নমস্কার শ্রোতাবন্ধুরা, "গল্প-কথার আসর"-এর আজকের বৈঠকে যোগদান করার জন্য অশেষ ধন্যবাদ । আমি রুদ্র দত্ত । আজকে পাঠ করবো নরেন্দ্রনাথ মিত্রের একটি গল্প, "শুনঃশেফ" ।
গল্পটি মনস্তাত্বিক - আপাতদৃষ্টিতে একটি ছোটো ছেলের মনের গোপন কথা, কিন্তু অচিরেই প্রকাশ, গল্পটি সেই মনের দর্পণে একটি সমাজচিত্রও বটে । সাহিত্যে বহু গল্পই তো প্রথম পুরুষ অর্থাৎ ফার্স্ট পার্সনে লেখা - যেখানে কোনো একটি চরিত্র নিজের তরফ থেকে গল্পটি বলছে । এইরকম গল্পেও সংলাপ থাকে, বহির্জগতের ঘটনার বিবরণ থাকে । কোনো কোনো গল্পে শুধু তাই থাকে; যে চরিত্র গল্পটি বলছে তার অভ্যন্তরীণ কোনো চিন্তা বা অনুভূতি, কোনো স্বগতোক্তি, যাকে ইংরেজীতে বলে ইনার মনোলোগ, তা থাকেই না । তার একটা কারণ এই যে, লেখকের পক্ষে সম্পূর্ণ অন্য একটি চেতনার মধ্যে ঢুকে তার অনুভূতি, উপলব্ধি, ভিতর থেকে বোধ করা তো সহজ কাজ নয় । বিশেষ করে, সেই চেতনা যদি আর পাঁচজনের মতো গতানুগতিক না হয়, তা যদি সাধারণ মানুষের থেকে কিছু বিচ্যুত বা পীড়িত হয় । কিন্তু সেই দুঃসাধ্য কাজও প্রতিভাশালী সাহিত্যিকেরা করতে পারেন । আর তাঁদের অন্তর্দৃষ্টি যদি সফল হয়, তাহলে সেই অস্বাভাবিক মানসিকতার দরুণ সেই সব মানুষদের সঙ্গে আমাদের তথাকথিত সাধারণ মানুষদের সমাজের ব্যবহার কেমন, তার একটা বিরল সাক্ষ্য তৈরী হয় । এই গল্পটি তেমনই একটি গল্প ।
গল্পটি পড়তে গিয়ে আমার দুটি ইংরেজী বইয়ের কথা মনে পড়ে গেছে - একটি সিলভিয়া প্লাথের "দ্য বেল জার", আর একটি জে. ডি. স্যালিঞ্জারের "দ্য ক্যাচার ইন দ্য রাই" - শ্রোতাবন্ধুরা যদি পড়ে থাকেন, তাঁদেরও হয়তো মনে পড়বে । সিলভিয়া নিজের কথাই লিখছিলেন - "দ্য বেল জার" স্পষ্টতঃই আত্মজীবনীমূলক, এবং প্রকৃত অর্থেই অভ্যন্তরীণ স্বগতোক্তি । স্যালিঞ্জার দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে নিজের কষ্টকর অভিজ্ঞতা থেকেই "ক্যাচার ইন দ্য রাই"-য়ের প্রধান চরিত্রের অন্তর্কথা কল্পনা করেছিলেন বলে অনেকে মনে করেন । কিন্তু ভাবতে আশ্চর্য লাগে, নরেন্দ্রনাথ কি করে এমন নিশ্চিত প্রত্যয় নিয়ে একটি উপদ্রুত বালকমনের অন্তরের কথা অনুধাবন করেছেন । তাঁর জীবনেও দুঃখদুর্দশার সঙ্গে ভিতর থেকে পরিচয় ছিলো বোধহয়, তার থেকেই নিশ্চয়ই । আর যে ভাবেই হোক, সিলভিয়া প্লাথের লেখা পড়ে নিশ্চয়ই নয়; "শুনঃশেফ"-এর রচনাকাল আমার ঠিক জানা না থাকলেও ১৯৬২ বা তার আগে তো বটেই, কারণ যে সংকলনে গল্পটি পাই, সেটি ওই ১৯৬২ সালেই প্রকাশিত, আর "দ্য বেল জার" প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে ।
গল্প পাঠ আরম্ভ করার আগে, গল্পের শিরোনামা নিয়ে একটু বলা প্রয়োজন, কারণ নামটার একটা তাৎপর্য আছে, অথচ গল্পটার মধ্যে সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া নেই । নরেন্দ্রনাথ হয়তো মনে করেছিলেন পাঠকেরা সবাই এই তাৎপর্য সহজেই বুঝবেন, কিন্তু আমি জানাতে বাধ্য যে আমি অন্ততঃ মোটেই জানতাম না । শ্রোতাবন্ধুদের কারো কারোও হয়তো একই বিড়ম্বনা হতে পারে মনে করে, একটু খোঁজাখুঁজি করে যা পেলাম, সংক্ষেপে জানাচ্ছি । বিভিন্ন পুরাণে একটু ভিন্ন ভিন্ন কাহিনী থাকলেও, এইটুকু মেলে যে শুনঃশেফ এক ঋষির বা এক ব্রাহ্মণের মধ্যম পুত্র, যাঁকে এক রাজা কিনে নিয়েছিলেন, কারণ যজ্ঞে বলি দেবার পশু পাচ্ছিলেন না - তাই শুনঃশেফকেই পশু ধরে নিয়ে তাকে আগুনে আহুতি দেবার পরিকল্পনা করেছিলেন । বিশ্বামিত্র মুনি শুনঃশেফকে বরুণ-মন্ত্র শিখিয়ে দেন, তাই জপ করে শুনঃশেফ অগ্নির থেকে উদ্ধার পান । অর্থাৎ শুনঃশেফের কাহিনী হলো এক অবহেলিত, প্রান্তিক মানুষের চরম বিপদ, আর শিক্ষা ও মননের সাহায্যে পুড়ে মরার থেকে শেষ মুহূর্তে রক্ষা পাবার গল্প ।
তাহলে আরম্ভ করছি আজকের পাঠ, নরেন্দ্রনাথ মিত্রের গল্প, "শুনঃশেফ" ।