নমস্কার শ্রোতাবন্ধুরা, "গল্প-কথার আসর"-এর আজকের বৈঠকে যোগদান করার জন্য অজস্র ধন্যবাদ । আমি রুদ্র দত্ত ।
বাংলা সাহিত্যে কতরকমের মণিকণা - বাংলা সাহিত্য কুবেরের ভান্ডার । শুধু গতানুগতিক গল্প নয়, তাতে আছে অনেকরকম বিরল ব্যতিক্রমী সৃষ্টি । আজ যে গল্পটি আপনাদের কাছে নিয়ে আসবো, তা এইরকম একটি ব্যতিক্রমী গল্প । কল্পবিজ্ঞানের সমঝদার পাঠকদের বেশীরভাগের কাছেই গল্পটি নিশ্চয়ই পরিচিত, কিন্তু বাকি পাঠকদের কাছে হয়তো অতটা নয় । এই গল্পের একটি বিশেষত্ব এই যে, সাহিত্য হিসেবে ছাপার অক্ষরে প্রকাশ পাবার আগেই গল্পটি বেতারের মাধ্যমে প্রচারিত হয় - তাও আবার লেখকদের নিজেদের কণ্ঠে । "লেখকদের" বলছি যে কারণে সেটি এই গল্পের আর একটি চমক - গল্পটি একজন নয়, চার-চারজন ভিন্ন লেখকের সৃষ্টি । একই বিষয়ের উপর একাধিক লেখককে ভিন্ন ভিন্ন গল্প, বা কোনো এক আখ্যায়িকার ভিন্ন ভিন্ন পরিচ্ছেদ লিখতে আমন্ত্রণ করা, সাহিত্যে বেশ চলিত একটি রীতি । বিভিন্ন সাহিত্যিকেরা একই বিষয় নিয়ে তাঁদের নিজেদের নিজেদের স্বতন্ত্র শৈলী এবং কল্পনার মাধ্যমে কী ভিন্ন ভিন্ন সৃষ্টি করেন, তা দেখার এবং উপভোগ করার একটা বিশেষ মজা আছে । এবং সাধারণতঃ একই জাতের বা জাঁরের সাহিত্যিকদেরই এইরকম উদ্যোগে আহ্বান করা হয় - যেমন গোয়েন্দাকাহিনী, বা এই ক্ষেত্রে, কল্পবিজ্ঞান ।
এই বিশেষ উদ্যোগটিতে আহ্বানকর্তা ছিলেন আকাশবাণী কলকাতা । তখন ১৯৬৫ কি ১৯৬৬ সাল । এটি আকাশবাণী-র প্রথম এইরকম প্রকল্প নয় - এর আগেও এইরকম অনুষ্ঠান আকাশবাণীতে প্রচার হয়েছিলো, এমনকি কল্পবিজ্ঞানের গল্পের উপর ভিত্তি করেও এইটি প্রথম প্রচেষ্টা নয় । তবে এই বিশেষ অনুষ্ঠানটিতে অংশগ্রহণ করেছিলেন চারজন বিশিষ্ট লেখক - যাঁদের হয়তো বাংলা কল্পবিজ্ঞানের সেই কাঁচা বয়সের চারজন শ্রেষ্ঠ কল্পবিজ্ঞান লেখক বললে ভুল হয় না - এবং তাঁরা শুধু গল্প লিখে দেননি, রেকর্ডিং করে দিয়েছিলেন যে যার কণ্ঠে, যা প্রচারিত হয়েছিল ১৯৬৬ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি, "রবিবাসরীয়" অনুষ্ঠানে । গল্পটির নাম "সবুজ মানুষ" । ইণ্টারনেটে, ইউটিউবে, এই গল্পটির বিভিন্ন লোকের পাঠ করা বিভিন্ন রেকর্ডিং পাওয়া যায়, কিন্তু লেখকদের পাঠ করা সেই মৌলিক রেকর্ডিংটি - আমি অন্ততঃ অনেক খুঁজেও পাইনি । হয়তো আমাদের বিগত অতীতের অনেক কিছুর মতোই বাংলা কল্পবিজ্ঞানের এই মূল্যবান দলিলটি আমরা কবে অবহেলায় বা অনাদরে পরিত্যাগ করেছি । কিংবা হয়তো তা লুকিয়ে আছে আকাশবাণীর পুরনো সিন্দুকে - কোনোদিন আত্মপ্রকাশ করলেও করতে পারে । তাই শ্রোতাবন্ধুদের কাছে আমাদের পডকাস্টে এই গল্পটি নিয়ে আসার সার্থকতা আছে তা মনে হলো ।
