শ্রোতা বন্ধুরা, গল্পকথার আসরের আজকের অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য অশেষ ধন্যবাদ । আমি রুদ্র দত্ত ।
বন্ধুবর রাজীব পডকাস্টের দ্বিতীয় পর্বের সূচনা করেছে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে । আমি যে পরশুরামের গল্প পড়ে আরম্ভ করবো, তা আগেই বলেছি । পরশুরাম সম্পর্কে, আমাদের প্রথম পর্বের শেষকালে, অল্প কিছু কথা বলেছি । আজকে পরশুরামের দুটি অনুগল্প পাঠ করবো । আর তার আগে পরশুরাম সম্পর্কে আর একটু বিস্তারিত ভাবে বলে নিতে ইচ্ছা করছে ।
পিতৃদত্ত নাম রাজশেখর বসু - শোনা যায়, দ্বারভাঙ্গার রাজার আশীর্বাদের স্মরণে তাঁর এই নামকরণ - কিন্তু স্বনির্বাচিত নাম পরশুরাম । পরশুরাম এবং রাজশেখর বসু দুজনেই কিন্তু লেখক, কিন্তু দুজনের রচনাক্ষেত্র আলাদা ! রাজশেখর বসুর সবকটি সৃষ্টিই প্রধানতঃ মনীষার পরিচায়ক - অর্থাৎ cerebral - বাংলা সাহিত্যে যার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । তার মধ্যে আছে দুটি ভাবানুবাদ - রামায়ণ এবং মহাভারত - আর আছে চলন্তিকা - এমন এক অভিধান যার ঠিক কোনো বিকল্প আজও হয়নি । এই তিনটি সৃষ্টিতেই পরিষ্কার লক্ষ করা যায়, যে বইগুলি বিষয়ানুপাতে বেশ ছোটো, অথচ নেহাত না খুঁজলে কোনো অসম্পূর্ণতা সহজে চোখে পড়ে না । স্রষ্টার জ্ঞানগরিমার প্রকাশ প্রধান উদ্দেশ্য হলে এই তিনটি বই আরো কতো বড় হতো বলা শক্ত । নিজেকে সরিয়ে রেখে, পাঠকের সুবিধার কথাই প্রধানতঃ মনে রেখে, এই তিনটি অমূল্য উপহার । এছাড়াও বেশ কিছু প্রবন্ধ, ভারতের খনিজ ও কুটিরশিল্প বিষয়ক নিবন্ধ, ছোটোদের জন্য হিতোপদেশের গল্প, আর কালিদাসে মেঘদূতের একটি অনুবাদ ।
কিন্তু আমাদের আসর হলো গল্পকথার, তাই আমরা পরশুরামের প্রতিই বেশী মনোযোগ দেব ।
পরশুরামের সাহিত্যের কথা বলার আগে তাঁর সম্বন্ধে কিছু তথ্য ঝালিয়ে নিই । জন্ম ১৮৮০ খ্রীষ্টাব্দে, বর্ধমান জেলার একটি ছোটো গ্রামে । বাবা চন্দ্রশেখর বসু যাকে ইংরিজীতে বলে self-made man - অতি সামান্য অবস্থা থেকে আরম্ভ করে যোগ্যতার গুণে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন । যশোর জেলায় সামান্য ডাক-বিভাগ কর্মচারী অবস্থাতে, নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিষয়ে অনুসন্ধান করে চন্দ্রশেখর কলকাতায় রিপোর্ট পাঠিয়েছিলেন - চাকরি-বাকরির মায়া না করেই । সেই রিপোর্ট কলকাতায় ইন্ডিগো কমিশনের তদন্তে এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল হয়ে দাঁড়ায় । রাজশেখরের নিজের অধ্যবসায়, সমাজসচেতনতা, আর ঋজুতায় আশ্চর্য হবার কিছুই নেই ।
