নমস্কার শ্রোতা বন্ধুরা। গল্প কথার আসরের আজকের অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য আপনাদের অশেষ ধন্যবাদ। আমি রাজীব ঘোষ।
শ্রোতা বন্ধুরা আজ কের আসর একটু বিশেষ আসর। আজকে আপনাদের কাছে নিয়ে আসতে চলেছি বাংলা সাহিত্যের এমন একটি জেনরে কে যার সাথে সবার হয়ত সেই ভাবে পরিচয় নেই। কল্প বিজ্ঞান বা সায়েন্স ফিকশন এর জগৎ বলতে অনেকেই পাশ্চাত্যের সাহিত্য কেই বোঝেন। এই নিয়ে আমরা পঞ্চম সিজনের গোড়ায় বলেছি যে এই জনরার সাহিত্য রচনা দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পরবর্তী সময়কার ঘটনা। বাংলায় ও তাই। আজ যে সাহিত্যিক কে হাজির করবো আপনাদের সামনে তাঁকে বাংলায় এই জোনরার সাহিত্যের প্রতিষ্ঠাতা বললে ও ভুল বলা হয় না। তাঁর নাম অদ্রীশ বর্ধন।
অদ্রীশ বর্ধন এর জন্ম 1932 সালে কলকাতায়। কলকাতা বিশ্বিদ্যালয়ের স্নাতক তিনি। কিছু দিন চাকরী সূত্রে থেকেছেন বেঙ্গালুরু তে। 1963 সালে প্রথম গল্প রচনা। তারপরে চাকরী তে ইস্তফা দিয়ে কলকাতায় ফেরা আর সাহিত্য জীবনের শুরু। বলা যায়, বাংলায় কল্প বিজ্ঞান সাহিত্যের তিনি পুরোধা পুরুষ। তাঁর আগে প্রেমেন্দ্র মিত্র এবং সত্যজিৎ রায় বিজ্ঞান নির্ভর গল্প লিখেছেন বটে, কিন্তু আর্থার সি ক্লার্ক, এইচ জি ওয়েলস বা জন উইন্ডহ্যম এর মত কল্প বিজ্ঞান এর গল্প উপন্যাস সেই ভাবে কেউ আর লেখেন নি ধারাবাহিক ভাবে। অদ্রীশ এই দুই মহীরুহকে তাঁর সাথী হিসেবে পেলেন এই নতুন ধারার সাহিত্য কে পাঠক সমাজের কাছে পৌঁছে দেবার জন্যে। এই সময়েই তিনি প্রকাশক হিসেবেও আত্ম প্রকাশ করলেন তাঁর আশ্চর্য ম্যাগাজিন এর মাধ্যমে। পরে ফ্যান্টাস্টিক পত্রিকাও সম্পাদনা করেন বহুদিন। 2019 পর্যন্ত বিস্তৃত জীবনে তিনি অক্লান্ত ভাবে লিখে গেছেন একের পর এক উপন্যাস, গল্প, বিদেশী রচনার অনুবাদ আর তার সাথে করেছেন প্রকাশনার কাজও। এই অমিত শক্তির পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর কাজের মধ্যে। বহু পুরস্কার ছিল তাঁর ঝুলিতে - কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান পুরস্কার, দীনেশ চন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার, ও মৌমাছি স্মৃতি পুরস্কার তিনি লাভ করেন। সায়েন্স ফিকশন সিনে ক্লাবের তিনি প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন। সবুজ মানুষ, আমার মা সব জানে, প্রফেসর নাট বল্টু, গোয়েন্দা ইন্দ্রনাথ রুদ্র, মিলক গ্রহে মানুষ এই সব বই পাঠকদের মনে চিরস্থায়ী প্রভাব ফেলেছে। জুলে ভার্ণের রচনাবলীর অনুবাদ তিনি অতি যত্ন করে করেছিলেন বাংলায়, আর তার ফলেই তা পৌঁছে গিয়েছিল বহু প্রজন্মের বাংলা বই এর পাঠকদের কাছে।
আজ থেকে শুরু করবো অদ্রীশ বর্ধনের একটি কল্প বিজ্ঞান এর উপন্যাস সোনালী চোখ। এই কাহিনী টি এত তাই ব্যতিক্রমী একটি গল্প যে এর সম্পর্কে দু একটি কথা বলে নেওয়া প্রয়োজন। প্রথমত বলে রাখি যে এই উপন্যাস টি কিন্তু প্রাপ্ত বয়স্ক দের উপন্যাস। গল্পের বিষয় বস্তুর মধ্যে পৃথিবীর যে ভবিষ্যত দশার কথা বলা আছে সেটি কল্প বিজ্ঞান নির্ভর ঠিকই কিন্তু তাঁর অন্তর্নিহিত বিষয় বস্তু প্রাপ্ত মনষ্ক পাঠকদের জন্যেই।
অদ্রীশ বর্ধন-এর সোনালী চোখ উপন্যাস টি ঠিক মৌলিক উপন্যাস নয় | জন মিডলটন মারি জুনিয়র যিনি রিচার্ড কাউপার নামক ছদ্ম নামে লিখতেন তার লেখা 1974 সালের উপন্যাস The Twilight of Briareus অবলম্বনে অদ্রীশ তাঁর সোনালী চোখ উপন্যাস টি লেখেন। এটিকে অনুবাদ বলা চলে না, কারণ লেখক শুধু যে পটভূমিকা বা চরিত্র গুলির ভারতীয় করণ করেছেন তাই নয়, তিনি কিছু কিছু ক্ষেত্রে মূল ঘটনার প্রতিও সম্পূর্ন আনুগত্য রাখেন নি। 1974 সালের ব্রিটিশ সামাজিকতায় ও মননে যা গ্রহণ যোগ্য ছিল তাকে তিনি ভারতীয় সমাজ বিধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখার জন্যে বদলে ফেললেন অনেকটা। ফলে সোনালী চোখ হয়ে দাঁড়ালো মূল গল্পের একটা ভারতীয় সংস্করণ । অদ্রীশ এই রকম কাজ আরো অনেক করেছেন। তাঁর মতে পাশ্চাত্যের কল্প বিজ্ঞান এর গল্প গুলোকে ঠিক অনুবাদ করে ভারতীয় পাঠকের কাছে নিয়ে আসা মুশকিল। তাকে ভারতীয় বা বাঙ্গালী পাঠকের মনের অন্দরমহলে যেতে হলে গল্পের ষোলো আনা ভারতীয় করণ দরকার। সেটা অর্থ সামাজিক পরিস্থিতির সাথে যাতে খাপ খায় সেইটা দেখা দরকার। এই উপন্যাসের Briareus Delta কিন্তু কে নেহাৎই একটা কল্পিত সুপারনোভা। বৈজ্ঞানিক সত্যতা কিছু নেই।
যাক প্রাক কথন অনেক হল। এবারে মূল পাঠে প্রবেশ করি। শুনতে থাকুন অদ্রীশ বর্ধনের কল্প বিজ্ঞান এর উপন্যাস সোনালী চোখ। আজ প্রথম পর্ব।