নমস্কার শ্রোতাবন্ধুরা, "গল্প-কথার আসর"-এর আজকের বৈঠকে যোগদান করার জন্য অজস্র ধন্যবাদ । আমি রুদ্র দত্ত । আজ আপনাদের কাছে, এই আসরে প্রথম বারের জন্য, নিয়ে আসব এমন একজন সাহিত্যিককে, যিনি খুব স্বল্প কিছু সাহিত্যকীর্তি রেখে গেছেন, কিন্তু তাতেই তৎকালীন পাঠকদের কাছ থেকে, এবং অন্যান্য সাহিত্যিকদের কাছ থেকে - যাঁরা অনেকেই তাঁর বয়ঃজ্যেষ্ঠ - ভালোবাসা আর সম্মান আদায় করে নিয়েছিলেন । আজ অবশ্য সাধারণ পাঠক তাঁকে প্রায় ভুলতে বসেছে, কিন্তু অন্ততঃ কল্পবিজ্ঞানের ভক্ত যাঁরা, তাঁরা নিশ্চয়ই তাঁর নামের সঙ্গে এখনো সুপরিচিত । তিনি দিলীপ কুমার রায়চৌধুরী ।
১৯২৮ সালে জ্ন্মগ্রহণ করেন দিলীপ রায়চৌধুরী, অন্য অনেক পরিবারের মতই দেশ ভাগের পরে যাঁরা পশ্চিমবঙ্গে চলে এসেছিলেন এমন এক পরিবারে । দিলীপরা ছিলেন চার ভাইবোন, দিলীপ নিজে বড় হন নিজের দাদামশাই ও দিদিমার কাছে, বহরমপুরে । সেখানেই কলেজে কেমিস্ট্রিতে ডিগ্রী, তারপর কলকাতার সায়েন্স কলেজে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী । তারপর কিছুদিন খড়গপুর আই-আই-টি-তে গবেষণার পরে পাড়ি আমেরিকার আইওয়ায় । পি-এইচ-ডি অর্জন করে ১৯৫৭ সালে দেশে ফেরার পরে আই-সি-আই-তে রসায়ন গবেষকের চাকরি আরম্ভ করেন । দিলীপ ছিলেন প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞানমনস্ক; শুধু নিজে যে তিনি বিজ্ঞানের ছাত্র এবং পরে পেশাদারী বৈজ্ঞানিক ছিলেন তা নয় - রসায়ন ছাড়া অন্য বিভিন্ন বিজ্ঞানের সীমানায় কি ঘটে চলেছে তার খবর রাখতেন, পাশ্চাত্য বিজ্ঞানভিত্তিক সাহিত্যেরও অনুরাগী ছিলেন । আবার সেই সঙ্গে ছিলেন সমাজমনস্ক - সমাজতন্ত্রের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ছিলো, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে - তখনও যা অবিভক্ত - যোগাযোগ ছিলো । নিজে তৈরি করেছিলেন এবং সংশ্লিষ্ট ছিলেন "তরুণতীর্থ" নামে এক সমাজসেবী সংস্থা - সুবিধাবঞ্চিত, গ্রামীণ যুবাদের সাহায্যার্থে । বিয়ে করেছিলেন ১৯৫৯ সালে, স্ত্রী অরুন্ধতীও উচ্চশিক্ষিত, আর্ট কলেজের স্নাতক, আকাশবাণীর সঙ্গীতশিল্পী । বিয়ের কʼবছর পরে দুই কন্যাসন্তানের জন্ম । আর এরই মধ্যে বাংলায় বিজ্ঞাননির্ভর ও কল্পবিজ্ঞানের গল্প রচনা শুরু ।
আমাদের পঞ্চম পর্বের শুরুতে, "পঞ্চম প্রত্যুষ" এপিসোডে উল্লেখ করেছিলাম, যে কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যে সারা পৃথিবীতেই বিপ্লব ঘটেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, আর বিশেষ করে বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্দ্ধে । সেই বিপ্লবে বাংলা সাহিত্যের তরফ থেকে এগিয়ে এসেছিলেন প্রথমে