যশোরের পরে, বাবা দ্বারভাঙ্গার মহারাজ লক্ষ্মীশ্বর সিং-এর ম্যানেজার ছিলেন দীর্ঘদিন । রাজশেখরের ছোটোবেলা তাই বেশীরভাগই কেটেছে বাংলার বাইরে; প্রথমে মুঙ্গের জেলার খড়্গপুরে, তারপর এন্ট্রান্স পরীক্ষা অবধি দ্বারভাঙ্গার রাজ স্কুলে, তারপর পাটনা কলেজে ফার্স্ট আর্টস, ১৮৯৭ সালে পাটনার পর্ব চুকিয়ে কলকাতায় পদার্পন, প্রেসিডেন্সি কলেজে বিজ্ঞান শাখায় বি. এ. পড়ার জন্য । এইসময়ে কিছুদিন আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর কাছে পড়ার সুযোগ পান । ১৮৯৯ সালে বি. এ., এবং ১৯০০ সালে এম. এ. পাশ করেন, কেমিস্ট্রিতে প্রথম স্থান । অন্য অনেকের মতোই এরপরে আইন অধ্যয়ন করে দু-বছর বাদে বি. এল. পরীক্ষাটিও পাশ করে যান - কিন্তু আইনব্যবসায় না ঢুকে রসায়নশাস্ত্রেই মনোনিবেশ করেন । ১৯০৩ সালে সাক্ষাৎ হয় আর এক মহামনীষী আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সঙ্গে, আর রাজশেখর বহাল হন বেঙ্গল কেমিক্যাল ওয়ার্কসের রাসায়নিক পদে । এক বছরের মধ্যেই ম্যানেজার, আরো দুবছর বাদে এই স্বদেশী প্রতিষ্ঠানের সর্বময় কর্তৃত্বের ভার এলো তাঁর ওপর । তারপর পঁচিশ বছরেরও বেশী সেই ভার বহন করে, বেঙ্গল কেমিক্যালসের প্রচুর উন্নতিসাধন করে, ভারতের অন্যতম industrial chemist অবসর গ্রহণ করেন । আরো প্রায় তিরিশ বছর বেঁচে ছিলেন ।
পরিষ্কার ফুটে ওঠে এক মেধাবী ছাত্রের দেশহিতৈষী কর্মজীবনচরিত । কিন্তু সাহিত্যিক কোথায় গেলেন ?!
সাহিত্যিক আত্মপ্রকাশ করেন অনেক পরে - আশি বছরের জীবনের বেয়াল্লিশ বছর অতিক্রান্ত হয়ে যাবার পর । আত্মপ্রকাশ অবশ্য ছদ্মনামের আড়ালে - ১৯২২ সালে "শ্রীশ্রীসিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড" গল্পের প্রকাশ দিয়ে । স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন পরশুরামের প্রথম গল্প-সংকলন "গড্ডলিকা"-র সমালোচনা লিখছেন দু-বছর পরে, আরো চারটি গল্প প্রকাশের পরে, তখনও তিনি জানেন না কে পরশুরাম - নির্ভুল অনুমানে লিখছেন, "... সহসা ইহার অসামান্যতা দেখিয়া চমক লাগিল । চমক লাগিবার হেতু এই যে, এমন একখানি বই হাতে আসিলে মনে হয় লেখকের সঙ্গে দীর্ঘকালের পরিচয় থাকা উচিত ছিলো । সকালে হঠাৎ ঘুম ভাঙিয়া যদি দ্বারের কাছে দেখি একটা উইয়ের ঢিবি, আশ্চর্য ঠেকে না; কিন্তু যদি দেখি মস্ত একটা বট গাছ তবে সেটাকে কি ঠাহরাইব ভাবিয়া উঠা যায় না । লেখক পরশুরাম ছদ্মনামের পিছনে গা ঢাকা দিয়াছেন । ভাবিয়া দেখিলাম, চেনা লোক বলিয়া মনে হইল না, কেননা লেখাটার উপর কোনো চেনা হাতে ছাপ পড়ে নাই । নূতন মানুষ বটে সন্দেহ নাই, কিন্তু পাকা হাত ।"
১৯৩২-এ অবসর গ্রহণের পরে যে মানুষ বারো বছর বয়সের আগে বাংলা শেখেননি, তিনি বাংলা ভাষার আরাধনায় যেন নিজেকে নিয়োগ করলেন । রাজশেখর বসু হলেন বাংলা ভাষা সংস্কার ও পরিভাষা-কমিটির অধিনায়ক, বাংলা লিনোটাইপ স্রষ্টা, রামায়ণ-মহাভারতের অনুবাদক, অভিধান রচয়িতা - আর পরশুরাম গল্প লিখে চললেন । এক এক করে জীবৎকালে ঠিক একশোটি গল্প লেখেন পরশুরাম । অন্য অনেকে সাহিত্যিকের তুলনায় কমই বলতে হবে - শুনেছি তাঁর লেখা সম্বন্ধে নিজেই বলতেন, "সের দুই" - কিন্তু বাংলা