Dr. Aparna Ray

Professor, Department of Bengali, 

Bhasha Bhavana, Visva- Bharati.

Email: aparna.ray@visva-bharati.ac.in

উনিশ শতকে নারীশিক্ষার বিস্তারে শ্রীরামপুর মিশন ও হানা মার্শম্যান (১৮০০-১৮৫০)

 

উনিশ শতকের গোড়ার দিক। বাঙালি মেয়ের প্রথম আত্মজীবনী ‘আমার জীবন’-এ রাসসুন্দরী দেবী সেকালে মেয়েদের যাপিত জীবনকে ‘পিঞ্জরাবদ্ধ বিহঙ্গী’ এবং ‘কলুর চোখ ঢাকা বলদ’-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন। চার্লস গ্র্যান্ট তাঁর ‘Observations on the State of Society among the Asiatic Subjects to Great Britain particularly with respect to Morals; and on the means of improving it’ (1792)  রচনায় বাংলাদেশে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক বলেছেন; বলেছেন, মেয়েদের প্রতি ব্যবহারে হিন্দু সমাজের নির্মম নিষ্ঠুরতার কথা।১ অকল্যান্ড২ এবং কেরীর রচনাতেও৩ সমাজে পুরুষ আধিপত্য এবং স্ত্রী’র প্রতি স্বামীর দুর্ব্যবহারের কথা জানা যায়। বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ ও পরিণামে দাম্পত্যজীবনে ‘সম্পর্কহীনতা’র অভিশাপে অভিশপ্ত, সতীদাহের আগুনে নিরন্তর দগ্ধ সেই সমাজে ‘নারীশিক্ষা’ বিষয়টি ছিল বৈধব্য ও নৈতিক স্খলনের কারণ হিসেবে সর্বজননিন্দিত। শতক সূচনায় বাঙালি মেয়ের সামাজিক পরিসর ছিল ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’ এবং ‘পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা’— এই দুই বাক্যবন্ধে সীমায়িত। স্বভাবতই বিত্তবান কিছু পরিবারে অন্তঃপুরশিক্ষার প্রচলন থাকলেও, বাংলাদেশের বৃহত্তর নারীসমাজে ছিল অশিক্ষা ও কুসংস্কারের অন্ধকার। ভদ্রবাড়ির মেয়েরা প্রকাশ্য বিদ্যালয়ে পড়তে আসার কথা ভাবতেই পারত না। ক্রফোর্ড লক্ষ করেন, পেশাগত কারণে একমাত্র নাচওয়ালি ছাড়া অন্য মেয়েদের মধ্যে লেখাপড়ার চল বিশেষ ছিল না।৪ বিদ্যার সঙ্গে বিত্তউপার্জনের যোগসূত্রে যখন সাধারণ জনসমাজে ইংরেজি শিক্ষার ক্রমপ্রসার ঘটতে থাকে; ১৮১৩র কোম্পানি সনদে শিক্ষাখাতে লক্ষ টাকা ব্যয়ের কথা বলা হয়— তখনও কোথাও কিন্তু নারীশিক্ষার কথা সরকারীভাবে ভাবা হয় নি! উনিশ শতকের প্রথম কয়েক দশক। নারীর ‘শিক্ষা’ ছিল ‘অশুভ’ এবং গর্হিত সামাজিক ‘অপরাধ’। আর, এই ক্যানভাসে দাঁড়িয়েই শ্রীরামপুরে কেরী, মার্শম্যান ও ওয়ার্ডের নেতৃত্বে ব্যাপটিস্ট মিশন শুরু করেছিল তার কাজ। প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল শ্রীরামপুর মিশন। মুদ্রণযন্ত্রে ছাপা হয়েছিল বাংলা ভাষায় প্রথম সাময়িকপত্র— প্রথমে ‘সমাচারদর্পণ’ ও ক্রমে ‘দিগদর্শন’। বাইবেলের পাশাপাশি অনুবাদ করা হয়েছিল, ‘কৃত্তিবাসী রামায়ণ’। সেদিন দেশীয় ভাষায় শিক্ষাবিস্তারের জন্য শ্রীরামপুর মিশন প্রেস থেকে প্রকাশিত হয় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতদের লেখা নানা গ্রন্থ।


