নমস্কার শ্রোতাবন্ধুরা, গল্পকথার আসরের আজকে বৈঠকে যোগ দেবার জন্য আপনাদের অজস্র ধন্যবাদ । আমি রুদ্র দত্ত । আজ যাঁকে আপনাদের সামনে নিয়ে আসবো, তাঁর নামের সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত - কিন্তু সাহিত্যিক বা গল্পকার হিসেবে বোধহয় নয় । তিনি একজন বৈজ্ঞানিক - এবং সত্যিই জগদ্বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক । শুধু বাঙালী বা ভারতীয়দের কাছে নয়, বিজ্ঞানের জগতে যে স্বল্প কয়েকজন বাঙালীর নাম আজ অবধি বিশ্ববিখ্যাত, তিনি তাদের একজন । তিনি আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু ।
বৈজ্ঞানিক জগদীশচন্দ্র বসুর সম্বন্ধে বলতে আরম্ভ করলে অনেক কিছুই বলতে হয় - সংক্ষেপে বলতে চেষ্টা করছি । ১৮৫৮ সালে অবিভক্ত বাংলার মুনশীগঞ্জে জন্ম, কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে এবং পরে লন্ডন ও কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা, তারপর প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনা ও গবেষণা । বেতারতরঙ্গ অর্থাৎ রেডিও নিয়ে গবেষণা, বেতার সহযোগে বহুদূরে সংকেত পাঠানোর পরিকল্পনা এবং সারা পৃথিবীর মধ্যে তার সর্বপ্রথম বাস্তব রূপায়ণ, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুরই কীর্তি । অবশ্য বহুদিন অবধি ইউরোপের তথা পাশ্চাত্যের অনেকে বিশ্বাস করতে ভালোবাসতেন যে ইতালীয় বৈজ্ঞানিক মার্কনিই বেতারের আবিষ্কারক, কিন্তু লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটির নথিপত্রে ১৮৯৯ সালে জগদীশ বসুর এই আবিষ্কার এবং তার প্রত্যক্ষ প্রদর্শনের কথা লেখা আছে, স্বয়ং লর্ড রালে - যিনি নিজে পদার্থবিদ্যার একজ্ন দিকপাল - জগদীশ বসুর বেতার গবেষণার কথা ঘোষণা করেন - অর্থাৎ মার্কনির সফল এক্সপেরিমেন্টের প্রায় দু বছর আগে । অনেকেই বোধহয় জানেন, কিছু বছর আগে বিজ্ঞান ও কারিগরীবিদ্যায় বর্তমান পৃথিবীর সর্ববৃহৎ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান, ইনস্টিটিউট অফ ইলেকট্রনিক অ্যান্ড ইলেকট্রিক্যাল এঞ্জিনিয়ার্স, জগদীশ বোসের এই কৃতিত্বের স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠানের প্রোসিডিং, অর্থাৎ কার্যবিবরণীতে ঘোষণা করেন, এবং জগদীশ বোসকে বেতারবিজ্ঞানের জনক আখ্যা দেন । এই মর্মে প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ কলকাতায় একটি স্মৃতিফলকও প্রতিষ্ঠা করে যান । জগদীশ বোসের নিজের হাতে প্রতিষ্ঠিত বোস ইনস্টিটিউট, বা বসু বিজ্ঞান মন্দিরে ফলকটি রক্ষিত আছে । প্রসঙ্গতঃ, এই বসু বিজ্ঞান মন্দির ভারতের প্রাচীনতম গবেষণাকেন্দ্রের মধ্যে একটি ।
পদার্থবিদ্যা ছাড়াও উদ্ভিদবিদ্যাতে জগদীশ বোস অমর কীর্তি রেখে গেছেন । উদ্ভিদের দেহ প্রাণীদেহের মতোই সংবেদনশীল, দৃষ্টিগোচর না হলেও উদ্ভিদের দেহে বেদনার সাড়া জাগে, তা জগদীশ বসুর গবেষণার আগে মানুষ কোনোদিন সন্দেহ করেনি । তাঁর নিজেরই আবিষ্কৃত ক্রেস্কোগ্রাফ যন্ত্রের দ্বারা তিনি তার প্রমাণ দেন ।
