ি ফিরে ওর বইখাতাগুলো দেখছি কি কি বাড়ির কাজ আছে। খাতা দেখতে গিয়ে হাতে পড়ল ওর ঐ আঁকার খাতা। দেখলাম পেনসিলে আঁকা একটা অযত্নের ছবি। সাদা পাতার বাঁদিকে একটা গাছের গুঁড়ির অর্দ্ধেক সোজা হয়ে উঠেছে উপরের দিকে তাতে একটা মোটা ডাল, তাতে দুচারটে পাতা । তার তলায় কড়াই, হাতা, খুন্তি, হাঁড়ি, ডেকচি, বালতি, উনুন যত্রতত্র ছড়িয়ে আছে । আমি মেয়েকে খুব বকি বলি- “ তোমাদের শিক্ষক তোমাদের কি সুন্দর বিষয় দিয়েছিলেন আঁকার জন্য তুমি কি অযত্ন করে একটা ছবি এঁকেছ।” ও তখন রাস্তা থেকে কুড়িয়ে আনা কুকুর ছানাকে দুধ খাওয়াচ্ছিল বলল – “ রান্নাঘরের ঐ বিচ্ছিরি গরম আর কালো কালো ঝুলকালিভরা তাকগুলো থেকে ওরাও তো কাল আলোর মধ্যে গাছের তলায় ঘাসের কাছে পিকনিকে গেছিলো, নাকি”! আমার এ উত্তর তেমন মনে ধরেনি বলেছিলাম- “ ফাঁকিবাজি করছ তারপর আবার পাকাপাকা কথা । বড্ড বেশী ফাজিল হয়েছ”। আমার মেয়ে সেদিন রাতে তার বাবাকে একটা মনের কথা ফিসফিস করে বলেছিল – “ ভাগ্যিস মা আমাদের আঁকার ক্লাস নেয়না”। এ কথায় ঐদিন রাত্রে আমি দুঃখ পেলেও পাঠভবনের বার্ষিক শিল্প প্রদর্শনীতে আমার মেয়ের আঁকা সেই অযত্নের ছবিকে যখন টানটান করে যত্নে টাঙানো দেখেছিলাম ছবির সারিতে, সেদিন বেশ বুঝেছিলাম শিশুদের ছবি মনকে হয়ত আমরা সাধারণ বাবা মারা স্পর্শই করতে পারিনা যা পারে এক সার্থক আঁকার শিক্ষকের অনুভবি শিল্পী মন।

শুধু আমার মেয়ে নয় বহু শিশুমনকে আমি নিবিড় করে চিনেছি তাদের ছোটবেলার ছবিতে। একটা ছোট্ট ছেলে ছিল । তখন তার বছর আটেক বয়স। তার সম্পর্কে সবাই বলতো সবাইকে “এতো দুষ্টু ছেলে এতো দুষ্টু এর দ্বারা জীবনে কিচ্ছুটি হবেনা। পৃথিবীর কোনো বিষয়ে ওর মন নেই। সারাদিন বাঁদরামো ”। তার মা বাবারও তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ ছিলোনা। সেই বাঁদরকে তার মা বাবা একবার কয়েকদিনের জন্য রেখে গেছিলো এই দুয়োরাণীর ঘরে। সেই বাঁদর কিন্তু দুয়োরাণীর জীবন আলো করে তুলেছিল। দুয়োরাণী ভোরবেলা যখন তার গায়ের চাদরটা টেনে দিয়ে বিছনা থেকে উঠে পাখি খেতে দিতে যেত তখন দেখত সেও তার পিছু পিছু চাদর থেকে বেড়িয়ে এসে পাখিদের খেতে দেয়। পাখিদের খাওয়া হলে বেড়ালদের খাওয়া । বেড়ালদের খাওয়া হলে কুকুরদের খাওয়া। ঘরের কুকুরের খাওয়া হলে পাড়ার কুকুরের খাওয়া। এদের সকলের সকালের খাওয়া হলে দুপুরের খাওয়া, দুপুরের খাওয়া শেষ হলে রাতের খাওয়া। সে বাঁদর ব্যাচারি সারাদিন এতো ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল যে সে আর বাঁদরামি করার সময় পায়না। বাঁদরামি করতে করতে তার চোখে পড়ে কালো পিঁপড়ে লাল পিঁপড়ের দল জাম গাছের গা বেয়ে উঠছে নামছে । সে ছুটে আসে আমার কাছে বলে-“ একটু চিনি দাও ওদের বাসার পাশে দিয়ে আসি, ওরাও খাক সারাদিন ব্যস্ততায় কাটলেও সন্ধ্যে হলেই তার উসখুস  বাড়ত ।  