নমস্কার শ্রোতাবন্ধুরা, "গল্প-কথার আসর"-এর আজকের বৈঠকে যোগদান করার জন্য অজস্র ধন্যবাদ । আমি রুদ্র দত্ত । আজ পাঠ করবো অদ্রীশ বর্ধনের একটি কল্পবিজ্ঞানের গল্প, যার কেন্দ্রে তাঁর সৃষ্ট এক অভিনব চরিত্র - প্রোফেসর নাট-বল্টু-চক্র । এর আগে এই আসরে অদ্রীশ বর্ধনের গল্প প্রধানতঃ বন্ধুবর রাজীবই পাঠ করেছে, আর তার বেশীরভাগই অদ্রীশের গোয়েন্দা গল্প; কল্পবিজ্ঞানের গল্প পাঠ হয়েছে এর আগে মাত্র একটি । অন্য কোনো কোনো এপিসোডে অবশ্য বাংলা কল্পবিজ্ঞান-সাহিত্যে অদ্রীশ বর্ধনের স্থান নিয়ে কিছু কথা আমরা বলেছি । সেই স্থান বেশ অনন্য, তাই তাঁর রচিত কল্পবিজ্ঞানের গল্প বেশ কয়েকটি এই সীজনে পাঠ করার পরিকল্পনা রইলো । আজ সেই পাঠের শুরু । অদ্রীশ বর্ধনের সম্বন্ধে রাজীব আগে কিছু মুখবন্ধ করেছে, তার আর প্রয়োজন নেই । শুধু তাঁর কল্পবিজ্ঞান, আর বিশেষ করে প্রোফেসর নাট-বল্টু-চক্র, এদের বিষয়ে একটু কথা বলার লোভ সামলাতে পারছি না ।
এই পডকাস্টের বিগত সীজনে, যখন আমরা বাংলা science fiction গল্পের দিকে প্রথম মনোনিবেশ করতে আরম্ভ করি, তখনই উল্লেখ করেছিলাম যে বিশ্বের অন্যান্য ভাষার মতোই, বাংলাতেও এই ধরণের গল্প লেখার প্রচলন বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে আরম্ভ । ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের কয়েক দশক থেকে আরম্ভ করে বিজ্ঞানের আবিষ্কার - স্টীম ইঞ্জিন, রেলগাড়ি, বিমান - সারা পৃথিবীর ভোল পাল্টে দিতে থাকে; দুই মহাযুদ্ধের সময় ব্যবহৃত সামরিক যানবাহন, বোমা, বিষাক্ত গ্যাস বিজ্ঞানের অসীম শক্তির কথা মানুষের সামনে এমন প্রকট করে তুলে ধরে, যে সমাজের সব অবস্থার সব মানুষই বিজ্ঞানকে মানবজীবনের এবং সভ্যতার এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ বলে মেনে নিতে বাধ্য হন । তার পর থেকেই বিজ্ঞান আস্তে আস্তে সাহিত্যে নিজের জায়গা করে নেয় ।
এই কথা অবশ্যই বলে নেওয়া উচিত যে এরও আগে খুব অল্প কয়েকজন, যাঁরা বিশেষভাবে বিজ্ঞানসচেতন ছিলেন, তাঁরা বিজ্ঞানকে নির্ভর করে কতিপয় কিছু গল্প রচনা করেছেন । এর মধ্যে বিশেষ ভাবে মনে পড়ে বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর কথা - তাঁর গল্প আমরা আগে পাঠ করেছি, এবং সেই গল্পের বিজ্ঞাননির্ভরতা নিয়েও কথা বলেছি; উৎসাহী শ্রোতাবন্ধুরা আমাদের ২২২ নম্বর এপিসোডে ১৮৯৬ সালে রচিত গল্প "পলাতক তুফান" শুনে নিতে পারেন । প্রায় একই সময়ে রচিত জগদানন্দ রায়ের "শুক্রভ্রমণ" গল্পটি - ১৮৯২ সালে প্রকাশিত এই গল্পটিও আমাদের আসরে কিছুদিনের মধ্যেই পাঠ করার উদ্দেশ্য রইলো । নারীবাদী সাহিত্যিক, শিক্ষিকা, এবং সমাজসেবিকা বেগম রোকেয়া ১৯০৮ সালে "বেগমের স্বপ্ন" বলে যে গল্পটি রচনা করেন, তার অন্তর্নিহিত বিষয় নারীস্বাধীনতা হলেও, সেটি একটি সার্থক কল্পবিজ্ঞানও বটে - সেটির পাঠও অনতিবিলম্বে এই আসরে শুনবেন ।
কিন্তু এই হাতে-গোনা কয়েকটি গল্প অবিস্মরণীয় হলেও, বাংলা সাহিত্যে বিজ্ঞানভিত্তিক গল্পের ধারাস্রোত প্রথম বইতে আরম্ভ করলো দুই মহা যুদ্ধের পরের সময় থেকে আরম্ভ করে, আর তার ভগীরথ হলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র । চল্লিশের দশক থেকে আরম্ভ করে, প্রেমেন্দ্র মিত্র সৃষ্টি করলেন বেশ কিছু সম্পূর্ণ বিজ্ঞানভিত্তিক উপন্যাস, বড় এবং ছোটো গল্প, এবং অজস্র ঘনাদা-র গল্প যার পটভূমি বিজ্ঞাননির্ভর, এবং প্রায় একা হাতে বাংলা সাহিত্যে বিজ্ঞানমনস্কতাকে গ্রহণযোগ্য করে তুললেন । তার ফল ফলতে দেরীও হলো না । আরো অনেক সাহিত্যিক, কেউ নবীন, আবার কেউ লব্ধপ্রতিষ্ঠ, তাঁদের লেখায় বিজ্ঞানের উল্লেখ করা, বিজ্ঞানকে কেন্দ্রীয় স্থান দেওয়া আরম্ভ করলেন । ষাটের দশকে এই ধারাস্রোত পরিণত হলো জোয়ারে । সত্যজিৎ রায়, লীলা মজুমদার, হেমেন্দ্রকুমার রায়, পরশুরাম, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধায়ের মতো সাহিত্যিকদের লেখাতে বিজ্ঞান এবং কল্পবিজ্ঞান উঁকিঝুঁকি মারতে আরম্ভ করলো - সত্যজিৎ রায় গোড়া থেকেই, ১৯৬১ তাঁর বাংলায় রচিত প্রথম গল্প, "বঙ্কুবাবুর বন্ধু" থেকেই কল্পবিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন; অনতিবিলম্বে প্রোফেসর শঙ্কুকেও সৃষ্টি করে ফেলেন, এবং বহুদিন শঙ্কুর গল্প লিখে চলেন ।
এরই পটভূমিতে, অদ্রীশ বর্ধনের বাংলা বিজ্ঞান- ও কল্পবিজ্ঞান-ভিত্তিক গল্পের জগতে পদার্পণ । ১৯৬৩ সালে তাঁর "আশ্চর্য!" পত্রিকার সৃষ্টি, নিজের বিভিন্ন সাহিত্যরচনা, ব্যক্তিগত জীবনে ট্র্যাজেডির ছোঁয়া, "আশ্চর্য!" পত্রিকার অকালমৃত্যুর কিছু বছর বাদে আবার - সত্যজিৎ রায়ের নামকরণে - "ফ্যানটাসটিক" পত্রিকার প্রবর্তন, এইসব নিয়ে রাজীব আগে এই পডকাস্টে বলেছে, আমি আর তার পুনরাবৃত্তি করছি না । বরং এই পটভূমিকায় যাঁর জন্ম, সেই প্রোফেসর নাট-বল্টু-চক্রের প্রসঙ্গে চলে যাই ।