১৭৯২তে ব্যাপটিস্ট মিশনারী সোসাইটি তাদের প্রথম সার্কুলারে ঘোষণা করেছিল, “The object of the Society is to evangelize the poor, dark, idolatrous Heathen, by sending missionaries”।


তাই, শ্রীরামপুর মিশন প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবনাপর্বেই কেরী, মার্শম্যান, ওয়ার্ড সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, “We must converse with the natives almost every hour in the day; to go from village to village, from market to market, from one assembly to another, to talk to servants, laborers etc. as often as opportunity offers.”৫ অশিক্ষা ও কুসংস্কারের অন্ধকারে ডুবে থাকা সাধারণ জনজীবনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগসূত্রেই শ্রীরামপুরের মিশনারীরা দেশীয় জনগণের মধ্যে শিক্ষা-বিস্তারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তাঁদের কতকগুলি উদ্দেশ্য ছিল। প্রথমত: অজ্ঞানতা ও কুসংস্কার দূর করা এবং বিশ্বপ্রকৃতি সম্বন্ধে মানুষকে একটি স্পষ্ট ধারণা দেওয়া; দ্বিতীয়ত: প্রাত্যহিক জীবনে নৈতিক মূল্যবোধের সঞ্চার করা; তৃতীয়ত: খৃষ্টধর্মের প্রচার ও প্রসার ঘটানো। আমরা দেখি, ব্যাপটিস্ট মিশনারী সোসাইটির মূল সংবিধান অনুসারে স্কুলগুলি খৃষ্টধর্ম প্রচারের মাধ্যম হিসেবেই অনুমোদিত হয়েছিল। এক্ষেত্রে লন্ডন মিশনারী সোসাইটির মিশনারীরা যেখানে বিশ্বাস করতেন, “The influence of the Schools will hasten the fall of Hindooism”;৬ সেখানে শ্রীরামপুরের মিশনারীরা মনে করতেন, “… the introduction of the Bible as a class book would overturn the system of idolatry”.৭


মিশনারীরা হুগলী জেলায় অনেকগুলি প্রাথমিক বিদ্যালয় বা Elementary School প্রতিষ্ঠা করেন। মিশন পরিচালিত এই স্কুলগুলি ছিল পাঁচ ধরনের। এক. ইউরোপীয়ান ছেলে-মেয়েদের শিক্ষার জন্য একধরনের বোর্ডিংস্কুল— সেখানে, আর্থিক উপার্জন ও ভবিষ্যৎ মিশনারী তৈরির জন্য শিক্ষা দেওয়া হত; এই স্কুলগুলি বিশ্বাস করত, ‘a nursery for the church’; ৫০ থেকে ৬০ জন বালক বালিকা এখানে পড়াশুনো করত। দুই. নিম্নশ্রেণীর ও খৃষ্টধর্মে দীক্ষিত সাধারণ ছেলেমেয়েদের স্কুল। তিন. খৃষ্টধর্মে দীক্ষিত ভারতীয় বালক বালিকাদের জন্য পৃথক বোর্ডিংস্কুল, সেখানে হিন্দুদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। চার. রোমান ক্যাথলিক ছেলেমেয়েদের জন্য স্কুল, সেখানে অ-খৃষ্টান সম্প্রদায়ভুক্ত হিন্দুরাও যাতায়াত করত। পাঁচ. ধর্মশিক্ষার জন্য স্কুল।


বিদ্যালয় স্থাপন করলেও ১৮১৩ সাল পর্যন্ত সরকারী এবং মিশনারী শিক্ষানীতি সংক্রান্ত দ্বন্দ্বের জন্য শ্রীরামপুরের মিশনারীগণ ব্যাপকমাত্রায় শিক্ষার প্রসার ঘটাতে পারেন নি। ক্রমশঃ কোম্পানির সনদ ও পার্লামেন্টের অনুমোদন লাভ করলে জনশিক্ষার প্রসারে মিশন অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ভারতে শিক্ষা বিষয়ক তথ্যভিত্তিক প্রথম পরিকল্পনা হিসেবে প্রকাশিত হয় জোশুয়া মার্শম্যানের বিখ্যাত রচনা, ‘Hints relative to Native Schools Together with the outline of An Institution for their Extension and Management’ (1816). বলা হয়, “Instruction… should be such as to render the inhabitants of a country happy in their own sphere, but never to take them out of it”।৮


