নমস্কার শ্রোতাবন্ধুরা, "গল্প-কথার আসর"-এর আজকের বৈঠকে যোগদান করার জন্য অনেক ধন্যবাদ । আমি রুদ্র দত্ত । আজ যে গল্পটি পাঠ করতে চলেছি, তার সঙ্গে অনেকেই হয়তো পরিচিত নন - যেমন পরিচিত নন তার লেখক জগদানন্দ রায়ের সঙ্গে ।
গল্পটি একটি কল্পবিজ্ঞানের গল্প - এবং অনেক বোদ্ধা সাহিত্য পর্যালোচকের মতেই, বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম কল্পবিজ্ঞানের গল্প এইটি । সম্ভবতঃ ১৮৯২ সালে এই গল্পের রচনা - আমি পাঠ করছি ১৯১৪ সালে প্রকাশিত জগদানন্দের "প্রাকৃতিকী" সংকলন থেকে, তার নিবেদনে জগদানন্দ লিখেছেন যে এই গল্পটি আরো বাইশ বছর আগের রচনা, তার থেকেই এর রচনাকাল হিসেবে ১৮৯২ সালের অনুমান । শ্রোতাবন্ধুরা, বাংলা কল্পবিজ্ঞানের প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে আগে বলেছিলাম যে ১৯৪০-এর দশকে প্রেমেন্দ্র মিত্রের হাত ধরে বাংলা বিজ্ঞানভিত্তিক গল্পের ধারা প্রথম বইতে আরম্ভ করে, প্রোফেসর শঙ্কু, প্রোফেসর নাট-বল্টু-চক্র ও আরো অনেক জনপ্রিয় কল্পবিজ্ঞানের আবির্ভাব ঘটে আরো অনেক পরে, ১৯৬০-এর দশকে । কিন্তু তার অনেক আগে ১৯০৮ সালে বেগম রোকেয়া, এবং আরো আগে ১৮৯৬ সালে জগদীশচন্দ্র বসু, আর সর্বপ্রথম ১৮৯২ সালে জগদানন্দ রায় এক-একটি বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প রচনা করে যান । বাংলা সাহিত্যে বিজ্ঞাননির্ভর গল্পের শিকড় বহু গভীরে ।
কোনো কোনো সমালোচক এই কারণে জগদানন্দ রায়কে বাংলা কল্পবিজ্ঞানের জনক বলে থাকেন - কিন্তু যতদূর বুঝতে পারি জগদানন্দ কল্পবিজ্ঞানের গল্প রচনা করেছিলেন এই একটিই । তাই, এই কথাকে উৎসাহের অত্যুক্তি বলেই আমাদের মনে হয় । এই কথা বললে প্রেমেন্দ্র মিত্রের ছটি বিজ্ঞানভিত্তিক উপন্যাস, ডজনখানেক অন্যান্য বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প, এবং প্রায় একশোটি বিজ্ঞানসমৃদ্ধ ঘনাদা-র গল্পের দ্বারা প্রায় একাহাতে বাংলায় কল্পবিজ্ঞানের প্রচলন করাকে অসম্মান করা হয়, যেমন অসম্মান করা হয় তাঁর উত্তরসূরীদের ।
আর সবচেয়ে বেশী অসম্মান করা হয় বোধহয় জগদানন্দ রায়কেই । জগদানন্দের প্রথম ও প্রধান পরিচয় তো সবেধন নীলমণি একটি বিজ্ঞানভিত্তিক গল্পের রচয়িতা হিসেবে নয় - তিনি ছিলেন অসামান্য এবং অদ্বিতীয় বিজ্ঞানশিক্ষক, বিজ্ঞানগুরু । শতাব্দীর প্রাক্কালে, ১৯০১ সালের ডিসেম্বর মাসে রবীন্দ্রনাথ যখন বহু প্রচেষ্টার পর তাঁর ব্রহ্মচর্যাশ্রমের উদ্বোধন দিয়ে পরে যা পাঠ-ভবন এবং বিশ্বভারতী হয়ে