প্রোফেসর নাট-বল্টু-চক্র যে কিছুটা প্রোফেসর শঙ্কুর আদলে তৈরী, তা অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই; বহু সাহিত্যিকই অন্য সাহিত্যের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে এসেছেন যুগে যুগে । কিন্তু প্রোফেসর নাট-বল্টু-চক্র প্রথম থেকেই ব্যতিক্রমী, স্বতন্ত্র, এবং পরিকল্পিত ভাবে বেখাপ্পা । অদ্রীশ নিজে লিখেছেন, "ছোটোদের মন জয় করতে গেলে, সুগারকোটেড ট্যাবলেটের মতন তেতো ওষুধ খাইয়ে দিতে গেলে, হাসিঠাট্টা কৌতুক পরিহাসের মোড়কে বৈজ্ঞানিকি অ্যাডভেঞ্চারের নায়ক হিসেবে খাড়া করেছিলাম শ্রীহীন এক আধবুড়ো ফোকলা এক্কেবারে বাঙালিকে - যার নামকরণ করেছিলাম এমনভাবে যাতে ছেলেমানুষরা নাম শুনলেই বুঝতে পারে মানুষটা কি নিয়ে যত্তোসব উদ্ভট সৃষ্টিছাড়া ব্যাপারের গবেষণা করে ।"
শুধু চরিত্রের নামকরণের মধ্যে নয়, শুধু তাঁর অ-নাযকোচিত ফোকলা চেহারা আর কথাবার্তাতেই নয়, প্রোফেসর নাট-বল্টু-চক্রের গল্পগুলি পড়লে বোঝা যায়, এই গল্পগুলিতে অদ্রীশ নিজেকে একটা বাঁধনহীন ছাড়পত্র লিখে দিয়েছিলেন - বিষয়বস্তু নিয়েও, রচনাশৈলী নিয়েও । কিছু কিছু গল্প বেশ গতানুগতিক বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প - প্রেমেন্দ্র মিত্র যার পথ দেখিয়ে দিয়েছিলেন তারই অনুবর্তী । কিন্তু আরো অনেক গল্পে অদ্রীশ জেনেশুনে সাহিত্যের প্রচলিত রীতি ইচ্ছাকৃত ভাবে অতিক্রম করেছেন । বিভিন্ন গল্পের মধ্যে পারম্পর্য বা সামঞ্জস্য রক্ষা করার কোনো প্রচেষ্টাই তিনি করেননি - বিভিন্ন গল্পে পরস্পরবিরোধী তথ্য পরিবেশন করেছেন অম্লানবদনে । গল্পের সময়কালেরও কোনো হিসেব নেই - বিভিন্ন দেশকালে গল্পগুলিকে নিয়ে ফেলা হয়েছে । অনেক গল্প খুব ছোট্ট, আবার অনেক গল্প উপন্যাসোপম । গল্পের মধ্যে গল্প বলার প্রচলন সাহিত্যে আছে - নাট-বল্টু-চক্রেরও কোনো কোনো গল্পে দেখি গল্প শেষ হবার পরে লেখক দীননাথ সেই গল্প নিয়ে দেখাচ্ছে প্রোফেসরকে, আর প্রোফেসর তা গাঁজাখুরি বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন । অর্থাৎ কোন গল্পগুলি যে "সত্যি" প্রোফেসর নাট-বল্টু-চক্রের গল্প, আর কোনগুলি দীননাথের কল্পনা, তাও বোঝার কোনো উপায় পাঠকের নেই । আর বহু গল্পেই রয়েছে একটু আতঙ্ক বা ভয়াবহতার ছোঁয়া, একটু শিউরে ওঠা । গল্পগুলির মধ্যে আর যাই থাক, একটা দৃপ্ত বলিষ্ঠতার ভাব আছে সবসময়ই । গল্পগুলিকে, ইংরেজীতে যাকে বলে sensational, বললে ভুল হয় না একেবারেই । বোঝাই যায়, বিজ্ঞানের অতি-আধুনিক কথার সামান্য একটু ছোঁয়া ছোটোদের মনে ঠেকিয়ে দেওয়ার জন্য যা করার দরকার অদ্রীশ তাই করতে রাজী ছিলেন ।
