"ববির বন্ধু" । বইটির শিরোনামার ববি এক ভালুকছানা । রূপকথার বা উপকথার প্রতীকি বা কাল্পনিক ভালুক না কিন্তু - একদম রক্ত-মাংসের ভালুক । কিন্তু গল্প যত না তাকে নিয়ে, তার চেয়ে অনেক বেশী তার বন্ধুকে নিয়ে - বারো বছর বয়সের মেয়ে মিনি, ভালুকছানার সঙ্গে যে বন্ধুত্ব পাতালো, যার জবানীতে এই কাহিনী । ডাকাবুকো, গেছো মেয়ে - অ্যাডভেঞ্চারের জন্য সবসময় এক পা বাড়ানো, সাহস আর উদ্দীপনায় ভরপুর, আবার জন্তু-জানোয়ারদের প্রতি ভালোবাসা আর মমতায় ভরা, তাদের প্রতি দুর্ব্যবহারে ক্ষুব্ধ, বিদ্রোহী । আসলে মিনি, মিনির ছোটোবেলার চোখে দেখা পোষ্য প্রাণীদের দুনিয়া, আর তার উপর বড়দের জগতের ছায়াপাত - এই নিয়েই গল্প ।
আমি "ববির বন্ধু" যখন পড়ি, তখন আমার বয়স মিনির চেয়েও কয়েক বছর কম । আমার ছোটোবেলা যে কয়েকটা বইতে সারাজীবন আমার মনে ধরা আছে, এই বইটি তার একটি । তার পরে কতবার পড়েছি ঠিক জোর দিয়ে বলতে পারবো না । আজ নববর্ষে তাই আমাদের বৈঠকের নিবেদন হিসেবে এই বইটির শ্রুতিপুস্তক শ্রোতাবন্ধুদের উপহার দেওয়ার কথা মনে হলো ।
এই বইয়ের ভাষা যে কি আশ্চর্যরকম সরল, তার ভেতর দিয়ে ছোট্টো নায়িকা মিনির চরিত্র আর দৃষ্টিকোণ যে কি বিশ্বস্ত ভাবে ফুটে উঠেছে, আর সেই ফুটিয়ে তোলা যে লেখিকার কি অসামান্য প্রতিভার পরিচয়, এইসব সেই অপরিণত বয়সে কিছুই মনে হয়নি । পরে আস্তে আস্তে বুঝেছি, কোনো বড় হয়ে যাওয়া মানুষের পক্ষে লিখতে বসে মনের মধ্যে থেকে সেই ছোটোবেলার নিজেকে খুঁজে বার করে তার স্বাভাবিক কণ্ঠস্বরটিকে কোনো বাহুল্য বা কৃত্রিমতা ছাড়া ঠিকঠাক খুঁজে পাওয়া, কি কঠিন কাজ । অতি প্রতিভাশালী লেখক-লেখিকারা কিন্তু এ কঠিন কাজটা করতে পারেন - আর পারেন বলেই আমরা সেই সরল, দ্বিধাহীন কণ্ঠস্বর কখনো কখনো শোনার সুযোগ পাই, আর আমাদের নিজেদের ছোটোবেলা আবার কথা বলে ওঠে । - নইলে হয়তো সে সুযোগ আমরা পেতামই না । কারণ ছোটোরা তো ছোটো থাকতে নিজেদের কথা লেখার সুযোগ সাধারণতঃ পায় না - বড়দের অনুকরণ করতেই তাদের শেখানো হয়, আর বড়দের অনুমোদনের লেখাই লিখতে দেওয়া হয় । শিশুমনের কণ্ঠস্বর সাধারণতঃ শুধু মনের মধ্যেই কথা বলার সুযোগ পায় - তারপর তারা বড় হয়ে যায় । ভাগ্যিস গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো লেখিকা "ববির বন্ধু"-র মতো বই লিখে গেছেন ।
গীতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছোটোদের জন্য বেশ কিছু বই ও গল্প লিখেছেন - আমি অবশ্য জ্ঞানতঃ তাঁর আর কোনো লেখা পড়িনি ; কোনো সংকলনে যদি কখনো খেয়াল না করে পড়ে থাকি, তার কথা বলতে পারি না । আমার কাছে তিনি অনেকদিন পর্যন্ত শুধু "ববির বন্ধু"-র লেখিকাই ছিলেন । পরে জীবনী-অভিধান থেকে জানতে পেরেছি, গীতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক বহুমুখী, কৃতী ব্যক্তিত্ব । ১৯২২-এ জন্ম, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে বি. এ., পরে বুদাপেষ্তের বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে পি. এইচ. ডি. । শিশুসাহিত্যিক ছাড়াও নাট্যকার, সাংবাদিক, সমাজগঠনকর্মী । কলকাতা ও বম্বের সংবাদপত্র ছাড়াও আন্তর্জাতিক একটি মহিলাদের মাসিক পত্রের সম্পাদকমন্ডলীতে ছিলেন, প্যারিসে প্রতিষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক গণসংস্থার সভ্য ও নির্বাহকও ছিলেন । পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিদ্যাসাগর সম্মানে ভূষিত হন । গণ-আন্দোলনের জন্য সেই সময়ের অনেক বুদ্ধিজীবীর মতো গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও নাট্যকর্মী ছিলেন - নাটক প্রযোজনাও করেছেন, নাটকে অভিনয়ও করেছেন । পৃথিবীর বহু দেশে পর্যটন করেছেন । প্রখ্যাত কবি ও সমাজকর্মী সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিলো ১৯৫১ সালে । "ববির বন্ধু" সম্ভবতঃ তাঁর প্রথম শিশুসাহিত্য ।