শিক্ষাদানের প্রথম উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়, ‘improving them in the knowledge of their own language’। ‘Hints’-এ প্রকাশিত পরিকল্পনা অনুসারে, ১৮১৬ খৃ. থেকে মিশন সারা বাংলা তথা হুগলী জেলার সিঙ্গুর, কোন্নগর, রিষড়া, বৈদ্যবাটি, শ্রীরামপুর ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে প্রায় ১২৬টি বিদ্যালয় স্থাপন করে। প্রায় দশ হাজার ছাত্র এখানে প্রাথমিক শিক্ষা ও খৃষ্টধর্মের অনুশাসন সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করেছিল। ১৮১৬-১৭র কাছাকাছি সময়ে হুগলী জেলায় (শ্রীরামপুর সমেত) বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ৫৪টি; ছাত্র সংখ্যা ছিল ৩,৬৮৪ জন।৯


প্রতিষ্ঠাপর্ব থেকেই শ্রীরামপুর মিশনের কর্মসূচিতে নারীশিক্ষার বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিল। Serampore Compact-এ বলা হয়েছিল, “We place the highest value and esteem upon the important role of the women in our mission calling. They have a vital role in ministering to the native women here just as women played an important part in the apostolic area. The Asiatic women are mostly shut up from the men, and especially from men of another caste. So we must give our Europian sisters all possible help in acquiring the language, that they may become instrumental in promoting the salvation of the millions of native women…”১০


মিশনারীরা ভেবেছিলেন, “… a native Christian mother must at least, be qualified to teach her children to read the Bible, and that female ignorance and Christianity could not exist together”.১১ কুসংস্কারাচ্ছন্ন, অশিক্ষিত দেশীয় জনসাধারণের মধ্যে মূল্যবোধের শিক্ষা ও জীবনযাপনে রুচিসম্মত পরিশীলন নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন মিশনারীরা। আর সেই সূত্রেই পারিবারিক শিক্ষা তথা স্ত্রীশিক্ষার বিষয়ে তাঁরা মনোযোগী হয়ে ওঠেন। জন ক্লার্ক মার্শম্যান এই দায়িত্ব গ্রহণ করলে ভারতবর্ষে নারীশিক্ষার নতুন অধ্যায় শুরু হয়। পুরোভাগে এসে দাঁড়ান হানা মার্শম্যান— ‘The first women Missionary in India’. কুসংস্কারাচ্ছন্ন দেশীয় সমাজের প্রবল বিরোধিতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর দুঃসাহস নিয়ে শুরু হয় তাঁর অভিযাত্রা।