সাহিত্যে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ । পরশুরাম-রচিত কাহিনী আর চরিত্র তার পরের বাংলা সাহিত্যে প্রচুর প্রভাবে ফেলেছে - পরের যুগের স্রষ্টারা জেনে এবং না জেনে সেসব কাহিনী ও চরিত্রের বুনিয়াদে কত কিছু সৃষ্টি করেছেন । উলট-পুরাণ আর ভূশন্ডীর মাঠ বাংলা সংস্কৃতিতে স্থায়ী পটভূমিকা রচনা করেছে - বিরিঞ্চিবাবা, মহেশ মিত্তির, আর জাবালির কথা কান পাতলেই আজও শোনা যায় । অজস্র নাটক ও শ্রুতিনাটক পরশুরামের গল্পকে নির্ভর করেছে, স্বীকৃতি দিয়ে থাক বা না থাক পরশুরামের তাতে এসে যাচ্ছে না । স্বয়ং সত্যজিৎ রায় দু-দু-বার পরশুরামের গল্প অবলম্বন করে সার্থক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন । আরো অনেক কাহিনী পড়ে আছে উত্তরসূরীদের প্রেরণা দেবার জন্য ।
এর কারণ বোধহয় পরশুরামের গল্পের ভিতরের কথা । গল্পগুলো হাসির গল্প সন্দেহ নেই - মুচকি হাসি থেকে পেটে খিল লাগানো হো হো হাসি সবই আছে তাতে । কিন্তু সেই হাসির পিছনে সবসময় রয়েছে সমাজচেতনা, সমাজসমালোচনা, এবং স্পষ্ট ব্যঙ্গ । এই satire অনেকসময় সূক্ষ্ম, আবার অনেকসময় অতি প্রকট - কিন্তু পরশুরামের যাদুতে তা পড়ার মুহূর্তে পাঠকের নিজের গায়ে যেন কখনো লাগে না । মনে হয় অন্য লোককে উদ্দেশ্য করে ব্যঙ্গ - পাঠক সে হাসির ভাগীদার । পরে অবসরসময়ে হয়তো সুধী পাঠকের খেয়াল হয় - আমার নিজেরও তো এই দোষগুলো আছে । হাসির থেকেও, হয়তো তাতেই পাঠকের সবথেকে বেশী লাভ হয় ।
ব্যঙ্গ করার জন্য কখনো সখনো ফ্যান্টাসীর আশ্রয় নিলেও, পরশুরামের গল্পের প্রধান গুণ তার অতি সাধারণ বাস্তব চরিত্র - সেইজন্যেই বোধহ্য় হাসিও সহজে আসে, আর satire-টিও যখন খেয়াল হয় তখন তা হয়ে ওঠে মোক্ষম । আগেই বলেছি, রবীন্দ্রনাথ "গড্ডলিকা"-র সমালোচনা লিখেছিলেন - যাকে সমালোচনা না বলে প্রশংসাপত্র বললেই ঠিক হয়; তাতে তিনিও বলেছেন -
"... পরশুরাম নামটা শুনিয়া পাঠকের সন্দেহ হইতে পারে যে লেখক বুঝি জখম করিবার কাজে প্রবৃত্ত । কথাটা একেবারেই সত্য নহে । বইখানি চরিত্র চিত্রশালা । মূর্ত্তিকারের ঘরে ঢুকিলে পাথর ভাঙার আওয়াজ শুনিয়া যদি মনে করি ভাঙ-চোরাই তাঁর কাজ তবে সে ধারণাটা ছেলেমানুষের মত হয় - ঠিকভাবে দেখিলে বুঝা যায় গড়িয়া তোলাই তাহার ব্যবসা । মানুষের সুবুদ্ধি বা দুর্বুদ্ধিকে লেখক তাঁহার রচনায় আঘাত করিয়াছেন কিনা সেটা তো তেমন করিয়া আমার নজরে পড়ে নাই । আমি দেখিলাম তিনি মূর্ত্তির পর মূর্ত্তি গড়িয়া তুলিয়াছেন । এমন করিয়া গড়িয়াছেন যে, মনে হইল ইহাদিগকে চিরকাল জানি । এমন কি, তাঁর ভূষণ্ডীর মাঠের ভূতপ্রেতগুলোর ঠিকানা যেন আমার বরবারকার জানা; এমন কি, যে পাঁঠাটা কন্সর্টওয়ালার ঢাকের চামড়া ও তাহার দশটাকার নোটগুলো চিবাইয়া খাইয়াছে সেটাকে আমারই বাগানের বসরাই গোলাপ গাছ কাঁটাসুদ্ধ খাইতে দেখিয়াছি বলিয়া স্পষ্ট মনে পড়িতেছে । ..."
