শ্রোতাবন্ধুরা, "গল্প-কথার আসর"-এর আজকের বৈঠকে যোগদান করার জন্য অজস্র ধন্যবাদ । আমি রুদ্র দত্ত । আজকে পাঠ করবো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি ছোটো গল্প । আমাদের আসরের দ্বিতীয় পর্বের শেষে শ্রুতিপুস্তক হিসেবে বিভূতিভূষণের "চাঁদের পাহাড়" উপন্যাস পাঠ করেছিলাম, কিন্তু বিভূতিভূষণের আর কোনো রচনা এ পর্যন্ত আমাদের আসরে পড়া হয়নি । আজ তাঁর লেখা গল্প একটি পাঠ করার আগে বিভূতিভূষণের সম্বন্ধে একটু বলে নিই ।
অবশ্য বিভূতিভূষণের পরিচয় নতুন করে দেওয়ার কিই বা থাকতে পারে । ১৮৯৪ সালে, বিংশ শতাব্দীর জন্মের মাত্র কয়েক বছর আগে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম । ব্যারাকপুর অঞ্চলে পৈতৃক বাড়িতে ছোটোবেলা কাটে । জীবিকা ছিলো প্রধানতঃ শিক্ষকতা, যা তিনি করে গেছেন আজীবন, সাহিত্যিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবার পরেও । প্রথম লেখা ছাপা হয় ১৯২১ সালে । ১৯২৮-২৯ সালে প্রথম উপন্যাস "পথের পাঁচালী" প্রকাশ পাবার পরেই প্রকৃত সম্মান আর স্বীকৃতি পেয়েছিলেন বিভূতিভূষণ । তারপর থেকে লিখে গেছেন বাকি জীবন । আন্দাজ প্রায় কুড়িটি উপন্যাস, আর দেড়শোর উপর ছোটো গল্প তিনি রচনা করেছিলেন । বহু কাহিনীরই পটভূমিকা ঘরের কাছে - বনগাঁও, ভাগলপুর, রাণাঘাট । আবার কিশোরদের অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাসের পটভূমিকা সুদূর আফ্রিকা, চীন, বা প্রশান্ত মহাসাগরের নামহীন দ্বীপ । "পথের পাঁচালী" আর তার অনুগামী "অপরাজিত" অবশ্যই তাঁর সর্বাধিক পরিচিত রচনার মধ্যে পড়ে - ধারাবাহিক প্রকাশের সময়ই "পথের পাঁচালী" পাঠকদের অতি জনপ্রিয় হয়েছিলো, আর তাঁর মৃত্যুর পরে সত্যজিৎ রায়ের নির্মিত চিত্ররূপ একাধারে বিভূতিভূষণ, "পথের পাঁচালী", বাংলা চলচ্চিত্র শিল্প, এবং পরিচালক সত্যজিৎ রায়কে সারা বিশ্বের দরবারে অমর করে দিয়েছিলো - আজ পর্যন্ত দেশ-দেশান্তরের বহু চলচ্চিত্রকার "পথের পাঁচালী"-কে সর্বকালের সেরা চলচ্চিত্র বলে মনে করেন । কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের ছবিই "পথের পাঁচালী"-র খ্যাতির কারণ মনে করলে ভুল হবে । "পথের পাঁচালী" উপন্যাস প্রকৃত অর্থেই কালোত্তর - যা সাহিত্য হিসেবে অনায়াসে বিশ্বসাহিত্যের পর্যায়ে পড়ে । মার্টিন সেমার-স্মিথ, বিদগ্ধ ও প্রখ্যাত সাহিত্য পর্যালোচক, বিভূতিভূষণকে ভারতের সেরা লেখক, এবং "পথের পাঁচালী"-কে বিংশ শতাব্দীর সেরা ভারতীয় সাহিত্যের আখ্যা দিয়েছিলেন । তেমনি ভুল হবে মনে করলে যে বিভূতিভূষণের অন্যান্য লেখা কম জনপ্রিয় বা কালজয়ী । "আরণ্যক", "আদর্শ হিন্দু হোটেল", "অশনি সংকেত", এবং বিভূতিভূষণের আরো অনেক সাহিত্যকীর্তিই পাঠকের হৃদয়তন্ত্রে ঠিক একই রকম নাড়া দিতে পারে, এবং আজও দেয় । "ইছামতী" উপন্যাসের জন্য তিনি রবীন্দ্র-পুরষ্কার পান - কিন্তু মরণোত্তর ভাবে । এই পুরষ্কার প্রাপ্তির ঠিক আগের বছরে, বিংশ শতাব্দীর ঠিক মধ্যক্ষণে, মাত্র ছাপ্পান্ন বছর বয়সে মারা যান বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ।