শুরু থেকেই শ্রীরামপুর মিশনের নানা কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন হানা মার্শম্যান। ব্যক্তিগত পরিচয়ে জোশুয়া মার্শম্যানের স্ত্রী হলেও, হানা ছিলেন শিক্ষাবিদ; শিক্ষকতা ছিল তাঁর দীর্ঘদিনের পেশা। শ্রীরামপুরে ইউরোপীয়ান ছেলেমেয়েদের জন্য সবেতন বোর্ডিংস্কুল পরিচালনার পিছনে নিশ্চিতভাবে শিক্ষক হিসেবে হানার পূর্ব-অভিজ্ঞতার বিশেষ ভূমিকা ছিল। একইভাবে তিনি দেশীয়, নিম্নশ্রেণীর ছেলেদের জন্য তৈরি অবৈতনিক স্কুলের সঙ্গেও জড়িয়ে ছিলেন। মিশনারী পরিচালিত স্কুলগুলির বিরুদ্ধে ধর্মান্তরীকরণের অভিযোগ তীব্র হলে, হানা ব্যক্তিগতভাবে প্রতিটি ছাত্রের বাড়িতে গিয়ে বুঝিয়ে এসেছিলেন— ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাউকে খৃষ্টধর্মে দীক্ষা দেওয়া হবে না। কেরী, মার্শম্যান, ওয়ার্ডের সঙ্গে দেশীয় জনসাধারণের নিবিড় যোগাযোগ থাকলেও দরিদ্র, মূর্খ বাঙালির অন্দরমহলের সঙ্গে হানার ছিল ঘনিষ্ঠ পরিচয়। শ্রীরামপুরে আসার মুহূর্ত থেকেই তিনি এদেশের অজ্ঞ মা ও মেয়েদের শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু সামাজিক প্রতিবন্ধকতায় বার বার এই তাঁর এই প্রয়াস বাধাপ্রাপ্ত হয়। মনে রাখতে হবে, এই সেই সময়, যখন কেরীর নেতৃত্বে ব্যাপটিস্ট মিশনারী-সমীক্ষায় ধরা পড়েছিল বাংলাদেশে সতীদাহের নির্মম পরিসংখ্যান। দেখা যায়, ১৮০৩-এ কলকাতা সন্নিহিত এলাকায় যেখানে সতীদাহ হয়েছিল ২৭৫টি;  সেখানে ১৮১৮তে তা ক্রমশঃ  বেড়ে হয় ৫৪৪টি।  উচ্চবিত্ত  ও  নিম্নবিত্ত পরিবারে নারীদের জীবন্মৃত অবস্থা টের পাওয়া যায় ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নববাবুবিলাসে’। কবিগানে ধরা দিয়েছিল সেকালে নারীর দীর্ঘশ্বাস— ‘নারীর জনম কেবল যন্ত্রণা সহিতে’। বাংলাদেশে মেয়েদের এই অসহায়তা হানা অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করেন। তিনিও বিশ্বাস করতেন, “… knowledge may remove prejudices and originate a superior correctness both of ideas and of conduct, which may be off the highest advantage to the Society”.১২ তাই হানা মার্শম্যান— প্রথম মহিলা, যিনি ভারতীয় নারীদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদানের কথা ভাবেন। ‘সমাচারদর্পণ’ পত্রিকা থেকে জানা যায়, ‘হানা হাউসে’ (শ্রীরামপুর) তিনি ৮৪ জন ছাত্রী নিয়ে একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। পত্রিকায় প্রতিষ্ঠাকাল ১৮০৭ বলা হলেও, স্কুলটির ফলকে দেখা যায়, সেটি  ১৮১৮তে স্থাপিত। আবার, ফুলারকে লেখা জোশুয়া মার্শম্যানের একটি চিঠিতে দেখি, ১৮১১ খৃ. অব্দে শ্রীরামপুরের পর্তুগীজ মেয়েদের জন্য একটি মিশন স্কুল খোলা হয়েছিল। বামাবোধিনী পত্রিকায় সেটিকেই প্রথম বালিকা বিদ্যালয় বলা হয়। এ বিষয়ে নানা বিতর্ক থাকলেও নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ১৮১৬-১৭ সালে মিশনারীরা ছেলেদের স্কুলের একাংশ পর্দা দিয়ে আড়াল করে মেয়েদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন। অ্যাডাম সাহেব অবশ্য তাঁর এডুকেশন রিপোর্টে (১৮৩৫) বাংলাদেশে প্রকাশ্য ও স্বতন্ত্র বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব লন্ডন মিশনারী সোসাইটির সদস্য রেভারন্ড রবার্ট মে-কেই দিয়েছেন। মে-সাহেব হানার সমকালেই, ১৮১৮তে চুঁচুড়ায় ১৪ জন ছাত্রী নিয়ে স্কুল শুরু করেছিলেন— সেখানে বালিকা ও প্রাপ্তবয়স্ক নারী— দুই-ই পড়াশুনো করত। তবে এটি বেশিদিন চলে নি; ঐ বছরেই মে-সাহেবের মৃত্যুর পর কোম্পানি সরকার স্কুল বন্ধ করে দেয়।