কি করি  কি  করি একটা ভাব। এরকম একদিন সন্ধ্যেবেলা এক ঝুড়ি রঙ আর আঁকার খাতা দিয়ে তাকে আঁকতে বসিয়েছিলাম। আদর করে বলেছিলাম –“ তোমার যা ইচ্ছা হয় আঁকো  পাহাড়, সমুদ্র যা খুশি’। সে খানিকক্ষন চুপ করে তার লম্বা লম্বা চোখের পাতা ঘেরা চোখ নিয়ে আমার দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে একটু তুতলিয়ে বলেছিল –“ যা খুশি”! সেই প্রথম মনে হয় কেউ তাকে “যা খুশি” করতে বলেছিল তাই তার সে কথা শুনে বিস্ময়ের শেষ ছিলোনা । কিন্তু এরপর সে যে কথাটা আমায় একটু ভেবে চিন্তিত চোখে ভয়েভয়ে চুপিচুপি ফিসফিস করে বলেছিল সে কথাটা আজোও আমার কাছে সম্পদ, বলেছিল – “ আমি না সমুদ্রের ঢেউয়ে পাহাড় দেখতে পাই”। ফুলের ভারে গাছ যেমন নুইয়ে পড়ে মাটির বুকে ঠিক তেমন করে এই কথাটা বলেই তার কেমন যেন লজ্জা হয়েছিল সে সেই লজ্জায় তার মুখটা নামিয়ে ফেলেছিল তখন খাতার পাতার উপর । মাথা ভরা চুল তখন তার মুখ ঢেকেছে। আমি দেখি ঐ চুলের ফাঁক দিয়ে তার দুটো চোখ আমায় আড়চোখে দেখছে। আমি তখন তাকে বলি –“ আমায় একটু এঁকে দেখাবি সমুদ্রের ঢেউয়ের মধ্যে সেই পাহাড়গুলো ঠিক কেমন করে জাগে” ।  আঁকার খাতার সাদা পাতায় বসতে শুরু করল এক সমুদ্র-জীবন। আমি সন্ধ্যে দিই সমুদ্রের হাল্কা নীল ক্রমশ গাঢ় নীলের দিকে এগিয়ে যায়। আমি তুলসীতলায় প্রদীপ রেখে ফিরি । সমুদ্রের গাঢ়নীলের তখন আকাশের আকাশি নীলের সঙ্গে মিলমিশ চলে। আমি পুজোর পাঠ মিটিয়ে রান্নাঘরে ঢুকি ফ্রিজ থেকে তরকারি নিয়ে কুটতে বসি ওদিকে সমুদ্রের ধারে চায়ের দোকান বসে, চেয়ার পাততে থাকে নুলিয়া টুপি মাথায় পরা ছোট কালো ছেলেটা। আমি কড়াইয়ে তেল দিই, তেলে ফোড়ন দিই ডাবওয়লার ভ্যান নিয়ে এসে ঢোকে চায়ের দোকানের পাশে, তার ভ্যানের ওপর লাগানো হয় এক মস্ত সবুজ ছাতা। বাবা তার ছোট্টছেলেকে নিয়ে সমুদ্রের সাদা সফেন জলে পা ভেজায়। একদল ছেলেমেয়ে ঢেউয়ে ভেসে ভেসে চান করে । দূরে পাল তোলা লালা নীল সাদা নৌকা গুলো মাঝ সমু্দ্রে পাড়ি জমায় । আমি তরকারি নামিয়ে আটা মাখতে মাখতে সমুদ্রের ধারে ঘুরে যাই। রুটি করছি আর মনে মনে ভাবি ছবিটা বাঁধিয়ে দেবো ওকে । ওর বাবা মা দেখে ভারি খুশি হবে। শেষ রুটিটা তাওয়ায় দিয়ে সমুদ্রেরতীরে ঘুরতে এসে চীৎকার করি – “এ কি করলে তুমি, ছবিটা নষ্ট করে ফেললে, অমন বিচ্ছিরি