শ্রোতাবন্ধুরা, "গল্প-কথার আসর"-এর আজকের বৈঠকে যোগদান করার জন্য অজস্র ধন্যবাদ । আমি রুদ্র দত্ত । এই তৃতীয় সীজনের গোড়াতেই বলেছিলাম, নরেন্দ্রনাথ মিত্রের লেখা গল্পের থেকে কয়েকটি পড়ার উদ্দেশ্যের কথা । আজকে পাঠ করবো তাঁর লেখা একটি হাসির গল্প ।
নরেন্দ্রনাথ মিত্র বিংশ শতাব্দীর মানুষ - ১৯১৬ থেকে ১৯৭৫ তাঁর জীবৎকালে তিনি চার শতাধিক গল্প রচনা করেছেন, কারুর কারুর হিসেবে প্রায় পাঁচশো গল্পের তিনি রচয়িতা । এ ছাড়া বেশ কিছু উপন্যাসও লিখেছিলেন - আর লিখেছিলেন কবিতা । আশ্চর্যের বিষয়, সমকালীন পাঠকদের কাছে তাঁর গল্প অতি জনপ্রিয় এবং পরিচিত হয়েছিলো, কিন্তু তিনি যে সারাজীবন কবিতাও লিখে গেছেন, তা পাঠকেরা অনেকেই জানতেন না । নরেন্দ্রনাথের কাব্যগ্রন্থ "নিরিবিলি"-র পর্যালোচনা করে বুদ্ধদেব বসু তাঁর "কবিতা" পত্রিকায় এ বিষয় উল্লেখ করেছেন, আর নরেন্দ্রেনাথের পাঠকদের উৎসাহ দিয়েছেন তাঁর কবিতাও পড়ার জ্ন্য ।
আমরা অবশ্য গল্পকার নরেন্দ্রনাথের উপরেই বেশী দৃষ্টিপাত করবো, কারণ আমাদের আসর তো গল্পকথার । আমাদের তৃতীয় পর্বের গোড়ার কথায় বলেছিলাম, নরেন্দ্রনাথের গল্পে নারী ও পুরুষের সম্পর্ক একটি প্রধান বিষয় - কিন্তু গতানুগতিক ভাবে যদি বলি নারী ও পুরুষের চিরন্তন সম্পর্ক, তাহলে হয়তো ভুল হয় । বরং সেই সম্পর্কের ক্রমবিবর্তন, সেই সম্পর্কের মধ্যে কি বা কতটুকু সত্যিই চিরন্তন, আর কতটা হয়তো যুগনির্ভর বা দেশ-কাল-নির্ভর - কতটা শ্বাশ্বত, আর কতটা পরিবর্তনশীল - কতটা মূল্যবান, আর কতটা বর্জনীয়, তার প্রতি তাঁর মনোযোগ । সত্যজিৎ রায়-র "মহানগর" চলচ্চিত্রটি যে নরেন্দ্রনাথ মিত্রের লেখা একটি গল্প অবলম্বনে, তা অনেকেই জানেন - মূল গল্পটির নাম "অবতরণিকা" । বিশাল মহানগরী কলকাতা, দুই যুগের আর দুই বিশ্বদর্শনের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে তার যে বৈচিত্রময় প্রেক্ষাপট, সেই পটে এই পরিবর্তনশীল সম্পর্কের ছবি এই গল্প । যুগপরিবর্তনের কথা অনেকেই লিখেছেন; নারীবাদীতার পরিপ্রেক্ষিতে সেই সমাজপরিবর্তনকে অনুসরণ করার প্রথম চেষ্টা যাঁরা করেছিলেন, নরেন্দ্রনাথ তাঁদের অন্যতম একজন ।
পাঠকসমাজে তো বটেই, সুধী ও বিদ্বমহলেও তিনি পরিচিত ও মান্য ছিলেন । সত্যজিৎ রায় শুধু যে তাঁর গল্প থেকে সিনেমা করেছিলেন তাই নয়, নরেন্দ্রনাথের ছেলে অমিতাভ-র লেখা থেকে জানতে পারি যে সত্যজিৎ-বাবু প্রায়ই তাঁদের বাড়িতে আসতেন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা নরেন্দ্রেনাথের গল্প নিয়ে আলোচনা করতেন । অন্য অনেক সাহিত্যিকের সঙ্গেও খুব ঘনিষ্ট ও শ্রদ্ধার সম্পর্ক ছিলো । কিন্তু রাজনীতিতে ডান-বাঁ কোনোদিকেই বিশেষ সমর্থন ছিলো না - যদিও বন্ধু ও সতীর্থদের সাহায্য করার জন্য কখনো কখনো রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন । সেইজ্ন্যই হোক, বা অন্য কোনো কারণেই হোক, বিশেষ কোনো সম্মানে তিনি কখনোই ভূষিত হননি - তাঁর জীবনের একমাত্র সম্মান আনন্দ পুরষ্কার । স্বীকৃতির এই অভাবে তাঁর মনে একটু ক্ষোভও হয়তো ছিলো, ছেলে অমিতাভ-র লেখা থেকে তা জানতে পারি ।
কিন্তু সম্মান, স্বীকৃতি, নামডাক - সাহিত্যিক বা শিল্পীর সৃষ্টিকর্মের আসল মূল্যায়ন এর কোনোটিই নয় । সেই শিল্পকীর্তি পাঠকের, দর্শকের, শ্রোতার মনে কতটা অনুরণন জাগাতে পারলো, কালের বিচারে এই একমাত্র মাপকাঠি । নরেন্দ্রনাথ যে যুগপরিবর্তন, সংস্কৃতিবিবর্তন দেখেছিলেন, আর তাঁর কলমে শুধু তার দিনপঞ্জিকা নয়, যেন ভবিষ্যৎ দর্শনও লিপিবদ্ধ করেছিলেন, সমাজের সেই বিবর্তন এখনও চলছে, আমরা তার মধ্যে দিয়েই যাচ্ছি । নরেন্দ্রনাথের গল্পের পুনর্মূল্যায়ন করার উদ্দেশ্য থাক বা না থাক, গল্পগুলি এখনো আমাদের মনে দাগ কাটতে পারে । শুধু সেই দাগ কাটা, সেই অনুরণনের লোভেই তাঁর গল্পের সঙ্গে একটু পরিচিত হবার আমাদের এই প্রয়াস ।
আজকে পাঠ করবো তাঁর লেখা একটি হাসির গল্প । হাসির মেজাজে তিনি এই গল্পে শুধু একটি নয়, দুটি স্বতন্ত্র সামাজিক পরিবর্তনের কথা তুলে ধরেছেন - দুটিই এখনও যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক । তাহলে আর কথা না বাড়িয়ে আরম্ভ করছি আজকের পাঠ, নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ছোটো গল্প "লক্ষ্মীর পদত্যাগ" ।