নমস্কার শ্রোতাবন্ধুরা, "গল্প-কথার আসর"-এর আজকের বৈঠকে যোগদান করার জন্য অজস্র ধন্যবাদ । আমি রুদ্র দত্ত । আজ পাঠ করবো মনোরঞ্জন ভ্ট্টাচার্যের লেখা গোয়েন্দা হুকাকাশির একটি গল্প । মনোরঞ্জন ভ্ট্টাচার্যের লেখা এই পডকাস্টে এর আগে পড়িনি, তাই পাঠ আরম্ভ করার আগে তাঁর সম্বন্ধে কয়েকটি কথা বলে নিই ।
মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯০৩ সালে । ছোটো থেকেই মেধাবী ছাত্র; স্কুলে থাকতেই কলকাতার সংস্কৃত কলেজ আয়োজি বিতর্ক সভায় শুধু অংশগ্রহণই করেননি, জয়লাভ করেছিলেন । প্রেসিডেন্সি কলেজে অর্থনীতির ছাত্র ছিলেন, ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে পাশ করেন । বাকি জীবনটা অধ্যাপনা করেন - রিপন কলেজে । স্বল্পায়ু ছিলেন, মারা যান ১৯৩৯ সালে ।
তখনকার দিনে উচ্চশিক্ষিত মানুষ মাত্রেই অন্ততঃ অল্প কিছু লেখার চেষ্টা করতেন; ছাপানোর তাগিদে নয়, প্রবন্ধ-পাঠ বা রচনা, ইতিহাস এবং শাস্ত্র পাঠ, শিক্ষিত মানুষের আজীবন সারস্বত-সাধনার স্বাভাবিক অংশ বলেই মনে করা হতো । তার মধ্যে বেশীরভাগই অবশ্য আত্মীয়-বন্ধু বা পরিবারের গোচরেই থাকতো । যাঁদের বিশেষ অন্তরের তাগিদ ছিলো না, তাঁরা ছাপাখানার থেকে দূরেই থাকতেন । মনোরঞ্জনের সাহিত্য সৃষ্টি, যতদূর বুঝতে পারি, নিজের চেয়ে পত্রিকার প্রয়োজনেই আরম্ভ হয়েছিলো ।
পত্রিকার নাম "রামধনু" । পত্রিকাটি প্রতিষ্ঠাপন করেন মনোরঞ্জনের বাবা, বিশ্বেশ্বর ভট্টাচার্য । নিজেই সম্পাদনা করতে আরম্ভ করেন, তৃতীয় বর্ষ থেকেই সম্পাদনার ভার অর্পিত হয় মনোরঞ্জনের হাতে । "রামধনু" পত্রিকা বাংলা সাহিত্যে ছোটোদের জন্য সম্পাদিত মণিরত্নের একটি । উপেন্দ্রকিশোর রায় প্রতিষ্ঠিত "সন্দেশ" পত্রিকা সম্ভবতঃ বাংলায় একচেটিয়াভাবে ছোটোদের জন্য প্রকাশিত প্রথম পত্রিকা, যাতে উপেন্দ্রকিশোর ছোটোদের চিত্তবিনোদন, শিক্ষা, ও সার্বিক উন্নতির কথা ভেবে গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, অনেক বিচিত্রময় রচনার সম্ভার রেখেছিলেন । এই পত্রিকা ১৯১৩ সালে জন্মলাভ করে, কিন্তু দুঃখের বিষয় উপেন্দ্রকিশোর এবং তার পর সুকুমার রায়ের অকালমৃত্যু, এবং আর্থিক সমস্যার ফলে ১৯২৫ সালে বন্ধ হয়ে যায় । মাঝখানে কয়েকবছরের জন্য আবার প্রকাশের চেষ্টা সত্তেও, ১৯৬১ সালে সত্যজিৎ রায় এবং লীলা মজুমদারের নেতৃত্বে আবার প্রকাশের আগে "সন্দেশ" নীরব ছিলো । "সন্দেশ" প্রকাশ বন্ধ হবার দু বছর বাদে, ১৯২৭ সালে, "রামধনু"-র প্রথম প্রকাশ - অনুমান করি অনেকটা সন্দেশেরই আদলে । যতদূর জানি, তারপর প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে "রামধনু" অব্যাহত ভাবে প্রকাশ হয়েছে । "রামধনু" পত্রিকার অনেক ভক্ত পাঠকের মধ্যে শুধু ছোটোরা নয়, অনেক বিখ্যাত বড়রাও ছিলেন, যেমন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, শিবরাম চক্রবর্তী, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সত্যজিৎ রায় । এঁদের অনেকেরই লেখা পরে "রামধনু"-তে ছাপাও হয়েছে । শিবরাম চক্রবর্তীর মর্মস্পর্শী, সুমধুর উপন্যাস "বাড়ী থেকে পালিয়ে" "রামধনু"-তেই প্রথম প্রকাশ পায় - প্রেমেন্দ্র মিত্রের বিজ্ঞানভিত্তিক উপন্যাস "পিঁপড়ে-পুরাণ"-ও তাই ।