প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক বা শিল্পী যাঁদের বিজ্ঞান বা বিজ্ঞানীদের প্রতি কৌতূহল আর শ্রদ্ধা ছিলো - যাঁদের মধ্যে অগ্রনী - এবং সবার অগ্রজ - নিঃসন্দেহে প্রেমেন্দ্র মিত্র, তারপর সত্যজিৎ রায় । বাঙালী পাঠকের কাছে এই দুজনের পরিচয় দেবার অপেক্ষা রাখে না - আমর এঁদের সম্বন্ধে সামান্য কিছু বক্তব্য এর আগের বিভিন্ন এপিসোডে রেখেছি, আর এঁদের রচিত কল্পবিজ্ঞানের গল্প-উপন্যাসও পাঠ করেছি । পরবর্তী ঢেউএ এসেছিলেন যাঁরা পেশায় শিল্পী-সাহিত্যিক নন - যাঁরা জীবিকার্থে নিজেরাই বৈজ্ঞানিক । তাঁদের মধ্যে অগ্রণী ছিলেন অদ্রীশ বর্ধন, যাঁর কথা বন্ধুবর রাজীব এর আগের একটি এপিসোডে বলেছে, অদ্রীশের একটি কল্পবিজ্ঞানের উপন্যাসও পাঠ করেছে । প্রসঙ্গতঃ, সেইসময়ের ইংরেজী কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যেও - যার প্রধান হোতারা বেশীরভাগই আমেরিকান - দেখি এই একই পরম্পরা । এই দ্বিতীয় তরঙ্গের কেউ কেউ আবার সাহিত্যে সাফল্য অর্জন করে পেশাদারী সাহিত্যিকই হয়ে যান - যেমন আমেরিকার আইজ্যাক আসিমভ বা বাংলার অদ্রীশ বর্ধন বা অনীশ দেব । এই দ্বিতীয় তরঙ্গেরই বিশিষ্ট একজন দিলীপ কুমার রায়চৌধুরী ।
একেবার আক্ষরিক অর্থেই, প্রেমেন্দ্র মিত্র আর অদ্রীশ বর্ধনের হাত ধরেই দিলীপের কল্পবিজ্ঞান লেখা আরম্ভ । কল্পবিজ্ঞান লেখার দিকে তাঁর নিজের ঝোঁক ছিলো তো বটেই - বোধহয় প্রতিটি কল্পবিজ্ঞান পাঠকেরই থাকে । দিলীপের লেখা প্রথম কল্পবিজ্ঞানের গল্প "শিলাকান্থ", যেটি আজ পাঠ করবো, তার পান্ডুলিপি প্রেমেন্দ্র মিত্রের কাছে কি করে পৌঁছেছিলো তা আমার জানা নেই - সম্ভবতঃ দিলীপ নিজেই পাঠিয়েছিলেন, অনুরাগী পাঠকরা প্রথম লেখক হয়ে ওঠার সময়ে নিজেদের প্রিয় প্রতিষ্ঠিত লেখকদের কাছে লেখা পাঠানোর রীতি চিরকালের । গল্পটি স্পষ্টতই প্রেমেন্দ্র মিত্রের বিশেষ ভাবে ভালো লাগে । সেই সময়ে অদ্রীশ বর্ধনের সঙ্গে একদিন প্রেমেন্দ্রে কথোপকথনে এই গল্পটির কথা প্রেমেন্দ্র বলেন - তখন ১৯৬৪ সাল, তার আগের বছরেই অদ্রীশ প্রতিষ্ঠা করেছেন বাংলায় কেবলমাত্র কল্পবিজ্ঞানের পত্রিকা, "আশ্চর্য" । যখন প্রসঙ্গ ওঠে যে বাংলায় মৌলিক সায়ান্স ফিকশনের গল্প খুব বেশী লেখা হচ্ছে না, তখন প্রেমেন্দ্র মিত্র "শিলাকান্থ"-এর পান্ডুলিপি তুলে দেন অদ্রীশ বর্ধনের হাতে । সেই আগস্টেই "আশ্চর্য" ম্যাগাজিনে প্রকাশ পায় গল্পটি, এবং পাঠক সমাজে সমাদৃত হয় । তার পর জীবিকার আর "তরুণতীর্থ"-এর কাজের ফাঁকে ফাঁকে "আশ্চর্য" পত্রিকার নিয়মিত লেখক হয়ে ওঠেন দিলীপ রায়চৌধুরী ।