গীতা বন্দোপাধ্যায়ের এই নির্ভীক রাজনৈতিক সমাজসচেতন ব্যক্তিত্বের কথা জানার পর আমি "ববির বন্ধু"-র নতুন মাত্রা খুঁজে পেয়েছিলাম । দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মধ্যভাগে বর্মার যুদ্ধ এই কাহিনীর পশ্চাৎপট হিসেবে লেখিকার বেছে নেওয়ার কারণ সঠিক অনুমান করেছিলাম কি না জানিনা, কিন্তু স্বাভাবিক মনে হয়েছিলো । কতশত ছোটো ছোটো মানুষের জীবন ছারখার করে দিয়ে যায় যুদ্ধ - তা আমরা সবাই যদি সারাক্ষণ মনে প্রাণে অনুভব করতে পারতাম, তাহলে পৃথিবীতে যুদ্ধবিগ্রহ হয়তো একটু কম হতো ।
আর একটা তথ্য জানতে পেরে আশ্চর্য লেগেছিলো । আমার ছোটোবেলার অনেকটা যে বাড়িতে কেটেছিলো, গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এককালের ঠিকানা সেই বাড়ির সঙ্গে একই রাস্তায় । অর্থাৎ আমি যখন "ববির বন্ধু" পড়ে বইটিকে আমার নিত্য সঙ্গী করে ফেলেছি, সেই একই সময় হয়তো তার লেখিকা তার কয়েকশো গজের মধ্যেই বাস করতেন ! তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের সৌভাগ্য অবশ্য আমার কোনোদিন হয়নি - এই তথ্য আমি যখন জানতে পারি, সে বাড়ি ছেড়ে তো অনেকদিন এসেছি বটেই, সেই বাড়িটাই আর নেই ! তার জায়গায় এখন আধুনিক বিরাট বহুতল অট্টালিকা ।
বাড়ি নেই, কিন্তু "ববির বন্ধু" রয়ে গেছে, যেমন রয়ে গেছে আরো কিছু কালজয়ী বই - তাই আমার ছোটোবেলাও পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি । সেই পাওয়ার কিছু অংশ আবার অপর কারুর কাছে পৌঁছে দেওয়ার আশায় এই শ্রুতিপুস্তক পাঠ করা । শ্রোতাবন্ধুদের যাঁদের নিজেদের ছোটোবেলা এই বইয়ে জড়িয়ে নেই, আমার পাঠ তাঁদেরও অন্ততঃ কিছুটা আনন্দদান করতে পারবে, এই আশা রাখি ।
পাঠ আরম্ভ করার আগে আর দুটি কথা বলে নিই । প্রথমতঃ, বারো বছরের মেয়ের কথা আমার গলার স্বরে শুনে অন্ততঃ প্রথমে একটু ধাক্কা লাগতে বাধ্য । নানারকম ডিজিটাল উপায়ে গলার স্বরগ্রাম পরিবর্তন করা যায় অবশ্যই, কিন্তু তাতে স্বরের স্বাভাবিকতা অনেক সময়ই বজায় থাকে না । তার বদলে শ্রোতাবন্ধুদের নিজেদের কল্পনাশক্তির উপর বিশ্বাস রেখে, আপনারা নিজগুণে ক্ষমা করবেন এই ভরসা রেখে, নিজের গলাতেই পাঠ করছি । দ্বিতীয়তঃ, বইটিতে বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের পোনেরোটি পরিচ্ছেদ আছে । কিন্তু পরিচ্ছেদের কোনো শিরোনাম নেই - শুধু সংখ্যা । সেই সংখ্যাগুলি আর পাঠ না করে, পরিচ্ছেদের শেষ অল্প সঙ্গীতের মাধ্যমে নির্দেশ করেছি । আর শেষ কথা এই যে, বইটির জন্য ছবি এঁকেছিলেন হৈমন্তী সেন । তাঁর লাইন ড্রয়িংগুলি শুধু পরিপাটি ও সুন্দরই নয়, গল্পের মেজাজের সঙ্গে আশ্চর্যভাবে মেলে । অনুরোধ করবো, পাঠ শুনে যদি ভালো লাগে, তবে মূল বইটি সংগ্রহ করে তার ছবিগুলোও দেখে নেবেন । বইটি প্রকাশ করেছিলেন সিগনেট প্রেস, ১৯৫৭ সালে । সিগনেটের সেই সময়ের অনেক বইয়ের মতোই, প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন সত্যজিৎ রায় । বইটিতে কোনো ভূমিকা বা প্রাককথন নেই, শুধু একটি ছোট্ট উৎসর্গ আছে - "রুনু, ঘুলি, আর পুপেকে" ।
তাহলে শ্রোতাবন্ধুরা, আরম্ভ করছি এই শ্রুতিপুস্তক, গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের "ববির বন্ধু" ।