১৯৩০ থেকে আরম্ভ করে মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য এই পত্রিকার সম্পাদনা করেন দশ বছরের কিছু কম সময় ধরে - ১৯৩৮ সালে, মাত্র ৩৬ বছর বয়সে, মারা যান মনোরঞ্জন । প্রসঙ্গতঃ, এর পোনেরো বছর আগে, ঠিক একই বয়সে প্রয়াণ করেছিলেন সুকুমার রায় ।
মনোরঞ্জন অল্পই লিখে গেছেন, এবং তার বেশীরভাগই "রামধনু"-তেই প্রকাশ পেয়েছে । অনুমান করি, পত্রিকা চালানোর তাগিদেই তাঁর লেখা, এবং পত্রিকা সম্পাদনার কাজেই তাঁর সময় ও শক্তি প্রধানতঃ খরচ করেছেন - লেখার কাজে কম । কিন্তু লেখার ভাষা অত্যন্ত সাবলীল - পরের যুগের অনেক পেশাদারী লেখকের লেখাও এত স্বচ্ছ ও সুন্দর নয় । গল্প, উপন্যাস, নাটক, কবিতা, সবই কিছু কিছু লিখেছেন । আজ পাঠ করতে চলেছি তাঁর একটি গোয়েন্দা গল্প । মনোরঞ্জন-সৃষ্ট গোয়েন্দা কলকাতা-বাসী এবং বাংলা-ভাষী হলেও, তিনি কিন্তু আদতে জাপানী - নাম হুনুর হুকাকাশি । গোয়েন্দা গল্প বলতে আমরা যা বুঝি, তার মধ্যে যা কিছুটা অ্যাডভেঞ্চার-ধর্মী, তখনকার দিনে তাই বেশী বোঝাতো । গোয়েন্দা বা রহস্য গল্পে প্রধানতঃ বুদ্ধির প্রয়োগ, বা এমন গোয়েন্দা যিনি অ্যাকশান হিরোর থেকে বেশী সেরিব্র্যাল হিরো, ততটা দেখা যেতো না । মনোরঞ্জনের হুকাকাশি কিন্তু সেই পর্যায়েই পড়েন । অনেকে এজন্য মনোরঞ্জনকে বাংলায় বুদ্ধিমূলক গোয়েন্দা কাহিনীর জনক মনে করেন । প্রায় একই সময়ে জয়ন্ত-মাণিককে নিয়ে বুদ্ধিমূলক গোয়েন্দা কাহিনী লিখছিলেন হেমেন্দ্রকুমার রায়ও - দুজনকেই সম্মান না করার কোনো কারণই নেই ।
মনোরঞ্জন তাঁর গোয়েন্দাকে কেন জাপানী করলেন তা সঠিক সিদ্ধান্ত করা হয়তো সম্ভব নয় । একটা গল্প আছে যে এই অনুপ্রাস-সম্বলিত নামটি ছোটোদের মজা দেবে এই ভেবেই নামকরণ, আর নামের দায়ে বাধ্য হয়ে গোয়েন্দার জাতি নির্ণয় । এতে কিছুটা সত্য থাকতেই পারে, কিন্তু এটাও মনে হয় যে এইটুকুই হয়তো সব নয় । তখনকার চালু উত্তেজক গোয়েন্দা অ্যাডভেঞ্চার-কাহিনীর থেকে তাঁর গোয়েন্দাকে একটু সরিয়ে আনাটাও হয়তো একটা উদ্দেশ্য । তখন দেশে খুব ন্যায়সঙ্গত ভাবেই ব্রিটিশ-বিরোধিতার ঢেউ; তাই কোনো পাশ্চাত্য ধারার থেকে উল্টো পথে হেঁটে প্রাচ্যের অথচ ক্ষমতাশালী কোনো সাম্রাজ্যের ছায়া গল্পের মধ্যে পরোক্ষভাবে আনতে চাওয়াও হয়তো স্বাভাবিক ছিলো ।
উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, গল্পগুলি যে মনোগ্রাহী সে বিষয়ে সন্দেহ নেই । আর শেষ বিচার তো অবশ্যই পাঠক বা শ্রোতার মনে । তাই এবারে আরম্ভ করছি আজকের পাঠ, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের ডিটেকটিভ হুকাকাশির গল্প, "হীরক-রহস্য" ।