নমস্কার শ্রোতাবন্ধুরা, গল্পকথার আসরের আজকে বৈঠকে যোগ দেবার জন্য আপনাদের অজস্র ধন্যবাদ । আমি রুদ্র দত্ত । আজ আবার পাঠ করছি প্রোফেসর শঙ্কুর একটি গল্প । কিন্তু এই গল্পটির একটু বৈশিষ্ট্য আছে । এটি সত্যজিৎ রায়ের লেখা প্রোফেসর শঙ্কুর সর্বপ্রথম গল্প - "ব্যোমযাত্রীর ডায়রী" ।
এই আসরের যাঁরা প্রথম থেকে নিয়মিত শ্রোতা, বা পরে যোগদান করেও যাঁরা আমাদের আগের এপিসোডগুলি শুনে নিয়েছেন, তাঁরা জানবেন যে আমরা প্রোফেসর শঙ্কুর গল্প পাঠ করছি আসরের একেবারে গোড়ার থেকে, এবং আজ অবধি তেরোটি গল্প পাঠ করেছি । একেবারে সব গল্পগুলি পাঠ করিনি, কিন্তু যেগুলি করেছি, তা রচনার কালানুক্রমেই করেছি । কিন্তু একেবারে গোড়া থেকে শুরু করিনি - প্রোফেসর শঙ্কুকে নিয়ে সত্যজিৎ রায় রচিত তৃতীয় গল্প থেকে পাঠ আরম্ভ করেছি । আজ এতদিন বাদে, রচনাকালের পারম্পর্য ভেঙে, পাঠ করবো সেই বাদ দেওয়া প্রথম গল্পটি । তার কারণটা একটু বলে নেওয়া দরকার । আর সেই কথা বলতে গেলে একটু শঙ্কুর গল্পগুলির সময়কাল, আর সেই সময়ের ঐতিহাসিক পটভূমির কথা একটু উত্থাপন করতে হবে ।
যে কোনো দীর্ঘজীবী চরিত্র, যাকে নিয়ে তার স্রষ্টা বহুদিনের ব্যাপ্তিতে বহুসংখ্যক গল্প লিখেছেন, সেই দীর্ঘ জীবনকালে একটু আস্তে আস্তে বদলে যেতে বাধ্য । এই ক্রমবিবর্তন অনেক সময়ই কিছুটা সময়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে চলার তাগিদে, আবার কিছুটা সেই চরিত্রের প্রতি স্রষ্টার মনোভাবের ক্রমশঃ পরিবর্তন হতে থাকার ফলেও বটে । উদাহরণস্বরূপ বলতে পারি, শার্লক হোমসকে নিয়ে কোনান ডয়েল যখন যাত্রা আরম্ভ করেন তখনো ঊনবিংশ শতাব্দীর সিকিভাগ প্রায় বাকি, আর হোমস একজন উত্তাপহীন, আবেগহীন ক্যালকুলেটর - আর যাত্রা যতদিনে শেষ হয় ততদিনে প্রথম মহাযুদ্ধের ঝড় বয়ে গেছে ইউরোপের উপর দিয়ে, ইংরেজ সমাজের প্রাচীন ভিক্টোরীয় সব নিয়মকানুন সেই দমকা হাওয়ায় আলগা হয়ে মিলিয়ে যেতে বসেছে - আর সেই মহাযুদ্ধে হোমসও অন্ততঃ কিছুটা ভূমিকা নিয়েছেন, ইতিমধ্যে ওয়াটসন পরিচয় পেয়েছেন হোমসের দরদী হৃদয়ের । সেই একই ভাবে, প্রোফেসর শঙ্কুকে নিয়ে সত্যজিৎ রায়ের যাত্রারম্ভ ১৯৬১ সালে, দীর্ঘ পরাধীনতার দুঃস্বপ্ন যখন পুরোপুরি কাটেনি, অ-ব্রিটিশ ভারতীয়রা যখনো বিশ্বের দরবারে কিছুটা অচেনা - এবং ভারত আর ভারতবাসীর নিকৃষ্টতা প্রমাণ করতে যখন অন্য অনেকে বিশেষভাবে সচেষ্ট এবং সোচ্চার । আর যাত্রার শেষ ত্রিশ বছর বাদে, বিংশ শতাব্দী যখন গতপ্রায়, মেধা, বুদ্ধি, বিদ্যা, প্রযুক্তি, নিয়ে যখন ভারতবর্ষের আর প্রমাণ করার কিছুই বাকি নেই । বিবর্তন তো ঘটতে বাধ্য । শঙ্কুকে আমরা প্রথম দেখি নিভৃত বিজ্ঞানসাধক হিসেবে, তারপর দেখি তিনি অসামান্য প্রতিভার জোরে বিশ্বের তারিফ আদায় করেছেন, আরো পরে দেখি তিনি বিশ্ববরেণ্য, তারো পরে নির্ভীক বিশ্বপর্যটক । এর মধ্যে ভারতের এবং ভারতীয় বিজ্ঞানজীবনের অনেক হাওয়াবদল হয়েছে ।
