নমস্কার শ্রোতাবন্ধুরা, গল্প কথার আসরের আজকের বৈঠকে যোগদান করার জন্য আপনাদের অশেষ ধন্যবাদ । আমি রুদ্র দত্ত । আজকের এই এপিসোড থেকে শুরু করছি একটি শ্রুতিপুস্তকের পাঠ - হেমেন্দ্রকুমার রায়ের ছোটোদের জন্য রচিত জয়ন্ত-মানিকের অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাস - "পদ্মরাগ বুদ্ধ" ।
হেমেন্দ্রকুমার রায়ের অনেক লেখা আমরা আগে এই পডকাস্টে পাঠ করেছি, তাঁর সম্বন্ধে কিছু কথাও আপনাদের কাছে বলেছি । নতুন করে আর কিছু বলার প্রয়োজন নেই; এই যে বইটি পড়বো, তার সম্পর্কে সংক্ষেপে একটু বলে নিই ।
এই বইটি আমার নিজের খুব ছোটোবেলার খুব প্রিয় একটি বই । সেইজন্যেই এই বইটি আমাদের পডকাস্টে পাঠ করার কথা প্রথমে মাথায় আসে - কিন্তু শিশুসাহিত্য হিসেবে এই উপন্যাসের নিজস্ব দাবীও কম নয় একেবারেই । হেমেন্দ্রকুমার রায়ের দীর্ঘ লেখক জীবনের একেবারে প্রথমে না হলেও, মোটামুটি প্রথম দিকেরই লেখা । জয়ন্ত আর মানিককে নিয়ে লেখকের প্রথম উপন্যাস - এবং অনেকের মতেই হেমেন্দ্রকুমারের শ্রেষ্ঠ একটি রচনা - হলো "জয়ন্তের কীর্তি"; যতদূর জানতে পারি, ১৯৩৭ খ্রীষ্টাব্দে এই উপন্যাস রচিত । আর তার পরে পরেই, পরের বছর অর্থাৎ ১৯৩৮ সালে, প্রকাশিত হয় "পদ্মরাগ বুদ্ধ" ।
এই পডকাস্টে প্রথমবার যখন জয়ন্ত-মানিকের গল্প পড়েছিলাম - আমাদের দ্বিতীয় সীজনে, "ব্রহ্মরাজের পদ্মরাগ" গল্পটি পাঠ করেছিলাম - তখন বলেছিলাম যে জয়ন্ত আর মানিক সমাজবিমুখ মস্তিষ্ক-সর্বস্ব গোয়েন্দা নয় - বরং তাদের মধ্যে দিয়ে হেমেন্দ্রকুমার বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের নব্য বাঙালী যুবার আদর্শ ছবি দেখতে চেয়েছেন, দেখাতে চেয়েছেন । তাদের পা দেশের মাটিতে, কিন্তু দুচোখে বিশ্বের আলো । তাই জয়ন্ত আধুনিক পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের সম্বন্ধে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল - বৈজ্ঞানিক অপরাধী ভবতোষকে ধরার তার প্রথম কীর্তিতে তার পরিচয় আছে । আবার তাইজন্যই নিজের দেশের ও সংস্কৃতির সম্বন্ধে জয়ন্ত আর মানিক সচেতন, এবং শ্রদ্ধাশীল । "পদ্মরাগ বুদ্ধ" উপন্যাসে তার পরিচয় আছে । শুধু তাই নয়, বিদেশী বর্জনের আদর্শ, আর দেশী কৃষ্টির গুণগ্রাহিতা, জয়ন্ত-মানিকের প্রধান পরিচয়ের মধ্যে পড়ে । এই উপন্যাসের গোড়াতেই বাগবাজার আর পার্ক স্ট্রীট নিয়ে যে ঘটনাটি আছে, কাহিনীর দিক থেকে তার কোনো বিশেষ প্রয়োজন ছিলো না । হেমেন্দ্রকুমার তার অবতারণা করেছেন নেহাত সেই কথাগুলি শুনিয়ে দেবার জন্যই, তা পরিষ্কার বোঝা যায় ।
প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঘনাদার গল্প পড়তে গিয়ে অনেকবার বলেছি, গল্পগুলির ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক, বৈজ্ঞানিক, সামাজিক, রাজনৈতিক পটভূমিকা আশ্চর্যরকম যথাযথ ও নির্ভুল, এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনায় সমৃদ্ধও বটে । গল্পগুলি পড়লে একাধারে গল্পের রস পাওয়া যায়, আবার শিক্ষালাভও হয় বটে - পাঠ্যপুস্তকের থেকে বেশী বই কম নয় । এই একই কথা মনে পড়ে "পদ্মরাগ বুদ্ধ" উপন্যাসে ওঙ্কারধাম - বা বর্তমানে স্বীকৃত উচ্চারণ আঙ্কর থম - সম্পর্কিত বর্ণনা পড়লে । তার পরিচয় বইয়ের মধ্যেই আছে । সপ্তম পরিচ্ছেদ, "পাথরের সিনেমা"-র গোড়াতেই একটি পাদটীকা বা ফুটনোটে হেমেন্দ্রকুমার লিখে দিয়েছেন, "ওঙ্কারধাম সম্বন্ধে এ উপন্যাসে যা বলা হয়েছে তা লেখকের কপোলকল্পিত নয় । অধিকাংশই প্রমাণিত ঐতিহাসিক সত্য । - ইতি লেখক ।" পরে আর একটি জায়গায়, যখন অমলবাবু যশোধরপুরে মরকত বুদ্ধের সম্ভাব্য প্রতিষ্ঠার কথা মানিককে বলছেন, তখন পাদটীকায় হেমেন্দ্রকুমার একটি উদ্ধৃতি দিয়েছেন - "And in Yasodharpura, which is the Great Capital of