আর এই চরিত্রচিত্রণের সঙ্গে সঙ্গে উল্লেখ করতে হয় পরশুরামের ভাষার । প্রমথনাথ বিশী পরশুরাম প্রসঙ্গে লিখছেন - "এমন পরিচ্ছন্ন, বাহুল্য বর্জিত, সুপ্রযুক্ত ভাষা বড় দেখা যায় না । পাঠক-সমাজ যখন সবুজপত্রী ভাষাকে প্রগতির চরম লক্ষণ বলে ধরে নিয়েছিলো, ভেবেছিলো সাধু ভাষার আয়ু শেষ হয়ে গেছে, নূতন কোনো সম্ভাবনা আর তার মধ্যে নেই, তখন গড্ডলিকা কজ্জ্বলীর ভাষা দেখে সকলে চমকে গেলো । ... বস্তুতঃ পড়বার সময় খেয়াল থাকে না এ ভাষা সাধু কি কথ্য, পরে হিসাবে দেখা যায় সাধু ভাষা ।"
আর একটা কথা বলে শেষ করি । রাজশেখের বসুর প্র-দৌহিত্র দীপঙ্কর বসুর লেখায় পাচ্ছি পরশুরাম সম্বন্ধে আর এক গুণী সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলীর উক্তি । মুজতবা আলীর গল্প প্রথম পর্বে পাঠ করেছি - তাঁর সম্বন্ধে স্বল্প আলোচনাও করেছি; কত ভাষায় কত পান্ডিত্য অর্জন করেছিলেন তাও আমাদের অজানা নেই । তিনি পরশুরাম সম্বন্ধে লিখছেন - "আমি পৃথিবীর কোনো সাহিত্য আমার পড়া থেকে বড় একটা বাদ দিইনি । রাজশেখরবাবু যে কোনো সাহিত্যে পদার্পণ করলে সে সাহিত্য ধন্য হতো । একথা বলার অধিকার আমার আছে ।" দীপঙ্কর বসুর লেখাতেই জানতে পারি, মুজতবা আলী সাক্ষাতে পরশুরামকে বলেছিলেন, "আপনার সমস্ত পান্ডুলিপি যদি হারিয়ে যায়, আমাকে বলবেন; আমি স্মৃতি থেকে সমস্ত লিখে দোব ।"
এরও পরে আমার আর কিছু বলতে যাওয়া অর্বাচীন হবে । আমার বক্তব্য তাই এখানেই শেষ করছি । এইবারে গল্প পাঠ । আজকে পরশুরামের ছোট্ট ছোট্ট দুটি গল্প, যাকে অনুগল্প বলাই ভালো, পাঠ করবো । সেই দুটি গল্প কাছাকাছি সময়ে রচিত - দুটির রচনাকালই ১৯২৯ সাল । একটির নাম "উপেক্ষিত", অন্যটির নাম "উপেক্ষিতা" । এবং দুটির থিম-এও মিল লক্ষ করবেন - তবে একটি বাদশাহী আমলের গল্প, অন্যটি বালিগঞ্জে, সমকালীন ।
প্রথমে পাঠ করছি "উপেক্ষিত", তার পরে "উপেক্ষিতা" ।