নমস্কার শ্রোতাবন্ধুরা, "গল্প-কথার আসর"-এর আজকের বৈঠকে যোগদান করার জন্য অনেক ধন্যবাদ । আমি রুদ্র দত্ত । আজ আপনাদের কাছে এমন একটি গল্প উপস্থিত করবো, একাধিকবার যার উল্লেখ এই পডকাস্টে এর আগেই করেছি । গল্পটি বেগম রোকেয়া রচিত "বেগমের স্বপ্ন" । বেগম রোকেয়ার কোনো রচনা এই আসরে এর আগে পাঠ করিনি, তাই তাঁর সম্বন্ধে অল্প কিছু কথা বলে নিয়ে, এবং গল্পটির পটভূমির অল্প উল্লেখ করে, পাঠ আরম্ভ করবো ।
আগেও বলেছি, যে বিশ্বের অন্যান্য ভাষার মতোই, বাংলাতেও বিজ্ঞানভিত্তিক এবং কল্পবিজ্ঞানের গল্প লেখার প্রচলন বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে আরম্ভ, কিন্তু এরও আগে খুব অল্প কয়েকজন বিজ্ঞানকে নির্ভর করে কতিপয় কিছু গল্প রচনা করেছেন । বাংলা সাহিত্যে প্রথম এই পথের প্রদর্শক শান্তিনিকেতনের বিজ্ঞানের অধ্যাপক জগদানন্দ রায়, ১৮৯২ সালে প্রকাশিত তাঁর "শুক্রভ্রমণ" গল্পটি বাংলা সাহিত্যের প্রথম কল্পবিজ্ঞানের গল্প, যা আমরা এই পডকাস্টে পাঠ করেছি ৪৮৩ নম্বর এপিসোডে । প্রায় সমসাময়িকভাবে, ১৮৯৬ সালে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রচিত গল্প "পলাতক তুফান" বাংলা সাহিত্যের দ্বিতীয় কল্পবিজ্ঞানের গল্প, আমাদের পডকাস্টের এপিসোড ২২২ । আর তার অনতিবিলম্বে, বেগম রোকেয়া আজ যে গল্পটি পাঠ করবো সেটি রচনা করেন । রোকেয়া গল্পটি প্রথম রচনা করেন ইংরিজীতে, Sultana's Dream নামে, এবং তা প্রকাশ পায় নারীদের জন্য এবং নারীদের দ্বারা প্রকাশিত প্রথম ভারতীয় পত্রিকা The Indian Ladies Magazine পত্রিকায়, ১৯০৫ সালে । পরে রোকেয়া নিজেই গল্পটিকে বাংলায় অনুবাদ বা আবার রচনা করেন, এবং তা প্রথম প্রকাশ পায় ১৯২২ সালে, "মতিচূর" নামক একটি গল্পসংগ্রহে । অধুনা, কল্পবিশ্ব প্রকাশনী মহিলা লেখকদের লেখা একটি কল্পবিজ্ঞানের গল্পসংকলন প্রকাশ করেছেন, আমি গল্পটি তার থেকেই পাঠ করছি ।
কোনো বাঙালীকেই স্মরণ করাতে হবে না ১৯০৫ সালকে, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় হিসেবে এই বছর অবিস্মরণীয় । কল্পবিজ্ঞানের ইতিহাসেও সময়টা মনে রাখার মতো - পাশ্চাত্য আধুনিক সাহিত্যে বিজ্ঞানভিত্তিক গল্পের জনক জুল ভার্ন তখনো জীবিত, যদিও ওই ১৯০৫ সালেরই মার্চ মাসে তাঁর মৃত্যু; এইচ জি ওয়েলস তখনো তাঁর সাহিত্যিক জীবনের প্রথম দিকে । বাংলা সাহিত্যে কল্পবিজ্ঞানের জোয়ার আসতে তখনো অনেক দেরী - তার কল্লোল প্রথম শোনা গেল ১৯৪০-এ, প্রেমেন্দ্র মিত্রের সৃষ্টিতে, আর জোয়ার এসে গেলো ১৯৬০-এ, সত্যজিৎ রায়, অদ্রীশ বর্ধন, লীলা মজুমদার, প্রমুখ অন্য অনেকের হাত ধরে । কিন্তু ঊষার প্রথম আলো দেখা দিয়েছিলো ঊনবিংশ শতকের শেষ দশকে, এই তিনজন তার পথিকৃৎ ।
এইখানে একটু খটকা লাগে । জগদীশচন্দ্র বসু আর জগদানন্দ রায় দুজনেই ছিলেন বিজ্ঞানসাধক, বিজ্ঞানগুরু । জগদীশচন্দ্র নিজে দিকপাল বৈজ্ঞানিক ছিলেন । দুজনেই সর্বসাধারণের বিজ্ঞানশিক্ষার জন্য বহু প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা করেছিলেন । তাঁদের একটি করে কল্পবিজ্ঞানের গল্প রচনা করা খুব আশ্চর্যজনক হয়তো নয় । কিন্তু বেগম রোকেয়া বিজ্ঞানী ছিলেন না । তিনি হঠাৎ কল্পবিজ্ঞান রচনা করতে কলম তুলে নিলেন কেন ?