"ভারতবর্ষের বৈজ্ঞানিক" বললে স্বাধীনতা-পূর্ব কালে পাশ্চাত্য সমাজ একটা উন্নাসিক অনুগ্রহ করা দাক্ষিণ্যর ভাব দেখাতেন । আর আশ্চর্য ব্যাপার এই যে অনেক বাঙালী আর ভারতবাসীও এই মনোভাব সোৎসাহে সমর্থন করতেন, নিজেদের হীনম্মন্যতাকে সাগ্রহে বরণ করতেন । জগদীশচন্দ্র বসুর মতো অসামান্য প্রতিভাশালী বিজ্ঞানসাধকও সেই বাধাকে কোনোক্রমে কিছুটা পার হতে পেরেছিলেন - ইংরেজ বিজ্ঞানীকুলশ্রেষ্ঠরা জগদীশচন্দ্রের অবদান যথার্থ বৈজ্ঞানিকের মতোই মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছিলেন, কিন্তু গবেষণায় পদে পদে বাধা সৃষ্টি করা, গবেষণাগার তৈরী করার প্রচেষ্টায় বিরোধীতা, আর বিশ্ববৈজ্ঞানিকসম্মেলনে যোগদানের অসুবিধা গড়ে তুলতে জগদীশচন্দ্রের দেশবাসীই যেন বেশী পরায়ণ ছিলেন । আর সর্বোপরি, নোবেল প্রাইজ নমিনেশনের প্রসঙ্গে, একটা অযৌক্তিক কারণ দর্শিয়ে যে জগদীশচন্দ্র বেতার গ্রাহক যন্ত্র রয়াল সোসাইটিতে প্রদর্শন করে গেছেন দু বছর আগে, তাঁকে পেটেন্ট না দিয়ে, যে মার্কনি তখনো বেতার যন্ত্র বানিয়ে উঠতেই পারেননি, তাঁকে পেটেন্ট প্রদান করা - এই চরম বিশ্বাসঘাতকতা তো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যেরই । এরই কাছাকাছি সময়ে সত্যেন্দ্রনাথ বোসের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কথাও একই কথা মনে করিয়ে দেয় - তাঁর সৃষ্ট পারমাণবিক পরিসংখ্যত তত্বকে আইনস্টাইন সমর্থন করার আগে পাশ্চাত্য বিজ্ঞান খারিজ করেছিলো - তার পরেও গায়ের জোরে আজ অবধি তাকে বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিস্টিকস বলা হয়, যদিও আইনস্টাইন নিজে বলেছিলেন যে প্রকৃতপক্ষে তার নাম বোস স্ট্যটিস্টিকস হওয়াই উচিত ছিলো । আর নোবেলের কথা কি বলব । এই সেদিন, ২০০১ সালে, বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেটের প্রত্যক্ষ প্রমাণ দেবার জন্য তিন ইউরোপীয় বিজ্ঞানী নোবেল প্রাইজ পান - আইনস্টাইনের কথা তো আমরা সকলেই জানি । সত্যেন বোস কিন্তু নোবেল প্রাইজ পাননি । আরো অনেকের কথা বলা যায়, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, শ্রীনিবাস রামানুজম, প্রমুখ । আংশিক সান্তনা হিসেবে মনে করি, প্রায় একই সময় চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন আলোক বিচ্ছুরণ নিয়ে যে গবেষণা করছিলেন, কিছু পাশ্চাত্য বিজ্ঞানীর নাম তাতে জুড়ে গেলেও, রামন নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন সেই কাজের জন্য, ১৯৩০ সালে ।