পরাধীন ভারতবর্ষে ভারতীয় বৈজ্ঞানিকের পক্ষে যতদূর সার্থক হওয়া সম্ভব ছিলো, প্রচুর অন্তরায় সত্ত্বেও প্রবল অধ্যবসায়ের দ্বারা জগদীশ বসু যেন তার থেকেও বেশীই হতে পেরেছিলেন । ক্ষোভও যে একেবারে ছিলো না তাও হয়তো নয়, সে প্রসঙ্গে হয়তো অন্য একদিন আলোচনা করার সুযোগ হবে । কিন্তু নিজের জীবনে এতো সার্থকতার পরেও, তাঁর শিক্ষকতার সার্থকতা, এবং ভবিষ্য ভারতবর্ষের শিক্ষা ও গবেষণাব্যবস্থার প্রতি তাঁর অবদান, হয়তো আরো মূল্যবান । সেইজন্যই, যদিও ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে নাইটহুড বা "স্যর" উপাধিতে ভূষিত করেন, বাঙালী তাঁকে আচার্য বলেই সম্মান করেছে, মনে রেখেছে । তাঁর শেষ জীবন কাটে তৎকালীন বিহার এবং বর্তমান ঝাড়খন্ডের গিরিডি শহরে । সত্যজিৎ রায় তাঁর প্রোফেসর শঙ্কু চরিত্রের বাসস্থান হিসেবে গিরিডিকেই বেছে নিয়েছিলেন এই কারণেই, সহজেই অনুমান করা যায় ।
ঊনআশি বছর বয়সে, ভারতের স্বাধীনতা লাভের ঠিক দশ বছর আগে, গিরিডিতেই মারা যান আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু ।
আমাদের গল্পকথার আসরে এই স্বনামধন্য বৈজ্ঞানিককে নিয়ে এসেছি কিন্তু তাঁর সাহিত্য প্রতিভার কারণে । খুবই অল্প সাহিত্য রচনা করেছেন জগদীশচন্দ্র, কিন্তু সাধুভাষায় হলেও তা এতই সাবলীল, যে আপশোষ হয় তিনি আরো কিছু লিখে গেলে কতো ভালো হতো সেই কথা ভেবে । তাঁর একটি রচনা মাঝখানে কিছুদিন বঙ্গীয় শিক্ষা পর্ষতের পাঠ্যপুস্তকে ছিলো, তাই শ্রোতাদের মধ্যে কেউ কেউ নিশ্চয়ই সেটির সঙ্গে পরিচিত । তার ভাষা ও ভাব খুবই সুন্দর, আসরের পরের কোনো বৈঠকে সেটি পাঠ করার আশা রইলো । কিন্তু আজ পাঠ করবো তাঁর লেখা একটি বিজ্ঞাননির্ভর গল্প । গল্পটির নাম "পলাতক তুফান" - প্রথম প্রকাশে গল্পটি অন্য নামে প্রকাশিত হয়েছিলো, এবং কিছুটা সংক্ষিপ্ত ছিলো । ১৮৯৬ সালে লেখা এই গল্পটি এক হিসেবে বাংলা ভাষার প্রথম সায়ান্স ফিকশন । তার আগে একটি দুটি গল্প লেখা হয়েছিলো বটে যাকে কল্পবিজ্ঞানের গল্প বলা চলে । কিন্তু তাতে বিজ্ঞানের পরিমাণ কমই ছিলো । সায়ান্স ফিকশন বলতে যদি বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প বুঝি, তাহলে নিঃসন্দেহে পলাতক তুফানের একটি বিশেষ স্থান আছে । বিভিন্ন তরল পদার্থে সারফেস টেনশন বা পৃষ্ঠ টানের যে প্রয়োগের কথা এই গল্পে লেখক ব্যবহার করেছেন, তা কিন্তু একেবারেই বাস্তব । তবে যেটুকু জিনিষের প্রভাবে যা ফলের কথা গল্পে আছে, তা নিছক উপহাসাত্মক অত্যুক্তি । এই গল্পের বৈঠকী, আড্ডাবাজ মেজাজের সঙ্গেও তা খাপ খেয়ে যায়, গল্পটিকে ঘনাদার গল্পের সঙ্গে তুলনা করতে ইচ্ছা করে । যতদূর জানি, কোনো হেয়ার অয়েল অর্থাৎ কেশতৈল তৈরীর কোম্পানী তাঁদের নিজেদের প্রচারের কারণে কেশতৈল নিয়ে গল্প রচনা আহ্বান করেছিলেন, তার থেকেই এই গল্পের জন্ম । জগদীশচন্দ্র যে গল্পটি ঠাট্টার মেজাজেই লেখেন, তাতে সন্দেহ নেই ।
কিন্তু সে বিচার আপনারাই করবেন । আর কথা না বাড়িয়ে আরম্ভ করছি আজকের পাঠ, সাহিত্যিক জগদীশচন্দ্র বসুর বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প, "পলাতক তুফান" ।