১৮২০ থেকে ১৮২২— হানা গিয়েছিলেন ইংল্যান্ডে। তখন মিশনারীদের কার্যকলাপ নিয়ে শ্রীরামপুর মিশন এবং লন্ডনে ব্যাপটিস্ট মিশনারী সোসাইটির দ্বন্দ্ব চরমে। সমাধানসূত্র খুঁজতে ১৮২০-১৮২৯ কালপর্বে শ্রীরামপুরের মিশনারীরা প্রত্যেকই বিভিন্ন সময়ে ইংল্যান্ড যেতে বাধ্য হন। ততদিনে শ্রীরামপুরে কলেজ (১৮১৭) ও কলকাতায় হিন্দু কলেজের প্রতিষ্ঠা হয়ে গেছে (১৮১৮); সমাজসংস্কারক হিসেবে বাংলাদেশে রামমোহন রায়ের আবির্ভাব ঘটেছে; সরকারি সাহায্যের অপেক্ষায় না থেকে খৃষ্টিয় সংঘের মহিলারা ব্যক্তিগত উদ্যোগে নারীশিক্ষা বিস্তারের কাজে এগিয়ে এসেছেন— মাতৃভাষার মাধ্যমে মেয়েদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটানোর জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ফিমেল জুভেনাইল সোসাইটি (১৮১৯)। বলা বহুল্য, হানা মার্শম্যানের উদ্যোগ ও নিষ্ঠা সেদিন বাংলাদেশে স্ত্রীশিক্ষার এই চর্চায় নিশ্চিতভাবে প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল। বিদেশে থাকার সময়, ১৮২১-এ ওয়ার্ড ভারতীয় নারীদের মধ্যে শিক্ষার প্রচলনের সপক্ষে ইংল্যান্ডবাসীদের সমর্থন চেয়ে বলেছিলেন, “School must be commenced; knowledge must be communicated; and then the Hindu female will be behind none of her sex in mental elevation to which the highest rank of the British females have attended.” এই আবেদন সেদিন দেশ-বিদেশে নানাভাবে নিন্দিত ও সমালোচিত হয়। তখন স্বয়ং জোশুয়া মার্শম্যান ‘Friend of India’-তে বঙ্গীয় নারীর জীবন বিষয়ে মিশনারীদের নানা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বিবরণ দিয়ে ওয়ার্ডকে সমর্থন করেন। ভারতীয় নারীদের ভয়াবহ দুরাবস্থা প্রকট হয় প্রতীচ্যের চোখে। শিক্ষিত ইংরেজ সমাজে, বিশেষতঃ নারীসমাজে তৈরি হয়েছিল প্রবল আলোড়ন। এরপর বিপুল জনসমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতার প্রতিশ্রুতি নিয়ে ভারতবর্ষে ফিরে এসেছিলেন ওয়ার্ড ও হানা। শুরু হয়েছিল শ্রীরামপুর ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলে মেয়েদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরির সংগঠিত পরিকল্পনা। কিন্তু ১৮২৩ সালে ওয়ার্ডের আকস্মিক মৃত্যু হয়। তখন নারীশিক্ষার বিপুল কর্মভার নিজের কাঁধে তুলে নেন স্বয়ং হানা মার্শম্যান। আর, এই দায়িত্ব তিনি আজীবন বহন করেছিলেন।