স্বাধীনতার পরে পাশ্চত্যের এই উন্নাসিকতা একটা সুপরিকল্পিত তাচ্ছিল্যে পরিণত হলো । স্বাধীন ভারত নিজেকে স্বনির্ভর মনে করলে বহু উন্নত দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্ভাবনা । ভারত এবং ভারতবাসী যাতে তা মনে করতে না পারে, তার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন কোণ থেকে চললো প্রচ্ছন্ন চেষ্টা । বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিবিদ্যাই তখন অর্থনৈতিক উন্নতির প্রধান রাজপথ - তাই ভারতীয় বিজ্ঞানের প্রতি এই ইচ্ছাকৃত তাচ্ছিল্য । সেই পরিপ্রেক্ষিতে প্রোফেসর শঙ্কুর আবির্ভাব । রায় পরিবারের সঙ্গে জগদীশচন্দ্র বসুর ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিলো । প্রোফেসর শঙ্কু যে প্রাথমিক ভাবে প্রধানতঃ জগদীশচন্দ্রের আদলেই রচিত, তা সুস্পষ্ট । অল্প সংস্থান নিয়ে যুগান্তকারী গবেষণা চালানো, উদ্ভিদের সংবেদনশীলতার প্রত্যক্ষ প্রদর্শন, পাশ্চাত্যের বৈজ্ঞানিকদের সবিস্ময় তারিফ, মায় গিরিডিতে বাস - সবই মিলে যাচ্ছে । সত্যজিৎ রায় নিজে বিজ্ঞানে পারদর্শী ছিলেন না - কিন্তু বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা এবং বিশ্বাস ছিলো । তাই প্রোফেসর শঙ্কুর গল্পগুলিতে বিজ্ঞানের অংশটা সাধারণতঃ নেহাত আজগুবি, প্রায় রূপকথার সমগোত্রীয় । আসলে, ভারতীয় বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীদের প্রতি অবজ্ঞার নম্র অথচ দৃঢ় প্রতিবাদ করাটাই এইসব গল্পের মূল উদ্দেশ্য । বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে ভারতীয় বৈজ্ঞানিক দাঁড়িয়ে আছেন, সম্মানিত হচ্ছেন, এই ছবি আমার মতো অন্য অনেক বাঙালী ছোটো ছেলেমেয়েদের মনে এঁকে দিলেন প্রোফেসর শঙ্কু - এই ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা অনেকেই পরবর্তী কালে বিজ্ঞানসাধনায় নিজেদের নিয়োজিত করলেন, সারা বিশ্বে খ্যাতি অর্জন করলেন । এই সফলতার অন্ততঃ একাংশ প্রোফেসর শঙ্কুরই সফলতা - হোক না তাঁর গল্পের বিজ্ঞান নিতান্ত রূপকথাবিজ্ঞান ।
এর কয়েক দশকের মধ্যেই, ভারতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চিত্রের আমূল পরিবর্তন হয়ে গেলো, আর আস্তে আস্তে বিশ্ববৈজ্ঞানিক মহলে তার স্বীকৃতিও এলো । ছিদ্রাণ্বেষীদের মুখ বিশেষভাবে বন্ধ করে দিয়েছিলো পোখরানে ১৯৭৪-এর সফল পারমাণবিক পরীক্ষা, ১৯৮০-তে সম্পূর্ণ ভারতীয় শূন্যযানের দ্বারা রোহিণী স্যাটেলাইটের সফল কক্ষস্থাপন, আর আশির দশকে অগ্নি, পৃথ্বী, ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেপনাস্ত্রের সফল পরীক্ষা । ভারতীয় বিজ্ঞানের কথায় তাচ্ছিল্যের বদলে সমীহই আজকে স্বাভাবিক ।