এক কথায় বলতে গেলে, তিনি ভবিষ্যৎ-মনস্কা ছিলেন বলে । কল্পবিজ্ঞান তো শুধু তারা লেখে বা পড়ে না যারা বিজ্ঞানের চর্চা করে । কল্পবিজ্ঞানের মধ্যে আসলে যে সম্ভাবনা নিহিত, তা ভবিষ্যতের সম্ভাবনা; কল্পবিজ্ঞানের মধ্যে যে আশা, তা উজ্জ্বলতর ভবিষ্যতের আশা; কল্পবিজ্ঞানের মধ্যে যে ভয়, যে দুশ্চিন্তা, তা ভবিষ্যৎ বিপদ বা দুর্যোগের ভয়-দুশ্চিন্তা । তাই কল্পবিজ্ঞান তারাই লেখে, যাদের চোখ মন ভবিষ্যতের দিকে ফেরানো । সেই বিচারে, রোকেয়ার কল্পবিজ্ঞান রচনায় আশ্চর্য কিছুই নেই; বরং তিনি যে মাত্র একটি কল্পবিজ্ঞানের গল্প লিখেছেন, সেটাই আশ্চর্যের - এবং আক্ষেপের - বিষয় । ভবিষ্যৎ-মনস্কা বললে কমই বলা হয় - বললে ভুল হয়না যে তিনি ছিলেন ভবিষ্যতের বিপ্লবী, মূর্তিমতী ভবিষ্যৎ । তৎকালীন পুরুষশাসিত সমাজে নারীদের অবস্থা যে কতটা শোচনীয়, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে রোকেয়া লিখেছিলেন বহু সমাজতাত্বিক প্রবন্ধ, নিবন্ধ, এবং জ্বালাময়ী প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ । কিন্তু এই একবার, তাঁর সাহিত্যজীবনের গোড়ার দিকে, তিনি চেষ্টা করেছিলেন তাঁর নারীপাঠিকাদের সামনে তুলে ধরতে এক বিকল্প চিত্র, কল্পনার জগতের আশ্রয় নিয়েছিলেন তাদের এক উজ্জ্বলতর ভবিষ্যতের কথা বলে উদ্বুদ্ধ করতে । আর সেই ভবিষ্যতের আবির্ভাবের জন্য তিনি কোনো রূপকথার fairy godmother বা কোনো দৈবী অনুগ্রহের কথা কল্পনা করেননি, বরং কল্পনা করেছেন নারীদের নিজেদের চেষ্টায় নিজেদের মুক্তি । সেই সমাজে পুরুষের স্থান যেভাবে কল্পনা করেছেন, অনুমান করি পুরুষপাঠকদের লজ্জিত করবার জন্যই - আর তৎকালীন পুরুষসমাজে নারীদের স্থান সম্বন্ধে পাঠক-পাঠিকাকে ক্ষুব্ধ করে তুলতে - ঠিক যেমনভাবে পরশুরাম লিখেছিলেন "উলট-পুরাণ" । এই গল্পটি পড়লে সন্দেহ থাকে না যে রোকেয়া কল্পবিজ্ঞান রচনা করার উদ্দেশ্যে কলম ধরেননি - সমাজ সংস্কার করতে কল্পবিজ্ঞানের আশ্রয় নিয়েছিলেন । কিন্তু এই গল্পে বর্ণিত ভবিষ্যতে বিজ্ঞানই ঘটিয়েছে সামাজিক পরিবর্তন - আর তাই থেকেই এই গল্প হয়ে উঠেছে সার্থক কল্পবিজ্ঞান । রোকেয়া হয়তো এই গল্পে বিজ্ঞানকে নিতান্ত প্রয়োজন হিসেবে এনেছিলেন, কিন্তু এই গল্পে বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক খুঁটিনাটি আছে, যেমন আকাশযান বা সৌরশক্তি ব্যাবহার ।
রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জন্ম ১৮৮০ সালে অবিভক্ত বাংলার রংপুর জেলায়, যা এখন বাংলাদেশের অন্তর্গত । ধনী অথচ রক্ষণশীল পরিবারে জন্মগ্রহণ করে রোকেয়া পুরুষশাসিত সমাজের স্পষ্ট চিত্র চোখের সামনে দেখতে পেয়েছিলেন । রোকেয়ার বাবা ছিলেন ধনী এবং ক্ষমতাশীল ব্যক্তি, যিনি নিজে চারবার বিয়ে করেছিলেন । একজন স্ত্রী ছিলেন ইউরোপীয়, সুতরাং বিশ্বের জানালা তাঁর সামনে খোলাই ছিলো বলে বোঝা যায় । রোকেয়ার দুই দাদাকে ইংরিজী মিডিয়ামে স্কুলে পড়িয়েছিলেন, এক দাদা ইব্রাহিমকে উচ্চশিক্ষার জন্য বিলেতেও পাঠিয়েছিলেন । কিন্তু রোকেয়া আর তাঁর দিদির প্রাথমিক শিক্ষারই সুযোগ ঘটেনি - পাঁচ বছর বয়স থেকে মেয়েদের পর্দার পিছনে অন্তরীণ করে রাখাই ছিলো সেই পরিবারের নিয়ম ।