করে গাঢ় নীল রঙটা সারা ছবিতে ছড়িয়ে দিলে এইজন্য সবাই তোমার ওপর রেগে যায়”। সে গাঢ় নীল রঙের প্যাস্টেলটা ছবিতে ঘসতে ঘসতে বলেছিল –“সুনামী, সুনামী হলে সমুদ্রপাড়ের সব নষ্ট হয়ে যায়, সবাই তোমার মতো চীৎকার করে ভয়ে ”। পোড়া রুটিটা তাওয়া থেকে তুলতে তুলতে মনে মনে বলেছিলাম ভাগ্যিস ছেলেটা বাঁদর তাই ওর “মন” বলে বিষয়টা আছে। মানুষ হলে কবেই তো মান,হুঁসের সঙ্গে মনটা খুইয়ে বসতো।

এরকম একবার একদল ছোট সাঁওতাল ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আমার খুব খেলা জমেছিল। সেদিন খেলাটা ছিল “ছবি ছবি” খেলা। তখন শীতের মাঝামাঝি বীরভূমের এক দূরের গ্রামে কাজে গেছি। হঠাৎ গাড়ি গেল খারাপ হয়ে। যেখানে গাড়ি খারাপ হল তার একদিকে ছিলো মস্ত এক হলুদ সরষে ক্ষেত আর অপরদিকে ছিলো এক সাঁওতাল পাড়া। গাড়ি খারাপ হতেই দেখলাম সেই পাড়ার ছেলেমেয়েদের কি ফুর্তি। আমারো ওদের দেখে ভারি ফুর্তি হল। ব্যাগ থেকে লজেন্স নিয়ে সবাই মিলে ভাগাভাগি করে খেলাম। এরপর চললাম আমি ওদের সঙ্গে ওদের গ্রাম দেখতে। আমি তো বিশেষ হাঁটতে পারিনা একটু বসি একটু হাঁটি। কিন্তু হাঁটতে হাঁটতে ওদের সঙ্গে “ছবি ছবি” খেলি। সে ভারি মজার খেলা। খেলার শুরু হয়েছিল ওদের সব ছোট মেয়েটি বুড়ি কে দিয়ে। বলেছিলাম বুড়ি তোর “চিতোর” বললে কি মনে হয় । বুড়ি বলল –“ দা” । বুড়ির দাদা সুনীল হঠাৎ রেগে বলল –“ দা না গদ্দা”। সুনীলের বন্ধু কালি সুনীলকে ভেঙিয়ে বলল  – “হুঁ গদ্দা” বল “গডিও”। সঙ্গে সঙ্গে প্রায় কালোমণি বলে ওঠে - “হাখু”। কালির পাশে ছিল লক্ষ্মী। সে হেসে লাল ফিতেদিয়ে বাঁধা দু টো বেণী দুলিয়ে এক পাক ঘুরে দুলে দুলে বলল –“পরাইনি”। আবার বসি বলি- “ তোরা কি বলিস আমি কিচ্ছু যে বুঝিনা”। সেই শুনে ওদের কি হাসি। গড়িয়ে গড়িয়ে হাসছে সব। হঠাৎ কালি একটা ঢিল তুলে নিয়ে একটা ভাঙা নীল দেওয়ালে দুটো মেটে মেটে সমান্তরাল দাগ টানে। আমি কিছু বোঝার আগে বুড়ি ঐ দাগের মধ্যের নীল জায়গাটায় আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে আর বলে –“ দা, দা”। সুনীল বুড়ির হাত সরিয়ে দিয়ে সমান্তরাল সোজা লাইন গুলোকে একটু নিচের দিকে টানতে টানতে বলল –“ গদ্দা, গদ্দা”। আমি বললাম – “নদী, নদী”। কালি আর একটা ঢিল তুলে নিয়ে এসে সমান্তরাল লাইনগুলোকে একটা চতুর্ভূজ করে তোলে আর বল – “গডিও”।  ভাঙা মাটির নীল দেওয়ালে সে এক মস্ত পুকুর কাটা চলতে লাগে। আমি লক্ষ্মীকে বলি তোর “পরাইনি” কই ? সুকুল মাটি থেকে পুড়ে যাওয়া কয়লার টুক দিয়ে আঁকতে লাগলো “পরাইনি”  সেই মস্ত নদীতে একে একেশাপলা ফুটতে থাকে। এত সব কিছুর মধ্যে মঙ্গল মোটা বটের পাতা হাতে ছিঁড়ে ছিঁড়ে বানিয়েছে বেশ কয়েকটা হাখু। পাশের বাড়ি থেকে একটু ভাত নিয়ে এসে সে সব হাখুকে পুকুরের জলে ভাসিয়ে দেয়।  