দুটো কথা বলে নেওয়া উচিত । কোনো জিনিষের মধ্যে যদি মহিমা বা গৌরব থাকে, তাহলে সত্যকে স্বীকার করলে সে মহিমা বাড়ে বই কমে না । প্রোফেসর নাট-বল্টু-চক্রের অনেক গল্প - বোধহয় সত্তর কি আশিটি হবে । তার মধ্যে অনেকগুলিরই হয়তো কোনো কোনো অংশ অন্য কোনো কল্পবিজ্ঞানের রচনার দ্বারা অনুপ্রাণিত । কোনো কোনোটি প্রায় অন্য কোনো গল্পের আক্ষরিক অনুবাদ - উদাহরণ স্বরূপ বলতে পারি "অণিমা-মানুষ" গল্পটি ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত হেনরি হাস-এর "He Who Shrank" গল্পটির অনুবাদ বলে মনে করাই শ্রেয় । "অণিমা-মানুষ" প্রথম প্রকাশের সময় অদ্রীশ হয়তো এই কথার স্বীকৃতি দিয়েওছিলেন - আমাদের পক্ষে এখন তা জানার কোন উপায় নেই ।
দ্বিতীয় কথাটি হলো, অদ্রীশের অনেক গুণগ্রাহীই বারবার বলে থাকেন, অদ্রীশ বর্ধনই বাংলা ভাষ়ার কল্পবিজ্ঞানের হোতা, তাঁর আগে কোনো কল্পবিজ্ঞান লেখা হয়নি - যা হয়েছে তা কল্পবিজ্ঞান নামের যোগ্য নয় । এ কথা সত্য নয়, আর অদ্রীশের নিঃসন্দেহ যে মহত্ব, পূর্বসূরীদের হেয় করলে তার বৃদ্ধি হয় না - হয়তো সত্যের অপলাপে তা খর্বই হয় । আমার বিশ্বাস নয় যে অদ্রীশ নিজে এই কথা বলতেন - প্রেমেন্দ্র মিত্রের কাছে তিনি যে কত ঋণী সে কথা তিনি নিজেই স্বীকার করেছিলেন ।
আস্তে আস্তে এই আসরে প্রোফেসর নাট-বল্টু-চক্রের অনেক গল্পই পাঠ করার ইচ্ছা রইলো । "কল্পবিজ্ঞান" - এই কথাটি অদ্রীশ বর্ধনেরই সৃষ্টি, যতদূর জানি । তার আগে এই ধরণের গল্পকে বিজ্ঞানভিত্তিক বা বিজ্ঞাননির্ভর বলা হতো । তাতে যেন বর্তমান বিজ্ঞানেরই, বা তার খুব অল্প একটু অগ্রসরের উপর ভিত্তি করেই, গল্প রচনার কথা লেখক আর পাঠকের মনে আসতো । কিন্তু কল্পবিজ্ঞান কথাটি যেন আমাদের মনে আরো বেশী লাগামছেঁড়া কল্পনার দরজা খুলে দেয় । প্রোফেসর নাট-বল্টু-চক্রের গল্পে আমরা সবরকমেরই স্বাদ পাবো । আজ যে গল্পটি পাঠ করবো, সেটি অবশ্য অনেক বেশী গতানুগতিক কল্পবিজ্ঞান - এর চমক অনেকটাই নির্ভর করে প্রোফেসর নাট-বল্টু-চক্রের উদ্ভট চরিত্রের উপর ।
আরম্ভ করছি আজকের পাঠ - "মেহগনি জঙ্গলের বিস্ময়" ।