the Khmer people and the finest city in all of Asia, there is a statue of the Lord Buddha sitting upon the coiled cobra which is the emblem of that race. And this statue was fashioned out of emeralds so cunningly matched and cemented together that the whole work seems as one solid emerald and shines with a green light so intense that none but the faithful may look upon it." পড়ে মনে হয়, কোনো প্রাচীন পর্যটকের প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ থেকে নেওয়া উদ্ধৃতিটি । দুঃখের বিষয়, উদ্ধৃতিটি কার লেখা থেকে, তা পাদটীকায় লেখা নেই - অন্ততঃ এশিয়া পাবলিশিং প্রকাশনার হেমেন্দ্ররচনাবলীর ১৯-তম খন্ড, যার থেকে আমি উপন্যাসটি পাঠ করছি, তাতে নেই । আমার ছোটোবেলার নিজের বইটি যে কবে কোথায় উধাও হয়েছে তা কে জানে । আমার অনুমান, একাদশ শতাব্দীর চৈনিক পরিব্রাজক ঝু দাগুয়ান রচিত কাম্বোডিয়া বিষয়ক গ্রন্থটির থেকেই হেমেন্দ্রকুমার এই কথাগুলি উদ্ধৃত করেছেন, কারণ কাম্বোডিয়ার সম্বন্ধে এইটিই একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ । কত গবেষণা করে, কত পড়াশুনা করে, হেমেন্দ্রকুমার বা প্রেমেন্দ্র মিত্রের মতো লেখকেরা এক একটি গল্প উপন্যাস রচনা করেছেন তা ভাবলে কৃতজ্ঞতায় মাথা নত হয়ে আসে । শিশুদের মনোরঞ্জন করে, বা শিশুমনকে উত্তেজিত করে বইএর কাটতি বাড়ানোর জন্য এত কষ্টের তো প্রয়োজ্ন ছিলো না - বানিয়ে বানিয়ে আজগুবি পটভূমিকা রচনা করলেও তো চলতো - আর সেরকম তো করেছেনও অনেকে । আসলে সত্যিকার শিশুসাহিত্যিকেরা বোধহয় নিজেদের বিবেকের সচেতনতাতেই এত উদ্যম, এত প্রয়াস করেন মনোরঞ্জনের সঙ্গে সঙ্গে শিশুমনের বিকাশেরও, শিক্ষারও ।
ভারত এবং বাংলার ইতিহাসের যে গৌরবময় অধ্যায়ের কীর্তি ওঙ্কারধাম, তা এখন হাজার বছর অতীতে । কবি সত্যেন দত্ত তার কথা বলেছেন তাঁর কবিতায় - "শ্যাম কম্বোজ ওঙ্কারধাম মোদেরই প্রাচীন কীর্তি" । রবীন্দ্রনাথ স্বপ্ন দেখেছেন যে পরাধীন ভারতের দীন বেশ দেখেও তার পুরাতম প্রেমিকা সেই সাগরিকা আবার তাকে চিনতে পারবে - প্রাচ্য সভ্যতার মিলন হবে । "পদ্মরাগ বুদ্ধ"-তেও বাঙালী শিশু ও কিশোর পাঠক-পাঠিকাদের ইতিহাসের সেই অধ্যায় নিয়েই একটু সচেতন করার প্রচেষ্টা হেমেন্দ্রকুমার রায়ের । এই উপন্যাসের নিজেরই বয়স এখন প্রায় একশো বছর । এই গত শত বছরে বাঙালীর নিজস্ব ইতিহাস-মনস্কতা বেড়েছে, না আরও কমেছে, কে জানে । কিন্তু মনীষীদের বাণীগুলি আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে, যখনই আমাদের তাদের প্রতি দৃষ্টি পডূক, তখনকার জন্য ।
আরম্ভ করার আগে আর একটা ছোটো মজার কথা বলে নিতে ইচ্ছা করছে । হেমেন্দ্রকুমারের অনেক রচনাই অলৌকিক বা ভৌতিক - তাঁর একেবারে প্রথম দিকের উপন্যাস "যকের ধন" তাঁর সবথেকে জনপ্রিয় রচনাগুলির মধ্যে পড়ে - এই পডকাস্টে গতবছর আমরা তা পাঠ করেছি । জয়ন্ত কিন্তু পুরোপুরি rationalist - এবং এই গল্পে, বোধহয় খুব সচেতন ভাবেই, হেমেন্দ্রকুমার জয়ন্তকে দিয়ে বলিয়েছেন - "যকের কথা সত্যি কি না জানিনা - সত্যি না হওয়াই সম্ভব ।" তার পরেই আর এক জায়গায় শুনি জয়ন্তের মুখ দিয়ে হেমেন্দ্রকুমার বলছেন - "ভূতের গল্প পড়তে ভালো, কারণ অসম্ভবের দিকে মানুষের টান থাকে । কিন্তু ভূত নেই ।"
পাঠকের মন টানার জন্য যিনি ভূত, প্রেত, যক, পিশাচ, ডাইনি-র অবতারণা করেছেন অসংখ্য বার, তিনিই তাঁর নায়কের মুখ দিয়ে যুক্তিবাদের দৃঢ় সাবধানবাণী শুনিয়ে গেছেন, তাতে আমার মতই শ্রোতাবন্ধুদেরও হয়তো চমৎকৃত হবেন ।
অনেক কথা হলো, এইবার পাঠ আরম্ভ করি । শুনতে থাকুন হেমেন্দ্রকুমার রায়ের রচিত জয়ন্ত-মানিকের অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাস - "পদ্মরাগ বুদ্ধ" ।