বিভূতিভূষণের লেখার বিশেষত্ব কি ছিলো, যাতে বহু দশক ধরে, আজ পর্যন্ত, বহু পাঠকের তা এতো মনোগ্রাহী, এতো হৃদয়স্পর্শী হতে পেরেছে ? মনে হয়, বিভূতিভূষণের গল্পে মানুষের স্থান সবথেকে উপরে বলে । গল্প তৈরী হয় ঘটনা-পরম্পরা দিয়ে - কিন্তু গল্পের সঙ্গে পাঠক যোগ খুঁজে পায় চরিত্রের মধ্যে দিয়ে - তাদের সুখ-দুঃখ আশা-হতাশা পাঠকের মনে যে প্রতিফলন, যে সহানুভূতি সৃষ্টি করে, তার মধ্যে দিয়ে । বিভূতিভূষণের লেখায় তৎকালীন সমাজের চিত্র ফুটে উঠেছে অবশ্যই - সেই সমাজের সমস্যা, অন্যায়, বৈষম্য, কোনোকিছুই ঢাকা পড়েনি । কিন্তু বিভূতিভূষণের গল্পের চরিত্ররা কখনোই শুধুমাত্র গল্পকারের পুতুল, বা ঘটনা-পরম্পরার নিমিত্তমাত্র হয়ে ওঠেনি । বিভূতিভূষণের চরিত্রেরা প্রকৃতই রক্তমাংসের মানুষ, আর তাদের চলন, বলন, এইসবই সম্পূর্ণ স্বাভাবিক । গল্পের পটভূমিকা নেহাতই প্রেক্ষাপট হিসেবেই ব্যবহার করেছেন বিভূতিভূষণ - চরিত্রদের স্বাভাবিকতায় কখনোই ছন্দপতন হয়নি । এই অর্থে, বোধহয় বলা যায়, বিভূতিভূষণ প্রকৃত অর্থেই মানবিক, মানববাদী লেখক - মানুষের অন্তঃকরণকে তিনি কখনোই কাহিনীর স্বার্থে ক্ষুণ্ণ করেননি । আর তাই বোধহয়, বিভূতিভূষণের চরিত্ররা যখন কথা বলে ওঠে, আমাদের হৃদয় তাতে সাড়া না দিয়ে পারে না । কোনো চরিত্রের মুখে কোনো সংলাপই কৃত্রিম মনে হয় না, তাই তাদের সুখ-দুঃখকেও অকৃত্রিম বলে অনুভব হয় ।
বিভূতিভূষণের পুত্র তারাদাস বাবার লেখার পর্যালোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন, যে তিনি প্রায় কোনো খলচরিত্র, বা ভিলেন, সৃষ্টি করেননি । আসলে মানুষের প্রতি সত্যি মমতা থাকলে বোধহয় কোনো মানুষকেই শুধু খারাপ লোক মনে করা যায় না - বাধ্য হয়ে বুঝতে হয় যে খারাপ লোকেরও নিজের কাছে নিজের কাজের কারণ আছে, কৈফিয়ৎ আছে - তা স্বার্থকেন্দ্রিক হতে পারে, কিন্তু সেটা তো অল্পবিস্তর সকলের বিষয়েই সত্য । চরিত্রদের প্রতি বিভূতিভূষণের অসীম সহমর্মিতা থাকা সত্ত্বেই বোধহয় সেই চরিত্ররা এতটা বাস্তব হয়ে ওঠে, যে আমাদের কাছে সহানুভূতি দাবী করে নেয় ।
আর সেই চরিত্র অনেক সময়ই, বিভূতিভূষণ নিজেই । "আরণ্যক" উপন্যাসকে কাহিনী বলা চলে কিনা তা নিয়ে সংশয় হতে পারে, কারণ তাতে ঘটনার ঘনঘটা নেই । কিন্তু বিভূতিভূষণ নিজে আছেন, তাঁর নিজের মনের প্রতিটি আবেগ, অনুভূতি, অনুরণন নিয়ে । অন্য যেসব গল্পে কোনো কথক চরিত্রের মুখ দিয়ে বলা, সেই কথকের মনের অনুভূতি গল্পের একটা অখন্ড অংশ । আর "পথের পাঁচালী"-ও আসলে অনেকটাই আত্মজীবনীমূলক । বিভূতিভূষণের সৃষ্ট অজস্র সার্থক চরিত্রের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট চরিত্র বিভূতিভূষণ নিজেই ।
আর কথা বাড়াবো না । তাঁর প্রতি এইটুকু শ্রদ্ধা নিবেদন করে, আরম্ভ করছি আজকের পাঠ, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প, "মাস্টার মশায়" ।