কী কী ঘটেছিল সেদিন? ১৮২৪-এর মধ্যে শ্রীরামপুর ও সন্নিহিত অঞ্চলে অন্ততঃ ১২টি মেয়েদের স্কুল খোলা হয়। প্রতিটি দেশজ স্কুলের বিলিতি নামকরণ নিশ্চিতভাবে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত স্কুলের সঙ্গে তাদের সংযোগ ও প্রচ্ছন্ন সমর্থনকেই তুলে ধরে। যেমন, বল্লভপুরের স্কুলটির নাম ছিল ‘চ্যাটহাম ইউনিয়ান’; ঢুলিপাড়ায় ‘উইলিয়াম স্কুল’; মালোপাড়ায় ‘রস স্কুল’; মাহেশের দুটি স্কুল ‘চ্যাটহাম স্কুল’ ও ‘গ্লাসগো স্কুল’; রিষড়ায় ‘স্টারলিং স্কুল’ ও ‘ডানফার্মলিন স্কুল’; নবগ্রামে ‘এডিনবরা স্কুল’ ইত্যাদি। এইসব স্কুলে প্রায় ২৫০ জন মেয়ে পড়াশুনো করত। এছাড়াও শ্রীরামপুর মিশনারীরা শুধু মুসলিম মেয়েদের জন্যই পাঁচটি স্কুল খুলেছিলেন— সিউড়ি স্কুল, তিলপাড়া স্কুল, তেহেরা স্কুল, অন্নদাপুর স্কুল ও হাসনাবাদ স্কুল। ৩৪টি মেয়ে পড়ত এইসব স্কুলে।  হুগলী ও  বীরভূমের  বাইরে  ঢাকা, চট্টগ্রাম,  যশোর,  বেনারস, এলাহাবাদেও মিশনারীরা বেশ কিছু বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। দেখা যায়, শ্রীমতী চালর্স লেনার্ডের পরিচালনায় ঢাকাতে ‘দ্য খ্রিস্টান ফিমেল স্কুল’ প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই সূত্রেই লেনার্ড জানান, ৩০ জন ছাত্রী নিয়ে শ্রীরামপুর মিশনারীরা ‘নারানদিয়া স্কুল’ ও চট্টগ্রামে ৫০ জন ছাত্রী নিয়ে ‘মুদ্দারবাড়ি’ স্কুল চালাতেন। মেয়েরা সেখানে বই পড়তে ও বানান করতে শিখেছিল। প্রথম শ্রেণীতে পড়ানো হত যীশুখৃস্টের বাণী; দ্বিতীয় শ্রেণীতে নীতিকথা; তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীতে বানান ও হাতের লেখা। বই-কাগজসহ পড়াশুনোর সব সরঞ্জামই দেওয়া হত স্কুল থেকে। ইতিহাস, ভূগোল ও অঙ্কের প্রাথমিক জ্ঞানের পাশাপাশি বাংলা ও ইংরেজি ভাষাশিক্ষার উপর জোর দিয়েছিলেন মিশনারীরা। আবার, ‘মা ও মেয়ের কথোপকথনে’র মতো বিষয়সূত্রে তাদের দেওয়া হত বাস্তব সাংসারিক সামাজিক জ্ঞান। পাশাপাশি সূচিশিল্প, এমব্রয়ডারির মতো নানা হাতের কাজ শেখানো হত মেয়েদের। তবে খৃষ্টিয় ধর্মগ্রন্থপাঠ ছিল মিশনারী পরিচালিত এই শিক্ষাপ্রকল্পে নিয়মিত ও বাধ্যতামূলক। আর এই সূত্রেই স্কুলগুলির সঙ্গে সাধারণ শিক্ষিত ও বাঙালি পরিবারের অনিবার্য দ্বন্দ্ব ও দূরত্ব তৈরি হয়েছিল!


১৮২৪ খৃ.-এর ১০ এপ্রিল, ‘সমাচার দর্পণে’ প্রকাশিত একটি সংবাদ থেকে আমরা জানতে পারি, শ্রীরামপুর-সন্নিহিত বিভিন্ন অঞ্চলে মিশনারী-চালিত ১৩টি স্কুল থেকে প্রায় ২৩০ জন ছাত্রী, ৫ এপ্রিল, ১৮২৪, সোমবারে, বাবু শ্রী গোপাল মল্লিকের বাড়িতে দিবা ১০ ঘটিকায় প্রাথমিক বিদ্যার পরীক্ষা দিতে উপস্থিত হয়। বহু সাহেব ও মেমসাহেব সেদিন ওখানে উপস্থিত ছিলেন। ৫০টি মেয়ে বানানসহ বই পড়তে পেরেছিল, ৩৫ জন কবিতা আবৃত্তি করেছিল, বাকিরা সকলেই বহুশব্দের সঠিক বানান লিখতে সক্ষম হয়। দু ঘণ্টা চলেছিল পরীক্ষা। শেষে সন্তুষ্ট ও আনন্দিত হান মার্শম্যান পরীক্ষার্থীদের উৎসাহ দিতে নতুন কাপড়, ছবি ও পারিতোষিক হিসেবে অর্থ বিতরণ করেন। মিষ্টি দেওয়া হয় সকলকে। শুধু তাই নয়; স্কুলের মেয়েদের তৈরি নানা কারুশিল্পও সেদিন প্রদর্শিত হয়েছিল। ১৮২৫ সালে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে হয়েছিল প্রায় ৩০০ জন— পরীক্ষা হয়েছিল শ্রীরামপুর কলেজের হলে।