আমি দেখি সপরিবার মাছেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে পুকুর জুড়ে। এইভাবে মঙ্গল আর বুদি মিলে নদীর গায়ে “দারি” আঁকে। সেই দারি বা গাছে উড়ে এসে বসল অনেকগুলো “দাঞ্চেড়ে”। বুড়ি তাদের কয়েকজনের গা জলে ডুবিয়ে দিল। অমন নীলনদীর শাপলাবিলে জলপিপিদের ভিড় দেখে যখন আমার মন খুশিতে ভরে উঠল তখন ওরাই বলল নেচে নেচে এই পুকুরের নাম নাকি “ বাহাগডিও” (ফুলপুকুর)।  দূর থেকে ভেসে আসে গাড়ির হর্ন। গাড়ির দিকে হাঁটতে থাকি সবাই মিলে  আমি জিজ্ঞেস করি – “তোদের পাড়ার পুকুরটা আমাদের আঁকা পুকুরটার থেকে অনেক সুন্দর বল”? ওরা খুব হেসে নেচে কুঁদে বলে- “ আমাদের গ্রামে একটা পুকুর আছে তার নাম “বাহাগডিও, বাহাগডিও” । আমি গাড়িতে উঠতে উঠতে বলি -“ওটা তো এক্ষুনি হল কিন্তু যেটা আসলে আছে সেটার নাম কি?” গাড়ি স্টার্ট করে কিছু শুনতে পাই কিছু শুনতে পাই না, যতদূর শুনি সুনীল চীৎকার করে বলে –“আমাদের পাড়ায় কোনো পুকুর নেই। খুব জলের কষ্ট”। সেদিন বুঝেছিলাম শিশুমনের ছবি আঁকতে কিছু তেমন লাগে না মন লাগে। এই সাঁওতাল ছেলেমেয়েদের থেকে শিখে এইরকম “ছবি ছবি” খেলা আমি অনেকবার অনেক ছোটদের সঙ্গে খেলেছি। সে খেলার একটাই শর্ত কোনো দামি রঙ নয় আসলে সত্যি কথা বলতে কোনো কেনা রঙ নয় কোনো কাগজ নয় কোনো পেন নয় কোনো পেনসিল নয় প্রকৃতির মধ্যে বসে, প্রকৃতি থেকে পাওয়া জিনিস দিয়ে, যা খুশি, যেখানে খুশি আঁকো। আমি সেসব ছবি খেলায় শিশুদের মধ্যে আবিষ্কারকের মন, আবিষ্কারি মনের আনন্দ দেখেছি বারবার। আর শিশুদের সে সব ছবিষ বিষয় বৈচিত্র্য হয় মুগ্ধ হবার মতো।     

আমি বারবার ছোটদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে খেয়াল করেছি ছোটোদের যদি স্বাধীনভাবে ছবি আঁকতে দেওয়া হয়, বড়দের “এই করো ঐ করো আর এইভাবে করোর” শিক্ষিত আগ্রাসী মন তাদের যদি কারণে অকারণে নির্দেশ না দেয় তাহলে তাদের ছবিতে সুখের চেয়ে বেদনা বেশী বোনা থাকে। সে বেদনা আপাত ভাবে ব্যক্তিগত মনে হলেও এই বেদনার মধ্যে যে অসুখের কথা থাকে তা বিশ্বেজনীন। আমরা বড়রা সেই বেদনার ভাষার সঙ্গে communicate করতেই পারিনা। আমাদের সচেতন শিক্ষিত আগ্রাসী মন সবসময় সারা পৃথিবীকে “ আমার মনের মতোন”  করে দেখতে চাই। কিন্তু  শিশুদের স্বাধীন চিত্রাঙ্কন চর্চা যারা খুব নিবিড় ভাবে উপলব্ধি করেছি তারা জানি শিশুদের চিত্রকলায় যে “ inner calling” থাকে তার বৈচিত্র্যের ভিন্নতা ও অভিনবত্ব মুগ্ধ করার মতো ।

