শ্রোতাবন্ধুরা, "গল্প-কথার আসর"-এর আজকের বৈঠকে যোগদান করার জন্য অজস্র ধন্যবাদ । আমি রুদ্র দত্ত । আজকে আমাদের আসরে পাঠ করতে চাই বনফুল যাঁর ছদ্মনাম, সেই বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের গল্প । ছদ্মনামে অনেকেই লেখেন - বিভিন্ন সাহিত্যস্রষ্টার ছদ্মনাম ব্যবহারের কারণও আলাদা । বনফুল ছাত্রাবস্থাতেই লিখতে আরম্ভ করেন, আর তাঁর নিজের নামে লেখা ছাপা হলে শিক্ষকরা, বা কোনো একজ্ন বিশেষ শিক্ষক, চটে যেতে পারেন এই ভয়েই শোনা যায় বনফুলের ছদ্মনাম গ্রহণ ! পরবর্তী জীবনে অবশ্য তিনি স্বনামধন্য হয়েছিলেন - বনফুল কে বাংলার পাঠকদের তা জানতে বাকি ছিলো না ।
১৮৯৯ খ্রীষ্টাব্দে বনফুলের জন্ম - কিছু বছর আগে তাঁর জন্মশতবার্ষিকী গেল । সেই উপলক্ষে তাঁর সম্মানার্থে ভারত সরকার একটি ডাকটিকিট বা স্ট্যাম্প প্রকাশও করেছিলেন ১৯৯৯ সালে । জীবৎকালে তিনি ভারত সরকারের কাছ থেকে পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত হন, ১৯৭৫ সালে । পেশায় চিকিৎসাবিদ - অবশ্য ডাক্তার নয়, প্যাথোলজিস্টের কাজ করতেন । কিন্তু বনফুল ছিলেন বাঙালী সমাজে কগনোসেন্টি যা বলে তাই - একাধারে জ্ঞানপন্ডিত ও রসপন্ডিত । বাংলা নাটকে নতুন দিক তিনি খুলে দিয়েছিলেন - মাইকেল মধুসূদন আর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে কেন্দ্র করে তাঁর দুটি নাটক থেকেই অনেক বাঙালী পাঠক এই অনন্য দুই বাঙালী ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সুপরিচিত হন । অপেক্ষাকৃত সাম্প্রতিক বাস্তবের মানুষকে নায়কস্থানে বসিয়ে নাটকীয় রচনা, তা আবার রাজা-মহারাজা কি যোদ্ধা নয়, বুদ্ধিজীবী ও সমাজ সংস্কারক মানুষকে, সম্ভবত বাংলা সাহিত্যে এই প্রথম । ছোটো গল্প ও উপন্যাসও বহু রচনা করেছেন - ষাটের উপর উপন্যাস, ও পাঁচশোরও বেশী ছোটো গল্প ।
এইসব গল্প-উপন্যাস রচনা করতে গিয়ে বনফুল প্রচুর পরীক্ষামূলক লেখা লেখেন । সংলাপ বর্জিত, কিম্বা শুধুই সংলাপে লেখা যায় কিনা, লেখার মধ্যে হৃদয়াবেগ বাড়ানো কমানো, এমনকি সম্পূর্ণ নৈর্ব্যক্তিক, প্রায় নিরাসক্ত ভাবে লেখা, সুবৃহৎ পরিসর থেকে অতিক্ষুদ্র গল্প - এই সব নিয়েই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন বনফুল । বাঙালী সমাজ তাঁর প্রচেষ্টাকে সম্মানিত করেছেন বিভিন্ন পুরস্কারের দ্বারা, যার মধ্যে রবীন্দ্র পুরস্কার আর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ডি লিট উল্লেখযোগ্য ।
আজকে পাঠ করবো তাঁর অতিক্ষুদ্র বা অনুগল্পের কয়েকটি । এগুলিকে মিনিয়েচার গল্প বলা অতিকথন নয় - ছাপার অক্ষরে এগুলি এক পাতারও কম - কখনো আধ পাতাও নয় । বনফুল যেন পরীক্ষা করে দেখতে চেয়েছেন, কত স্বল্প পরিসরে মানুষের মনে কাহিনী জাগিয়ে তোলা যায়, ফুটিয়ে তোলা যায় ছবি, পাঠকের হৃদয় থেকে আবেগ বার করে আনা যায় । এইরকম বেশ কিছু গল্প লিখেছেন বনফুল । আজ তার মাত্র কয়েকটি পড়বো - পরে বনফুলের স্বাভাবিক দৈর্ঘ্যের গল্প পড়ারও ইচ্ছা রইলো । গল্পের মাঝে ছন্দোপতন না করে, প্রথমেই গল্পগুলির নাম বলে নিচ্ছি - তারপর গল্পগুলি পাঠ করবো, একটি গল্প থেকে আর একটিতে যাবার সময় একটু সঙ্গীতের মাধ্যমে গল্পের শেষ বুঝিয়ে দেবো ।
তার আগে শেষ একটা কথা না বলে পারছি না । বনফুলের গল্পে মৃত্যু এসেছে বারবারই । মৃত্যু যেন একটি চরিত্র । সেই চরিত্র কিন্তু করাল কালান্তক গ্রিম রীপার নয় - যেন নেহাতই সাধারণ এক দূর সম্পর্কের জ্ঞাতি, মাঝে মাঝে গল্পের মধ্যে যার আগমন অন্য চরিত্রের আগমনের মতোই একটা ঘটনা - যার তরঙ্গ অন্য চরিত্রদের জীবনের গতিপথে ঢেউ তুলে যায়, কখনো ওলট-পালট করে দেয় । বনফুলের জন্মসময় ও জীবৎকালে বাংলা-বিহারের তথা ভারতের ইতিহাস খেয়াল করলে মৃত্যুর প্রতি এইরকম নিরাসক্ত ভাব আর তাচ্ছিল্য বোধহয় বুঝতে অসুবিধা হয় না ।
তাহলে আরম্ভ করছি আজকের পাঠ - বনফুলের সাতটি অনুগল্প - "নাথুনির মা", "অমলা", "আত্মপর", "সার্থকতা", "প্রয়োজন", "ভিক্ষুক", "পুকুরে" ।