নমস্কার শ্রোতাবন্ধুরা, "গল্প-কথার আসর"-এর আজকের বৈঠকে যোগদান করার জন্য অশেষ ধন্যবাদ । আমি রুদ্র দত্ত ।
এই আসরে বন্ধুবর রাজীব আর আমি বিভিন্ন স্বাদের, বিভিন্ন মেজাজের গল্প পড়ার চেষ্টা করছি । আজকে একগুচ্ছ গল্পের প্রথমটি পাঠ করবো, যেগুলির মেজাজ অনন্যসাধারণ - সৈয়দ মুজতবা আলীর কিছু রম্যরচনা, যা "চাচা-কাহিনী" নামক গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে ।
চাচা-কাহিনীর গল্পগুলি একাধারে রম্যরচনা, স্মৃতিচারণের দিনপঞ্জিকা, ভ্রমণকাহিনী; ঐতিহাসিক দর্পণ, সামাজিক সমালোচনা, মানবিক চেতনাদর্শন । বাংলা সাহিত্যে ঠিক এইরকমটি লেখা আর খুব বেশী হয়নি বোধহয় । আশ্চর্য নয়, কারণ মুজতবা আলী নিজেও ছিলেন অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব । প্রথম বঙ্গভঙ্গ-এর ঠিক প্রাক্কালে তাঁর জন্ম সিলেট অঞ্চলে । স্কুলে পড়ার সময় থেকে আরম্ভ করে সারা জীবন তাঁর মেধা, তাঁর বৈদগ্ধ্য, তাঁর হাসিখুশি সরস ব্যক্তিত্ব, আর তাঁর স্বচ্ছল বাঙ্ময় লেখার ভাষা, যাদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে সবাইকে মুগ্ধ করেছে । ছোটোবেলা থেকেই স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গধন্য, বিজ্ঞ অথচ সহজ মানুষটির সত্যিই যেন বসুধৈব কুটুম্ববকম ছিলো । শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা, বিশ্বভারতীর একদম প্রথম যুগের স্নাতক, তারপর আলীগড় মুসলিম য়ুনিভার্সিটি, সেখান থেকে কাবুলে অধ্যাপনা । তারপর হুমবোল্ট্ স্কলারশিপ নিয়ে বার্লিন আর তার পর বন্-এ পড়াশোনা, বন্ থেকে ডক্টরেট । সেখান থেকে কায়রো, তারপর দেশে ফিরে বরোদায় অধ্যাপনা । তারপরই ভারত স্বাধীন হলো - আবার ভেঙে গেলো বাংলা । কিন্তু তাতে মুজতবা আলী যেন স্বীকৃতিই দিলেন না । পূর্ব পাকিস্তানে থাকলেন কিছুদিন, তার পরে কলকাতা । ভারতীয় সাংস্কৃতিক সম্বন্ধ পরিষদে কাজ করলেন, তারপর অল ইন্ডিয়া রেডিওর হয়ে দিল্লী, কটক, পাটনা । ফিরে এলেন বিশ্বভারতীতে অধ্যাপনা করতে - আট বছর পরে অবসর গ্রহণ করলেন - প্রথমে কলকাতায়, আর জীবনের শেষ কয়েকটি বছর নব্যসৃস্ট বাংলাদেশে । যতদূর বুঝতে পারি, আনন্দময় পুরুষ ছিলেন - হিন্দু-মুসলমান দুই সমাজেরই সংকীর্ণমনা লোকেদের দিকে থেকে বিশ্রী অভিযোগ, গালাগালি, দুর্ব্যবহার, বারবার পেতে হয়েছে, কিন্তু মুজতবার চোখে বিশ্বের আলো - পরিহাসের হাসি হেসে সেসব অতিক্রম করেছেন । তাঁর লেখাতেও সেই পরিচয়ই পাই ।
"চাচা-কাহিনী" যখন আমার হাতে আসে, তখন আমি সদ্যকিশোর, পৃথিবী সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা কিছুই নেই । কিন্তু যেটুকু ইতিহাস-ভূগোলের মধ্যে দিয়ে পরিচয়, তাতেই বুঝতে পেরেছিলাম মনোরম গল্পের মধ্যে দিয়ে কি আশ্চর্য বিশ্বমানবের পরিচয় পাচ্ছি । সেই প্রথম একনিঃশ্বাসে পড়ার পরে বহুবার পড়েছি, এবং অনেক পরে পরে আরো বুঝতে পেরেছি যে এই রম্যরচনার মধ্যে প্রচ্ছন্ন রয়েছে কত বিষণ্ণতা, কত ক্ষোভ; শক্তিহীন, অধিকারহীনদের অক্ষমতার প্রতি সমবেদনা; জাতিভেদ আর বর্ণবিভেদের বিদ্বেষের প্রতি ঘৃণা; গতপ্রায় সাম্রাজ্য আর আগামী সমাজের প্রতি নিষ্করুন দৃষ্টিপাত; আর সবকিছু ছাপিয়ে, বারবার, দোষেগুণে গড়া মাটির মানুষদের প্রতি বিষণ্ণ সমবেদনা, আর মানবসমাজের দিকে তাকিয়ে কখনো মুচকি হাসি, কখনো দিলখোলা অট্টহাস । সেই অভিজ্ঞতা আপনাদের কাছে পারলে একটু পৌঁছে দিতে চাই । আজকে হয়তো আবার এই গল্পগুলো পড়ার সময় এসেছে ।
"চাচা-কাহিনী"-তে গ্রন্থাকারে মোট এগারোটি গল্প সংকলিত । তার মধ্যে আটটি মুজতবা আলীর জার্মানি-প্রবাসের স্মৃতিসম্বলিত, সেই গল্পগুলোই আমাদের আসরে পড়ার ইচ্ছা আছে - সঙ্গে থাকবেন আশা করি । আজকের গল্পঃ "স্বয়ংবরা" ।