শিশুদের ছবি দেখতে দেখতে তাদের ছবিমন খুঁজতে খুঁজতে আমি একবার পৌঁছে যাই সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে এক রাজকন্যার অলিন্দে। রাজকন্যার বয়স তখন নয়-দশ হবে। এই রাজকন্যার সঙ্গে আমর প্রথম যেদিন দেখা হয়েছিল সেদিন সে তেঁতুল পাড়তে যাবে বলে তার রাজপ্রাসাদের এক অলিন্দের ধারে বসে বাইরের পড়ে থাকা পায়ে চলা পথটার দিকে ভুরু কুঁচকে চেয়ে ছিল। বাড়ির মস্ত কত্তাদাদু ঘড়িটার ওপর তার তখন বেজায় রাগ সে কিছুতেই চারটে বাজাচ্ছে না বলে। রাজকন্যা নাকি চারটে বাজতে কুড়ি মিনিট আছে দেখে চুল আঁচড়াতে গেছিলো, চুল আঁচড়ে ফিরে এসে দেখে তখনো চারটে বাজতে কুড়ি মিনিট বাকি। সেদিন সেই রাজকন্যা আমাকে চুপি চুপি বলেছিল – “ ঐ কত্তাদাদুটা আসলে একটা দুষ্টু দৈত্য কাঁটাগুলোকে খুব কড়া শাসনে রাখে কিছুতেই নড়াচড়া করতে দেয়না বিশেষ করে এই বিকেলআলোয় চারটে বাজার সময়”। সেই রাজকন্যা খুব বেশী কথা বলতো না। তার ঘন কাজল কালো চোখ দিয়ে সে বেশী দেখত সব শুনত বলতো খুব কম।  তার রাজপ্রাসাদের জানলার সামনে দিয়ে যদি তার মনের মত লোক যেত তখন সে তাদের সঙ্গে দুটো একটা কথা বলত টুপ টুপ করে আর মাঝে মাঝে খুব মাঝে মাঝে খুব মনের মত লোক পেলে সে ছুট্টে ঘর থেকে নিয়ে আসত তার আঁকার খাতা তার আঁকা ছবি দেখাবে বলে। আমার আর রাজকন্যার মনের কথারাও কখনো কখনো সময়ে অসময়ে পারাপার করত তার জানলার এপার ওপারে । তখনই দেখেছিলাম রাজকন্যার আঁকা ছবি। রাজকন্যার ছোটবেলার ছবিতে ছোট ছোট গল্প থাকত। সে গল্প কখনো হতো একটা পুরোনো কাঠের টেবিলে রাখা একটা নীল কাপের , কখনো বা সে গল্প হতো ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা হাতল ভাঙা একটা চেয়ারের। কিম্বা আলনায় ঝুলে থাকা একটা লাল সাদা চেককাটা ঘটি হাতা ফ্রকের। আবার কখনো বা বালিশের পাশে রাখা একটা না খোলা বইয়ের চুপ করে বসে থাকার গল্প বলতো তার ছবি। বিচ্ছিন্নভাবে ছবিগুলোকে দেখলে দারুন ও অন্যরকম লাগতো আমার । কিন্তু একদিন বৃষ্টিদিনের মনখারাপ করা বিকেলে রাজকন্যা যখন তার মেঘের মতো একঢাল চুল উড়িয়ে এসে তার আঁকার খাতাটা বাড়িয়ে দিল আমার জানলায়, সেই মুহুর্তে এক অচিনসুখে আমার দরজায় ঠেলা দিয়েছিল উদাসী হাওয়া আর আমার মনের দরজাও গেছিলো আপনি খুলে। তারপর কত্তাদাদুর বুড়ো ঘড়িটার তোয়াক্কা না করে গা ঘেঁসাঘেঁসি করে সাদা ফুল তোলা লাল জাজিমের কার্পেটে বসে জমেছিলো আমার আর রাজকন্যার গল্প। সেদিন সেই আঁকার খাতার সব ছবিগুলো একসঙ্গে