কিন্তু কারা ছিল এইসব ছাত্রী? সেদিন তো কেবলমাত্র নীচজাতীয় এবং সর্বজনগমা নারীরাই ঘরের বাইরে বের হত! আমরা দেখি, মিশনারী পরিচালিত বালিকা বিদ্যালয়গুলির অধিকাংশই ছিল অবৈতনিক। পড়াশুনোর সমস্ত উপকরণও দেওয়া হত স্কুল থেকে। বুঝতে অসুবিধা হয় না, নিম্নবিত্ত ও অনগ্রসর শ্রেণীর মেয়েরা অর্থনৈতিক সাহায্য লাভের প্রত্যাশায় মিশনারীদের স্কুলে যোগ দিত। কেননা, জাতিধর্মনির্বিশেষে সমস্ত মেয়েদের পড়াশুনোর পরিসর ছিল এইসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। সম্ভবতঃ পারিতোষিকরূপ আর্থিক প্রলোভনই সেদিন শিক্ষাবিষয়ে নিম্নবিত্ত বাঙালি মেয়েদের আগ্রহী করে তুলেছিল।


উনিশ শতকের তিনদশকের মাঝামাঝি সময় থেকে শ্রীরামপুর মিশন পরিচালিত বালিকা স্কুলগুলি একে একে বন্ধ হতে থাকে। ১৮৩৪-এ কেরী, ১৮৩৭-এ জোশুয়া মার্শম্যানের মৃত্যু মিশনের অপূরণীয় ক্ষতি করে। নিয়মিত সরকারী অনুদান ও বেসরকারী পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে বালিকা বিদ্যালয় পরিচালনা সমস্যাসংকুল হয়ে ওঠে। একদিকে তীব্র অর্থাভাব, যোগ্য শিক্ষকের অপ্রতুলতা; অন্যদিকে ছাত্রীদের অকাল বিবাহ, হানার বার্ধক্যজনিত অসহায়তা— সব মিলেমিশে নারীশিক্ষার প্রসারে শ্রীরামপুর মিশনের প্রাণবান উদ্যোগ ক্রমশঃ স্তিমিত হতে থাকে। শ্রীরামপুর মিশনের সঙ্গে ব্যাপটিস্ট মিশনের ক্রমদূরত্বেও মিশনের সেবামূলক কাজকর্মের স্বাভাবিকতা বিনষ্ট হয়। নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করতে করতে শিক্ষাবিদ হানা মার্শম্যান ১৮৪৭ সালে মারা যান।


ততদিনে বাংলাদেশে নারীশিক্ষার চালচিত্রে দেখা দিয়েছে পরিবর্তন। সরকারী শিক্ষানীতির বদল ও স্ত্রীশিক্ষার সমর্থনে রাধাকান্ত দেব, গৌরমোহন বিদ্যালঙ্কার, জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের মতো অভিজাত, ক্ষমতাবান, শিক্ষিত মানুষদের পৃষ্ঠপোষকতায় শুরু হয়েছিল শিক্ষার মাধ্যমে বাঙালি ‘ভদ্রমহিলা’ নির্মাণের নানা প্রকল্প। অন্তঃপুর শিক্ষার পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল নারীর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। ১৮৪৯-এ প্রতিষ্ঠিত হয় বেথুন সাহেবের Calcutta Female School. ১৮৫৬তে যার Prospectus-এ লিখে দেওয়া হয়, “শুধুমাত্র ভদ্রঘরের মেয়েরাই এখানে শিক্ষালাভের অধিকারী”।