রোকেয়া কিন্তু ছিলেন ব্যতিক্রমী, এবং সাহসিনী । নিজের চেষ্টায়, এবং বড় দাদার সাহায্যে, লেখাপড়া শিখেছিলেন । অল্প বয়সে বিয়ে হয়, কিন্তু স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন ছিলেন সহৃদয় এবং উদারমনা, রোকেয়ার লেখালেখিতে উদ্দীপনা জোগাতেন । সমাজসংস্কারক হিসেবে রোকেয়া যখন লিখে চলেছেন জ্বালাময়ী লেখার পরে লেখা, তখন বোধহয় সেই জন্যেই তাঁর মনে হয়েছিলো যে মেয়েদের উন্নতির এবং মুক্তির একমাত্র পথ হলো সাক্ষরতা এবং উচ্চশিক্ষা । যতদূর বুঝতে পারি, রোকেয়ার বিবাহিত জীবন পোনেরো-ষোলো বছরের বেশী নয় - ১৯০৯ সালে স্বামী পরলোকগমন করেন । রোকেয়া তখন ঝাঁপিয়ে পড়েন আর এক কর্মযজ্ঞে - মেয়েদের জন্য একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন । প্রথমে স্কুলটি ছিলো ভাগলপুরে, পরলোকগত স্বামীর স্মৃতির উদ্দেশ্যে তাঁরই জন্মস্থানে । কিন্তু স্বামীর পরিবারের সঙ্গে মতভেদ হওয়ায় তিনি স্কুলটিকে কলকাতায় সরিয়ে আনেন । বিশেষ করে মুসলমান সমাজে তখন মেয়েদের শিক্ষাদানের চেষ্টা সত্যিই বৈপ্লবিক কাজ ছিলো । স্কুলটি চালানো আর বাঁচিয়ে রাখা রোকেয়ার বাকি সারা জীবনের সংগ্রাম হয়ে দাঁড়ায় । অর্থাভাব, স্কুলের এবং ব্যক্তিগতভাবে রোকেয়ার প্রতি নিন্দা, আক্রমণ, কুৎসা রটনা, এইসবকিছুর মধ্যে দিয়ে রোকেয়া মাথা তুলে থেকে স্কুলটিকে রক্ষা করেছিলেন, আর লিখে গেছিলেন । সে লেখার ফলও ফলেছিলো - সমাজের এক অংশের আক্রমণের একই সঙ্গে বহু লোকে তাঁকে শ্রদ্ধা করতে আর ভালোবাসতে আরম্ভ করেছিলো । শ্রদ্ধার নাম "বেগম রোকেয়া" তাদেরই দেওয়া - ইংরেজ সরকারের বা কোনো মুসলমান সমাজপতির দেওয়া নয় ।
রোকেয়া পাঁচটি ভাষা জানতেন, আরবী, ফারসী, উর্দু, বাংলা, আর ইংরেজী । তখন মুসলমান সমাজে বিদ্বজনেরা উর্দুতেই কাব্য বা সাহিত্য রচনা করতেন, কিন্তু যে সব লেখার লক্ষ্য বাঙালী মুসলমান মেয়েরা, তার জন্য রোকেয়া বোখকরি জেনেশুনেই বাংলা ভাষা বেছে নিয়েছিলেন । বাংলা ভাষা আর বাংলা সাহিত্য তাঁর কাছে ঋণী । বাংলাদেশে পরে তাঁর নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়, ভারতে একটি গ্রন্থাগার আছে তাঁর নামে । ডিসেম্বরের ন তারিখ এখনো বাংলাদেশের বহু বাঙালী রোকেয়া দিবস বলে উদযাপন করেন । আর কলকাতায রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের প্রতিষ্ঠিত, পরলোকগত স্বামীর স্মৃতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত, সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল সেই ১৯১১ সাল থেকে আজও বর্তমান ।
আর এই একটি কল্পবিজ্ঞানের গল্প, য্যর পরে বেগম রোকেয়া আর কল্পবিজ্ঞানের দিকে যাননি, সেটি কিন্তু বহুল সমাদৃত হয়েছে । পত্রিকায় প্রথম প্রকাশের পর বই হিসেবে প্রকাশিত হয় ১৯০৮ সালে, এখনো সেই বই পাওয়া যায় । বেগম রোকেয়ার অনেক লেখার মধ্যে সবথেকে জনপ্রিয় আর পরিচিত হয়ে রয়ে গেছে এইটিই । গত বছর, ২০২৪ সালে, ইউনেস্কো এই গল্পটিকে বিশ্ব-স্মৃতি-সংগ্রহে স্থান দিয়েছেন ।
নারীবাদী সাহিত্যিক, শিক্ষিকা, এবং সমাজসেবিকা বেগম রোকেয়ার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে আরম্ভ করছি আজকের পাঠ, বেগম রোকেয়ার গল্প, "বেগমের স্বপ্ন" ।