শ্রোতাবন্ধুরা, গল্পকথার আসরের আজকে বৈঠকে যোগদান করার জন্য আপনাদের অনেক ধন্যবাদ । আমি রুদ্র দত্ত ।
আজ আপনাদের কাছে নিয়ে আসবো এমন একজন সাহিত্যিককে, যাঁর লেখা আগে এই পডকাস্টে পাঠ করিনি, তাই আজকে তাঁর সম্পর্কে সংক্ষেপে দু-একটি কথা বলে নিয়ে গল্পে যাবো । তাঁর নাম এখনকার বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের মধ্যে অনেকেই হয়তো জানেন না । তিনি রমানাথ রায় ।
আমরা এই পডকাস্টে আগেও বলেছি, কোন সাহিত্যিকের সৃষ্টি তাঁর জীবৎকালে পাঠকদের কাছে কতটুকু পৌঁছলো, পরবর্তীকালে উত্তরসূরীদের কাছে কতটা সুলভ হলো, তা শুধু সেই সাহিত্যের স্বকীয় উৎকর্ষের উপর নির্ভর করে না । সেইসব সাহিত্যকীর্তি প্রথম যেখানে ছাপার অক্ষরে প্রকাশ পেলো, বা পরে যেখানে সংকলিত হলো, তার প্রকাশকের বাণিজ্যিক ক্ষমতা, সেই বই বিজ্ঞাপিত করার আর্থিক ক্ষমতা, লেখকের রাজনৈতিক বিশ্বাস, আত্মপ্রচারের বা প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করার ক্ষমতা বা আকাঙ্খা, অনেক কিছুর উপরই নির্ভর করে । আমাদের ভাবতে ইচ্ছা করে যে কালজয়ী সাহিত্য, যার স্বকীয় মূল্য আছে, তা এইসব অন্তরায়কে ছাপিয়ে উঠে পাঠকের মনে, সমাজের মননে, চিরকালের মতো নিজেদের জায়গা করে নেয় । কিন্তু দুঃখের বিষয় সবসময় তা হয় না । তা হলে রমানাথ রায়ের মতো লেখক আজকের পাঠকের কাছে অপেক্ষাকৃত অপরিচিত থেকে যেতে পারতেন না ।
রমানাথ রায়ের জন্ম ১৯৪০ সালে, কলকাতা শহরে । কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এম. এ. পাশ করেন । স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি যে তাঁর জীবন সম্বন্ধে আর বিশেষ কিছুই আমি জানি না । তাঁর সাহিত্যজীবন সম্পর্কে যেটুকু জানতে পারি তা প্রধানতঃ তাঁর নিজের লেখা "আমার কথা" বলে একটি ছোট্টো নিবন্ধ থেকে, যা বাণীশিল্প প্রকাশনী থেকে ২০০০ সালে প্রকাশিত তাঁর রচনাবলীর ভূমিকা হিসেবে প্রকাশিত হয় । এছাড়া আন্তর্জালে বিভিন্ন বাংলা সাহিত্যমনস্ক কিছু ওয়েবসাইটেও তাঁর সম্বন্ধে কিছু তথ্য পাওয়া যায় । ২০২১ সালে তিনি প্রয়াত হন ।
আমার কাছেও রমানাথ অপরিচিতই ছিলেন । মাত্র কয়েক বছর আগে, এক সুধী বন্ধুর অনুগ্রহে আমি তাঁর সম্বন্ধে জানতে পারি, এবং তাঁর লেখা পড়তে আরম্ভ করি । বন্ধুর অনুরোধ ছিলো এই পডকাস্টে রমানাথের লেখা পাঠ করা; একটু দেরী হলেও আজ তার আরম্ভ করতে পেরে খুশী হচ্ছি ।
একাধিক সূত্র থেকে জানতে পারি, রমানাথকে বাংলা সাহিত্যে শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলনের জনক বলা হয়, কারণ তিনি বলেছিলেন - এবং সপ্রমাণ করেছিলেন - যে বাংলা সাহিত্যে অধিকাংশ যা লেখা হচ্ছে তা জীবনবিমুখ । সাহিত্য তৎকালীন জীবনের কথা, তার সমস্যার কথা, আশা-আকাঙ্খা-ভয়-দুঃখের কথা বলছে না, বরং বহুদিন ধরে সাহিত্যের কাছে পাঠকের যা পেয়ে আসছেন তাকেই একটু নতুন মোড়কে উপস্থিত করছে মাত্র । ১৯৬২ কি ৬৩ সালে তিনি নিজে যখন প্রথম লিখতে আরম্ভ করেন, তখন তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন যে তিনি নিজে সেই দোষ করবেন না । তাই তাঁর লেখা সম্পূর্ণ আলাদা রূপ নিলো - সেরকম রূপ তার আগে বাংলা সাহিত্যে দেখা তো যায়ইনি, পরেও খুব বেশী গেছে কি না সন্দেহ । অথচ সেই দশকে এবং তার আগে সমস্ত বাংলা সাহিত্যজগৎ সরবে - এবং সগর্বে - ঘোষণা করেছে যে সেটা পুরোনোর ছায়া থেকে সরে বেরোনোর যুগ - সেই সময়ের লেখাকে সাহিত্যেকেরা নিজেরাই "বাস্তবধর্মী" বলে চিহ্নিত করেছেন । রমানাথের তরুণ চোখে কিন্তু ধরা পড়ে গেছিলো যে "বাস্তবধর্মী" আখ্যা দিলেই কোনো লেখা বাস্তবধর্মী হয়ে ওঠে না । উপরোক্ত নিবন্ধে তাঁর নিজের কথায় তাঁর সেইসময়কার উপলব্ধির কথা বলা আছে, তার অংশবিশেষ পাঠ করছি -
"লিখতে এসে সাহিত্যেও দেখতে পেলাম আর এক প্রতিকূল পরিবেশ । দেখলাম বাস্তববাদী সাহিত্যের নামে এক ধরণের লেখালেখি চলছে যা না বাস্তব, না সাহিত্য । অধিকাংশ লেখকেরা কল্লোলের লেখকদের অনুকরণ করে চলেছেন । তাঁরা বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত নিচুতলার মানুষদের নিয়ে গল্প-উপন্যাস লেখাকেই ভাবছেন বাস্তবতা, ভাবছেন সাহিত্য । ... আজকের মানুষের সত্যিকারের কোন গভীর সমস্যা বা সঙ্কট সেখানে ফুটে উঠছে না । ... তাঁরা বেছে নেন এক কাল্পনিক গ্রাম, বেছে নেন একাধিক কাল্পনিক দরিদ্র মানুষ । এবং সেইসব দরিদ্র মানুষদের বাস্তব করে তোলার তাগিদে তাদের নাম দেন নিতাই, চরণ, বা ফকির । ... এরপর কোন একটি বা দুটি নারীকে কেন্দ্র করে রচিত হয় চিরপুরাতন রোমাণ্টিক কাহিনী । এঁরা বাস্তব কি তা জানেন না, উপন্যাস কি তা জানেন না । এঁরা কেবলি তারাশঙ্কর অথবা মানিকের অক্ষম অনুকরণ করে চলেছেন, নিজস্বতা কিছু নেই । ... অথচ স্বাধীনতা লাভের পর যে নতুন প্রজন্মের সৃষ্টি হল, তার সঙ্কট কারো লেখায় ধরা পড়ত না । ধনতান্ত্রিক সভ্যতা আজ মানুষকে নিঃসঙ্গ করে তুলেছে, তার চিরকালের আদর্শ ও বিশ্বাসকে কেড়ে নিয়ে সর্বস্বান্ত করে দিয়েছে, তাকে এক ভয়ংকর প্রতিযোগিতার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে, তাকে একটা মুনাফা সৃষ্টির যন্ত্রে পরিণত করেছে । অথচ সে সব দুঃখের কথা ভেবে কাউকে একবারও দীর্ঘশ্বাস ফেলতে দেখতাম না । কিন্তু এঁরা সকলেই নিজেদের সমাজ সচেতন বলে দাবি করতেন।"
এটা লক্ষণীয় যে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা যে বহুমূল্য, এবং সময়োপোযোগী, তা নিয়ে রমানাথের স্পষ্টতই কোনো সন্দেহ ছিলো না । কিন্তু তারো পরে যুগ ও সমাজ পরিবর্তন হয়ে যাবার পরে যারা নতুন দিনের নতুন সমাজের নতুন সংগ্রামের কথা না বলে তারাশঙ্কর অথবা মানিকের অক্ষম অনুকরণ করে চলেছে, রমানাথের অভিযোগ তাদের প্রতি । প্রসঙ্গতঃ, সেইরকম লেখক কিন্তু বাংলা সাহিত্যে পরে আত্মপ্রকাশ করেছেন - এক সময়ে একদিকে আশাপূর্ণা দেবী, অন্যসময়ে অন্যদিকে শীর্ষেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ, বহু লেখকের কথাই আমরা বলতে পারি । কিন্তু সেই মুহূর্তে রমানাথের মনে হয়েছিলো বাংলা সাহিত্যে বড় দৈন্য, এবং তা মোচন করতে নতুন কিছু দরকার ।