অথচ,  হানা  মার্শম্যান  সহ  শ্রীরামপুরের   মিশনারীরা  সকলেই   চেয়েছিল  জাতি-ধর্ম-বর্ণ-বর্গ-নির্বিশেষে   সর্বস্তরের মেয়েদের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষার প্রসার ঘটাতে। অর্থসংকট তো চিরকালই মিশনের নিত্যসঙ্গী ছিল! তবু অবৈতনিক শিক্ষা প্রচলন ও অর্থসাহায্যের দ্বারা তাঁরা দরিদ্র, অনগ্রসর শ্রেণীর মেয়েদের শিক্ষার পরিসরে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন। ভাষাশিক্ষার দ্বারা মিশনারীরা মেয়েদের নিজের কথা নিজের মুখে বলার সাহস দিতে চেয়েছিলেন; ধর্মশিক্ষার দ্বারা মূল্যবোধ; আর হস্তশিল্পচর্চার দ্বারা তাঁরা নিম্নবিত্ত বাঙালির পারিবারিক জীবনে রুচির শিক্ষা ও মেয়েদের জীবনে স্বাবলম্বনের পথ নির্দেশ করেন। পরবর্তীকালে বঙ্গীয় নারীশিক্ষার প্রতিষ্ঠাপর্বে বেথুন স্কুলসহ ব্রাহ্মবালিকা বিদ্যালয়গুলিও এই পাঠক্রমের গুরুত্ব স্বীকার ও অনুসরণ করেছিল। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের ক্ষেত্রেও শ্রীরামপুর মিশন ছিল পথিকৃৎ। আমরা দেখি, বেথুন স্কুল পরবর্তী পর্বে বাংলাদেশে স্ত্রীশিক্ষা বিষয়টি ক্রমশঃ কলকাতা-শহরকেন্দ্রিক, নাগরিক পরিবেশে সীমায়িত হয়ে পড়ে। আধুনিক বাঙালি নারীর জীবনে ‘শিক্ষা’ ও ‘স্বাধীনতা’ শব্দদুটি পরিবারের শিক্ষিত উদারমনস্ক পুরুষদের দেওয়া ‘উপহার’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। অথচ শতকসূচনায়, যখন পুত্রজন্মে বাঙালির ঘরে শঙ্খ বাজলেও কন্যাজন্মে ছিল না শাঁখের আওয়াজ, তখন অজস্র প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করে ‘স্ত্রীশিক্ষা’ প্রবর্তনের প্রবল দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন হানা মার্শম্যান ও শ্রীরামপুর মিশন। সামাজিক মর্যাদাহীন নারীদের জীবনে ‘শিক্ষা’কে তাঁরা ‘অধিকার’ হিসেবে নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন; ‘উপহার’ হিসেবে ‘দান’ করতে চান নি। প্রগতির অভিমুখে বাঙালি নারীর পথচলায় হানা মার্শম্যানের তথা শ্রীরামপুর মিশনারীদের এই অবদান আজও যথাযথ মূল্যায়নের অপেক্ষায়। একে বাদ দিয়ে বঙ্গনারীর আধুনিক হয়ে ওঠার ইতিহাস-পাঠ কখনো সম্পূর্ণ হতে পারে না!



তথ্যসূত্র :

১. Parliamentary Papers, House of Commons, 1812-13, Vol. X, p. 29


২. Rev. T. Acland, A Popular Account of the Manners and Customs of India, London Press, 1847, p. 20


৩. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় (সম্পা.), পুরাতন গদ্যগ্রন্থ সংকলন (প্রথম খণ্ড), মিত্র ও ঘোষ, কলকাতা, ১৯৭৮, পৃ. ১৬৭


৪. Q. Cranfurd, Sketches Chiefly relating to the History, Religion, Learning and Manner of the Hindoos, Vol. II, London Press, 1792, p. 47


৫. The Serampore Compact (1805) in Glimpses, Journal of the Christian History Institute, Issue 109, para 1


৬. K. P. Sengupta, The Christan Missionaries in Bengal (1793-1833), Firmal KLM, 1971, p. 97


৭. তদেব, পৃ. ৯৮


৮. Carey, Marshman, Ward, Hints Relative to Native Schools, together with the Outline of an Institution for their Extension and Management the Mission Press: Institution for the Encouragement of Native Schools in India, 1816


৯. সুনীল কুমার চ্যাটার্জ্জী, বাংলার নবজাগরণে উইলিয়াম কেরী ও তাঁর পরিজন, রত্না প্রকাশন, ১৯৭৪, পৃ. ১২


১০. The Serampore Compact (1805), para 7


১১. Marshman, J. C., The Life and times of Carey, Marshman and Ward, Serampore Council of Serampore College, 2005, p. 303


১২. Serampore Mission, 1st Report of Native Schools, 1817, p. 41