গড়ে উঠবে তার প্রথম পত্তন করেন, তখন ছাত্র ছিলো মাত্র পাঁচটি, আর অধ্যাপক রবীন্দ্রনাথ নিজে ছাড়া দুজন । জগদানন্দ রায় ছিলেন সেই দুজনের একজন - বিজ্ঞান ও গণিতের অধ্যাপক । তাঁর দীর্ঘ শিক্ষকজীবনের ও কর্মজীবনের বর্ণনা দিতে যাওয়া আমাদের পক্ষে বাতুলতা হবে; ১৯৬৯ সালে জগদানন্দের জন্মশতবার্ষিকীতে শান্তিনিকেতন পুস্তক প্রকাশ সমিতি যে পুস্তিকাটি প্রকাশ করেন, উৎসাহী শ্রোতাবন্ধুরা তা সংগ্রহ করে পড়ে নিতে পারেন ।
শুধু ছাত্রদের সামনা-সামনি শিক্ষাদান নয়, বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার উপলব্ধি অতি সহজ করে সকলের কাছে পরিবেশন করার জন্য জগদানন্দ পরিশ্রম করেছেন সারা জীবন । বহু বই লিখেছেন, তার কিছু কিছু, যেমন "পাখী", "পোকা-মাকড়", "মাছ-ব্যাঙ" জীববিদ্যার এক-একটি অংশে গভীর অবগাহন; আবার কিছু কিছু যেমন "প্রাকৃতিকী", "বৈজ্ঞানিকী", "বিজ্ঞানের গল্প" বিজ্ঞানের সমস্ত শাখার কৌতূহলোদ্দীপক তথ্যের সরস বিবরণ । বস্তুতঃ, যাকে ইংরেজীতে বলে popularizer of science, সেই কাজ জগদানন্দ করেছেন বহুল মাত্রায়, এবং বাংলা ভাষায় যাঁরা এই কাজ প্রথম করেছেন, তাদের মধ্যে তিনি অগ্রণী, সম্ভবতঃ প্রথম । চৌষট্টি বছর বয়সে, ১৯৩৩ সালে, জগদানন্দ পরলোকগমন করেন । দীর্ঘজীবী রবীন্দ্রনাথ তখনো জীবিত - জগদানন্দের সম্বন্ধে তাঁর স্মৃতিচারণ আগে যে পুস্তিকাটির উল্লেখ করেছি তাতে পাবেন ।
আজ যে গল্পটি পাঠ করবো, তাতে আজকের পাঠক বা শ্রোতা হয়তো খুব বেশী চমক পাবেন না - আজকের হিসেবে এই গল্প সাদামাটা ঠেকতে পারে, ভাষাটাও সাধুভাষা । এতে জুল ভার্নের গল্পের প্রভাব নিঃসন্দেহে আছে - মনে রাখতে হবে, জুল ভার্নের কালজয়ী সব উপন্যাস, যেমন Around the World in Eighty Days বা The Mysterious Island এই গল্পের মাত্র পোনেরো-কুড়ি বছর আগে প্রকাশিত হয়েছে । কারুর কারুর হয়তো H G Wells-এর The First Men in the Moon বা Edgar Rice Burroughs-এর A Princess of Mars এবং অন্যান্য Barsoom উপন্যাসগুলির কথা মনে পড়তে পারে, তবে সেগুলি সবকটিই জগদানন্দের এই গল্পটির অনেক পরে রচিত । তাই একটি মাত্র গল্প হলেও, এই গল্পটির একটি বিশেষ স্থান আছে । শুনে আপনাদের কিছুটা চিত্তবিনোদন হতে পারে, এই আশা রেখে, আজীবন বিজ্ঞানশিক্ষক ও বিজ্ঞানপ্রচারকের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন হিসেবেই, এই গল্পটি আজ পাঠ করছি ।
আর কথা না বাড়িয়ে আরম্ভ করছি আজকের পাঠ, জগদানন্দ রায়-এর গল্প, "শুক্র-ভ্রমণ" ।