শ্রোতাবন্ধুরা, "গল্প-কথার আসর"-এর আজকের বৈঠকে যোগদান করার জন্য অজস্র ধন্যবাদ । আমি রুদ্র দত্ত । আজকে পাঠ করবো হেমেন্দ্রকুমার রায়ের লেখা একটি গল্প । পরে কোনোদিন হেমেন্দ্রকুমার রায়ের সম্বন্ধে বিশদ ভাবে আলোচনা করার সুযোগ হয়তো আসবে, কিন্তু আজ তাঁর লেখা গল্প কথার আসরে এই প্রথম পড়তে চলেছি, আজকে অল্প করে কিছু বলে নিই । - হেমেন্দ্রকুমারের লেখা এক নয়, একাধিক প্রজন্মের পাঠক পাঠিকাদের ছোটোবেলার খুব প্রিয় অভিজ্ঞতা । বড়দের জ্ন্যও লিখেছেন - "নাচঘর" পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন তিনি - কিন্তু তাঁর আসল জীবনকর্ম নিশ্চিতভাবে কিশোরসাহিত্য । ছোটোদের জন্য নানা রসের লেখা লিখেছেন তিনি, আর তার সবকিছুর মধ্যে সবথেকে বেশী যা ফুটে উঠেছে, তা হলো অ্যাডভেঞ্চার ! হেমেন্দ্রকুমারের সৃষ্ট চরিত্র বিমল আর কুমারের কীর্তিকলাপ যারাই ছোটোবেলায় পড়েছে, তাদের সারা জীবন মনে রয়ে গেছে । সত্যি কথা বলতে কি, অ্যাডভেঞ্চারের গল্প বাংলা কিশোরসাহিত্যে যদিও অন্যরাও লিখেছেন - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের চাঁদের পাহাড় তার মধ্যে অতি পরিচিত - কিন্তু একাধারে পরিমাণের প্রাচুর্য আর চিত্তাকর্ষতার দিক দিয়ে হেমেন্দ্রকুমারের বোধহয় জুড়ি নেই । এছাড়াও হেমেন্দ্রকুমার ছোটোদের জন্য লিখেছেন গোয়েন্দা গল্প, অলৌকিক গল্প, এবং বেশ কিছু ইতিহাস-ভিত্তিক কাহিনী - যা কিশোরমনকে উত্তেজনা আর শিক্ষাদান দুইই একই সঙ্গে, সমান মাত্রায়, করতে পারে । এমনকি প্রাগিতিহাস-ভিত্তিক উপন্যাসও লিখেছেন - "মানুষের প্রথম অ্যাডভেঞ্চার" বইটি যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা জানেন, তার সমকক্ষ প্রচেষ্টা বাংলা কিশোরসাহিত্যে অল্পই আছে । প্রসঙ্গতঃ বলে রাখি - ভূতচতুর্দশী আর কালীপুজো আসছে - বিলিতী মতে হ্যালোঈনও এলো বলে - তাই পরের সপ্তাহান্তে আমাদের নিবেদন থাকবে হেমেন্দ্রকুমার রায়ের অলৌকিক গল্পের একটি সম্ভার ।
আজকের পাঠ কিন্তু হেমেন্দ্রকুমার রায়ের একটি গোয়েন্দা গল্প । হেমেন্দ্রকুমার অনেকগুলি গোয়েন্দা চরিত্র সৃষ্টি করেছিলেন - কিন্তু তার মধ্য প্রধান, এবং সবচেয়ে মৌলিক চরিত্র নিঃসন্দেহে জয়ন্তলাল । জয়ন্ত ও তার পার্শ্বচর মাণিক বেশী জনপ্রিয়, না বিমল-কুমার, তা বলা শক্ত । কিন্তু জয়ন্ত-মাণিকের গল্পে অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ থাকলেও সেগুলি প্রধানতঃ বুদ্ধিগত গোয়েন্দা গল্প । জয়ন্ত একাধারে গোয়েন্দাও বটে, বৈজ্ঞানিকও বটে । শার্লক হোমসের প্রভাত নিশ্চয়ই তার ওপর কিছুটা ছিলো - কিন্তু জয়ন্ত হোমসের থেকে স্বতন্ত্র - যে অসামাজিকতা, সাধারণ মানুষের প্রতি যে উন্নাসিকতা হোমসের প্রধান স্বভাব - জয়ন্তর মধ্যে তা কিছুমাত্র নেই - বরং সমাজ এবং ইতিহাসের প্রতি উৎসাহই আছে । অর্থাৎ জয়ন্ত আর মাণিক বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের নব্য বাঙালী যুবারই ছবি - যাদের পা দেশের মাটিতে, কিন্তু দুচোখে বিশ্বের আলো ।
আজ যে গল্পটি পড়বো, তাতে হেমেন্দ্রকুমার কোনান ডয়েলের লেখার সঙ্গে তাঁর পরিচয়ের একটি সুস্পষ্ট ঈঙ্গিত রেখে গেছেন । গল্পের কাঠামো এবং পরিণতির সঙ্গে শার্লক হোমসের একটি গল্পের খুবই মিল । কিন্তু হেমেন্দ্রকুমার গল্পের শেষে জয়ন্তের নিজের মুখ দিয়েই জানিয়ে দিয়েছেন, যে এই গল্প কিন্তু কোনান ডয়েলেরও মৌলিক কল্পনাপ্রসূত গল্প নয় ! আড়াই হাজার বছর আগের একটি গল্পের উল্লেখ করে জয়ন্ত জানিয়েছে, সেই গল্পের থেকেই তার মাথায় এই রহস্যভেদ পদ্ধতি মাথায় এসেছিলো । - কোনান ডয়েলের মাথাতেও হয়তো একই ভাবে এসে থাকতে পারে । হেমেন্দ্রকুমার রায়, যিনি ওমর খৈয়াম, লুইস ক্যারল, এবং আগাথা ক্রীস্টির অনুবাদ করেছিলেন, যাঁর চোখ আর মন উন্মীলিত ছিলো সারা পৃথিবীর দিকে, নিজের বৈদগ্ধ্যের একটি ছোট্ট পরিচয় রেখে দিয়েছেন এই ভাবে ।
তাহলে আর বেশী কথা না বাড়িয়ে, শুরু করছি আজকের পাঠ, হেমেন্দ্রকুমার রায়ের গোয়েন্দা গল্প "ব্রহ্মরাজের পদ্মরাগ" ।