সেই লক্ষে তিনি নিজে যখন কলম তুলে নিলেন, তখন আশ্রয় নিলেন এক অন্য ধরণের ভাষার, অন্য ধরণের বাচনভঙ্গীর । এই বিশেষ বাচনভঙ্গীর ব্যবহার যে পরিকল্পিত, তার প্রমাণ আছে তাঁর একটি লেখায়, যাতে তিনি বলেছেন যে বহু ব্যবহারে যে সাহিত্যরীতি জীর্ণ হয়ে গেছে, তার চর্চা করে যাওয়া ইলেকট্রিক বাল্বের আবিষ্কারের পরে আবার নতুন করে তা আবিষ্কার করার চেষ্টার মতোই অর্থহীন ।
তাঁর এই বাচনভঙ্গীর বিশেষত্বকে বিভিন্ন লোকে বিভিন্নভাবে চিহ্নিত করেছেন - absurd, black humor, magic realism ইত্যাদি আখ্যায় । পাঠক হিসেবে আমার নিজের এর মধ্যে magic realism কথাটিকেই সবথেকে লাগসই মনে হয় । Franz Kafka-র লেখার সঙ্গে রমানাথের লেখার অনেক মিল আমি পেয়েছিলাম বলে আমার মনে হয়েছিলো, অবশ্য সেটা কতটা সত্যি কতটা আমার কল্পনা তা জানতাম না - পরে রমানাথের নিজের একটি গল্পে তিনি নিজেই এই তুলনাটি করেছেন দেখে একটু আশ্বস্ত হলাম । আর black humor তো রমানাথের লেখাতে আছেই, তিনি নিজেই লিখেছেন যে -
"দুঃখ মানুষের জীবনে একটা নির্মম সত্য হিসেবে থেকে গেছে এবং থাকবেও । সুতরাং দুঃখের হাতে একটা অসহায় দুর্বল প্রাণীর মত বেঁচে থেকে লাভ নেই । দুঃখের মুখোমুখি দাঁড়ানো প্রয়োজন । কিন্তু কিসের জোরে ? কোন অস্ত্রে ? আস্তে আস্তে বুঝলাম পরিহাস বা কৌতুকই হতে পারে সেই অস্ত্র যার আঘাতে দুঃখের ধার ভোঁতা হয়ে যায় । মারাত্মক কোন দুঃখও হয়ে ওঠে সহনীয় । এবং সব রকমের সামাজিক, রাজনৈতিক, আর্থিক ও আত্মিক বিপর্যয়ের মধ্যে মানুষকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে ।"
আজ তাঁর যে গল্পটি পাঠ করবো, সেটি কবে লেখা আমি জানি না, কিন্তু ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত তাঁর "শ্রেষ্ঠ গল্প" সংকলনে তা স্থান পেয়েছিলো, কাজেই তার আগের তো বটেই । গল্পটি সম্পূর্ণভাবে দুটি লোকের কথোপথনের মধ্যে দিয়ে বলা । তার একজন ব্যাক্তি, এবং অন্যজন সমাজপ্রতিরূপ, এইরকমটাই মনে হয় । এই গল্পে black humor-ই প্রধান, না magic realism, তা আপনারাই ঠিক করুন, শ্রোতাবন্ধুরা । তবে গল্পে কুকুরের বদলে অন্য কোনো প্রাণীর কথা মনে করলে হয়তো এই গল্পকে নিছক realism বলেও মনে হতে পারে - গল্পে বর্ণিত প্রাণীসকলের ফিরিস্তির মধ্যে তার নাম বাদ পড়াটাও লেখকের ইচ্ছাকৃত কি না তাও আপনারাই ঠিক করবেন । তাই এই গল্প সামাজিক ব্যঙ্গ, না আধুনিক সমাজের চাপে মানুষের মস্তিষ্কবিকারের গল্প, না কি, আমি জোর দিয়ে বলতে পারি না ।
রমানাথ রায়ের গল্প এই পডকাস্টে এরপর মাঝে মাঝেই পাঠ করার ইচ্ছ রইলো । আজকের গল্প পাঠ করার আগে রমানাথের জীবনে সাহিত্যের স্থান কোথায় তা নিয়ে তাঁর একটি উক্তি পাঠ করতে ইচ্ছা করছে -
"সাহিত্যিক হব বলে আমি কোনদিন সাহিত্য করিনি । সাহিত্য আমার কাছে শুধু বেঁচে থাকার আশ্রয় নয়, জীবনযুদ্ধে টিকে থাকারও অস্ত্র । তাই কৈশোর থেকে সাহিত্য ছাড়া অন্য কাউকে আমার সঙ্গী করিনি । আজো প্রতিমুহূর্ত পার হচ্ছে সাহিত্যকে কেন্দ্র করেই । সাহিত্য ছাড়া অন্যকিছু আমি ভাবি না, ভাবতে আনন্দও পাই না । ধার্মিকের কাছে যেমন ঈশ্বর, আমার কাছে তেমনি সাহিত্য।"
সাহিত্যসাধক রমানাথ রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর গল্প পাঠ আরম্ভ করছি । আজকের পাঠ, রমানাথ রায়ের গল্প, "ফাঁসির আগের দিন" ।