তা সত্ত্বেও দিলীপ রেখে গেছেন মাত্র একটি কল্পবিজ্ঞান উপন্যাস, আট-দশটি কল্পবিজ্ঞানের গল্প, আর ভ্রমণকাহিনী আর ছোটোদের জন্য বিজ্ঞানবিষয়ক প্রবন্ধ মিলিয়ে আরো আট-দশটি রচনা । শুধু তাঁর পরিবারের আর বন্ধু বর্গের নয়, বাংলা সাহিত্যেরও বিশেষ পরিতাপের বিষয় - মাত্র আটত্রিশ বছর বয়সে, ১৯৬৬ সালে, এনকেফালাইটিস রোগে আক্রান্ত হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন এই বহুমুখী প্রতিভাধর বৈজ্ঞানিক-সাহিত্যিক । বাংলা সাহিত্যের এই ক্ষতি প্রায় এই একই বয়সে সুকুমার রায়ের অকালমৃত্যুর কথা মনে করিয়ে দেয় । তাঁর অকাল প্রয়াণে প্রেমেন্দ্র মিত্র গভীর ক্ষোভের সঙ্গে লিখেছিলেন, "একটি মহৎ জীবনের ওপর যথেচ্ছ খেয়ালের এই আকস্মিক ছেদ টানার ভেতরে জীবন বিধাতার কী গভীর উদ্দেশ্য থাকতে পারে বুঝতে পারি না ।" অদ্রীশ বর্ধন লিখেছিলেন, "সব শেষ হয়ে গেল । একটা বিরাট প্রতিভার আকস্মিক মৃত্যু ঘটল । ... তাঁর অকাল মৃত্যুতে বাংলা সাহিত্যের নতুন ধারা সায়েন্স ফিকশনের অগ্রগতি যে বেশ খানিকটা ব্যাহত হল, তাতে সন্দেহ নেই ।"
কিন্তু এই কটি সৃষ্টিতেই পাঠকসমাজের শ্রদ্ধা আর তারিফ আদায় করে নিয়েছিলেন দিলীপ রায়চৌধুরী - আর তার কারণ সেই লেখাগুলির সাবলীল উৎকর্ষ । পাঠক হিসেবে আমার নিজের দুটি কথা মনে হয়েছে - প্রথমতঃ, এই গল্পের বিজ্ঞান সম্পূর্ণ নির্ভুল, এবং বিজ্ঞানের খুঁটিনাটি দিয়ে গল্প ভারাক্রান্ত না করেও বিভিন্ন নিখাদ ডিটেল দ্বারা সমৃদ্ধ । আর গল্পের যে প্রধান ঘটনাবলী, তার যে বিবর্তন, তা প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞাননির্ভর - বিজ্ঞান এখানে শুধু লাগামছাড়া কল্পনার ওপরে হাল্কা কিছু মুখরোচক পরিভাষার প্রলেপ নয় । আসলে দিলীপ নিজে বিজ্ঞানী হওয়ার ফলেই তিনি গল্প লেখার সময়েও বিজ্ঞানের প্রতি বিশ্বস্ত । পেশাদারী গবেষক হওয়ার ফলে তাঁর বিজ্ঞানজগতের সঙ্গে সক্রিয় যোগাযোগ ছিলো, তিনি প্রতি বছর বিদেশে বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে যোগ দিতে যেতেন । বস্তুতঃ, সত্যজিৎ রায় যে বিশ্বদরবারে স্বীকৃত বাঙালী বৈজ্ঞানিককে কল্পনা করেছিলেন, দিলীপ ছিলেন সেই বৈজ্ঞানিক স্বয়ং । দ্বিতীয়তঃ, এই লেখার ভাষা আশ্চর্য সাবলীল - এই লেখাকে অপেশাদারী লেখকের প্রথম কলম-চালানো বলে মনে হয় না, বরং মনে হয় দক্ষ গল্প-বলিয়ের নিপুণ হাতের কাজ ।
এহেন লেখকের অকালে প্রয়াণ তো সত্যিই খেদের কথা । তাই মনে হয়, অন্ততঃ এই কটি লেখা তো আমরা দিলীপের কাছ থেকে পেয়েছি, সেগুলি আমাদের সযত্নে রক্ষা করা উচিত । আর সেইজন্যই আজ এই আসরে আপনাদের কাছে তাঁর লেখা উপস্থিত করতে পেরে খুবই ভালো লাগছে ।
তারপর বিচার আপনারাই করুন, শ্রোতাবন্ধুরা । অনেক কথা হয়ে গেল, এবারে আরম্ভ করছি আজকের পাঠ - দিলীপ রায়চৌধুরীর বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প, "শিলাকান্থ" ।