দেখতে দেখতে রাজকন্যার সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমার রাজকন্যাকে “story tailor”মনে হয়েছিল। মনে হয়েছিল সে তার ছবির পর ছবিতে যে গল্পের পর গল্প সেলাই করে চলেছে  তা হল এক একাকীত্বের উপাখ্যান। যা হয়তো আমরা আপাতভাবে দেখে  মনে করছি ব্যক্তিগত অনুভূতির উপাখ্যান। কিন্তু বর্তমান পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে এ অনুভূতি সর্বজনীন হয়ে উঠছে। তাই রাজকন্যার ছবি সেদিন আমার কাছে হয়ে উঠেছিলো পৃথিবীর সব বিপন্ন শিশুমনের প্রতিবাদের গান বা প্রতিবাদের উপাখ্যান। এই প্রতিযোগীতার পৃথিবীতে এই অহংকারের, এই আমিত্বের পৃথিবীতে যখন একটি শিশুমন  ভালোবাসা কি তা বুঝেই উঠতে পারছেনা। ভালোবাসার মানুষকে চিনতে পারছেনা, বিশ্বাস করতে পারছেনা । তার একাকীত্ব তাকে এতোটাই নিঃসঙ্গ করে তুলেছে যে ভালোবাসার মানুষও তার কাছে নিজেকে বিশ্বাসভাজন করে তুলতে পারছেনা। এই অবিশ্বাসী সময়ে দাঁড়িয়ে পৃথিবীর শিশুমনের নিঃসঙ্গতা, একাকিত্ব থেকে মুক্তির আর্তি আমি দেখেছিলাম ঐ কাঠের টেবিলের ওপর নীল কাপ বা ঐ হাতলভাঙা চেয়ারটার বা ঐ লালসাদা ঘটিহাতা ফ্রকের ছবির মধ্যে।

রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে অসিত হালদারের হাত ধরে এই চর্চা সূচনার সুফল আমরা আজোও শান্তিনিকেতন পাঠভবনের ছা্রছাত্রীরা তথাকথিত শিল্পী নাহয়েও অনুভব করি মর্মে মর্মে। তাই এই ভালোবাসাহীনতার পৃথিবীতে শিশুদের স্বাধীন চিত্রাঙ্কন চর্চা আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ । শিশুমন সাধারনত ভালোবাসতে চায় কিন্তু ভালোবাসার ভাষা সে শেখে পারিপার্শ্বিক পরিবেশ পরিবার পরিজনদের কাছ থেকে। সেই শেখা বা শেখানোর ভাষাটা আজ বড়ো আগ্রাসী বড়ো দূষিত হয়ে উঠেছে। আমরা বড়রা আসলে অনেক ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করতে পারি সে ভাষা সুরের ভাষা ছন্দের ভাষা, রাগের ভাষা অনুরাগের ভাষা, শাসনের ভাষা অপশাসনের ভাষা, পছন্দের ভাষা অপছন্দের ভাষা ইত্যাদি ইত্যাদি। শিশুমন আমার মনে হয় বিভিন্ন রঙে,বিভিন্ন রেখায়, বিভিন্ন মিডিয়ামে তার মনের বহুমুখী চিন্তার বৈচিত্র্যকে মৌলিকভাবে প্রকাশ করতে সক্ষম হয়। সেখানে রঙ, রেখা,মিডিয়াম তার কাছে বিভিন্ন ভাষার সমার্থক হয়ে ওঠে। তাই শিশু মন বিকাশের ক্ষেত্রে ও সমাজ মন বিকাশের ক্ষেত্রে এই শিশুমনের স্বাধীন চিত্রাঙ্কন চর্চার খুব প্রয়োজন। এর মধ্যে দিয়ে যে মন বন্দী সে তার ডানা খুঁজে পায়। যে মাছ ডাঙায় ছটফট করছে সে ঝুপুস করে লাফিয়ে বাঁচে জলে। মূক মুখর হয়ে ওঠে রঙ ও রেখার সচলতায়।