এই গল্প পাঠের আর একটি কারণ আছে । গল্পের চারজন রচয়িতা হলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, অদ্রীশ বর্ধন, দিলীপ রায়চৌধুরী, এবং সত্যজিৎ রায় । এক-একজ্ন এক-একটি পরিচ্ছেদ লিখেছিলেন । সত্যজিৎ রায়ের পরিচ্ছেদটি "আনন্দ" প্রকাশনীর উদ্যোগে সত্যজিৎ রায়ের গল্পসমগ্রতে স্থান পেয়েছে । কিন্তু তাতে ১৯৬৬ সালের "রবিবাসরীয়" অনুষ্ঠানের উল্লেখ থাকলেও, এটি যে চারটি পরিচ্ছেদের একটি, তার কোনো উল্লেখ নেই । ফলে, অনেক পাঠকই জানেন না যে এটি একটি সম্পূর্ণ গল্পের অংশমাত্র । ইউটিউবে লভ্য অনেক রেকর্ডিংয়েও শুধু এই পরিচ্ছেদটিরই পাঠ আছে, এবং লেখক হিসেবে শুধু সত্যজিৎ রায়েরই নাম আছে । এমন একটি সুন্দর এবং অনন্য প্রচেষ্টার কথা ভুলে গিয়ে শুধু একটি পরিচ্ছেদের কথা মনে রাখলে সেই পরিচ্ছেদের গৌরব বাড়ে না, বরং বাংলা সাহিত্যের গৌরবকেই খর্ব করা হয় - অন্ততঃ আমার তো তাই মনে হয় । "দেʼজ" প্রকাশনী প্রেমেন্দ্র মিত্রের যে কল্পবিজ্ঞান সমগ্র প্রকাশ করেছেন, তাতে কিন্তু চারটি পরিচ্ছেদই আছে, চারজন লেখকের যথাযথ নামে । তাঁদের সৌজন্যে পাওয়া এই সংস্করণটি থেকেই আজ গল্পটি পাঠ করছি ।
প্রেমেন্দ্র মিত্র, অদ্রীশ বর্ধন, দিলীপ রায়চৌধুরী, এবং সত্যজিৎ রায়, চারজনের গল্পই আমরা আগে এই পডকাস্টে পাঠ করেছি - এখন আর তাঁদের সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলছি না - তাঁরা যে বাংলা কল্পবিজ্ঞানের দিকপাল, তা শ্রোতাবন্ধুরা জানেন । একটু খেয়াল করে শুনলে হয়তো এই চারজনের যার যার নিজস্ব বাচনভঙ্গী আর রচনাশৈলী এই চারটি পরিচ্ছেদে আপনারা শুনতে পাবেন । আর সবটা মিলিয়ে একটি সার্থক কাহিনী হলো কি না, তা মনের মধ্যে একটু শিহরণ জাগিয়ে দিলো কি না, সে বিচার আপনারাই করবেন, শ্রোতাবন্ধুরা । আরম্ভ করছি আজকের পাঠ, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অদ্রীশ বর্ধন, দিলীপ রায়চৌধুরী, এবং সত্যজিৎ রায়-এর গল্প, "সবুজ মানুষ" ।