এরই মধ্যে চলেছে প্রোফেসর শঙ্কুর যাত্রা । যে কোনো দীর্ঘজীবী চরিত্রের মতই, প্রোফেসর শঙ্কুর চরিত্রে আস্তে আস্তে কিছু কিছু বদল ঘটে গেছে, কিন্তু তাও তিনি সেই প্রোফেসর শঙ্কুই রয়ে গেছেন । সত্যজিৎ রায় প্রায় তাঁর শেষ দিন অবধি শঙ্কুর গল্প লেখার চেষ্টা করে গেছ্নে । কিন্তু যে প্রয়োজন বা তাগিদ থেকে প্রোফেসর শঙ্কুর জন্ম, তা ফুরিয়েছে অনেকদিন আগে । হয়তো তাইজন্যই, পরের দিকের প্রোফেসর শঙ্কুর গল্পগুলিতে আগের মতো বুদ্ধির ঝলক আর অপ্রত্যাশিতের চমক নেই - অন্ততঃ একজন ভক্ত পাঠক হিসেবে আমার তাই মনে হয়েছে । একেবারে শেষের দিকের গল্পগুলির এক-একটিতে আগের সেই ঝিলিক কিছুটা আছে, কিন্তু অনেকগুলিই নেহাতই ক্লান্ত, পুনরাবৃত্তিমূলক । এইজন্যই, প্রোফেসর শঙ্কুর গল্প একেবারে সবকটা পাঠ করার সঙ্কল্প নেই - যতদূর করেছি, তার পরে আর কয়েকটিই করা ইচ্ছা আছে ।
শঙ্কুর দীর্ঘ যাত্রার দীর্ঘ বর্ণনা করে, এবার ফিরে আসি আজকের গল্পের কথায় । এখুনি বললাম, প্রোফেসর শঙ্কুর চরিত্রে আস্তে আস্তে বদল ঘটে গেলেও, তিনি প্রোফেসর শঙ্কুই রয়ে গেছেন । কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের লেখা প্রোফেসর শঙ্কুর প্রথম গল্প, "ব্যোমযাত্রীর ডায়রী"-র সম্বন্ধে এই কথা সত্য নয় । এই গল্পের শঙ্কু সম্পূর্ণ অন্য চরিত্র । এই চরিত্র শ্রদ্ধা-উদ্রেককর নয়, বরং হাস্য-উদ্রেককর । এর প্রেরণা আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু নন, বরং সুকুমার রায় সৃষ্ট হেঁশোরাম হুঁশিয়ার এই চরিত্রের উৎস । বস্তুতঃ এই গল্পটি যেন হেঁশোরাম হুঁশিয়ার-এরই আর একটি গল্প । নিয়মিত শ্রোতারা জানেন, আমরা "হেঁশোরাম হুঁশিয়ার-এর ডায়রী" গল্পটি পাঠ করেছিলাম এই আসরে, দ্বিতীয় সীজনে । এই গল্পের সঙ্গে তার আদল নিশ্চয়ই লক্ষ করবেন । এখানেও গল্পটি ডায়রির আকারে লিখিত - আর সেই ডায়রি সম্পাদকের কাছে নিয়ে আসছেন এক তৃতীয় ব্যক্তি । এখানেও ডায়রির আগে-পরে সম্পাদকের তির্যক মন্তব্য । দুই ক্ষেত্রেই ডায়রি যিনি লিখছেন, তিনি নিজেকে খুব গুরুগম্ভীর ভাবে উপস্থাপন করলেও, পাঠক তাঁর কথা শুনে উপহাসের মুচকি হাসি হাসবেন, এইটাই লেখকের আসল উদ্দেশ্য । প্রোফেসর শঙ্কু নামক চরিত্রের অন্য সব কটি গল্পের যিনি নায়ক, এই গল্পের শঙ্কু তিনি হতে পারেন না ।
তাই এই গল্প দিয়ে শঙ্কুর পাঠ আরম্ভ করতে মন চায়নি । কিন্তু গল্পটি খুবই উপভোগ্য । তাই আজকে আপনাদের কাছে এই গল্পটি উপস্থিত করছি, শ্রোতাবন্ধুরা । মনে রাখবেন, এ অন্য শঙ্কু; বরং মনে করতে পারেন হেঁশোরাম হুঁশিয়ার-এরই আর একটি গল্প শুনছেন । এর পরে আবার ফিরে যাবো কালানুক্রমিক শঙ্কুর গল্প পাঠে ।
আরম্ভ করছি আজকের পাঠ, সত্যজিৎ রায়ের বিজ্ঞান-প্রহসন গল্প, "ব্যোমযাত্রীর ডায়রী" ।