নমস্কার শ্রোতা বন্ধুরা। গল্প কথার আসরের আজকের অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য আপনাদের অশেষ ধন্যবাদ। আমি রাজীব ঘোষ ।
মতি নন্দী ছিলেন বাংলা সাহিত্যে এক নতুন মাত্রার প্রবর্তক। ক্রীড়া সাংবাদিকতা থেকে তাঁর সাহিত্যে প্রবেশ। কিন্তু বাংলায় খেলা আর গল্পের এমন নিপুণ সংশ্লেষ তাঁর মত আর কেউ করতে পারেন নি আগে বা পরে। সেই হিসেবে তিনি একেবারে অনন্য। বাংলার সাহিত্য জগতে আর অসংখ্য কিশোর কিশোরী মননে তিনি অপ্রতিম হয়ে থেকে গেছেন।
১০ই জুলাই ১৯৩১ সালে পশ্চিম বাংলার টাকি তে মতি নন্দীর জন্ম। কলকাতা বিশ্ব বিদ্যালয়ের স্নাতক। চাকরী সূত্রে ক্রীড়া সাংবাদিক। আনন্দবাজার পত্রিকার ক্রীড়া সম্পাদকের কাজ করেছেন বহুদিন। তখনকার দিনে স্বল্প পরিচিত প্রতিযোগিতা মূলক খেলাধুলা যেমন সাঁতার, কবাডি বা Athletics কে জন পরিচিতি দেবার কাজে তাঁর অসীম ভূমিকা ছিল। সাঁতারু কোনি-কে নিয়ে তাঁর অসামান্য উপন্যাস । কোনি-কে আমরা আজও ভুলতে পারি নি। কোনি-র মাস্টার মশাই এর সেই ফাইট কোনি ফাইট আজও আন্ডারডগ লড়াকু প্রতিযোগীদের কাছে মনোবল বাড়ানোর টনিক হয়ে রয়েছে। ১৯৫৭ সালে মতি নন্দীর প্রথম গল্প আনন্দবাজারের দেশ পত্রিকা তে প্রকাশিত হয়। সেই শুরু। তার পরে তিনি লিখে গেছেন অবিরাম। গল্প, উপন্যাস, ছোট, বড় মাঝারি সব বয়েসের পাঠক পাঠিকাদের জন্যে।
মতি নন্দীর গল্পে কখনও এসেছে ফুটবল, যেমন তাঁর স্টপার উপন্যাসে, কখনও ক্রিকেট, নোনিদা নট আউট, কখনও বা বক্সিং যেমন বক্সার রতন। ছোটবেলায় তাঁর লেখা থেকে খেলা নিয়ে কত কি যে জানতে পারতাম গল্প পড়ার ছলে! খেলার জগতের রাজনীতি, পেছন থেকে ছুরি মারার চক্রান্ত, nepotism থেকে শুরু করে আইনকানুন পর্যন্ত। আজ যে গল্পটা পাঠ করবো শ্রোতা বন্ধুরা তাতে ক্রিকেটের ব্যাকরণ শিক্ষাও রয়েছে। কিন্তু মতি নন্দীর লেখার গুণ এমনই যে কখনই এই সব জ্ঞান দান বলে মনে হয় না, গল্পের অঙ্গাঙ্গীন অংশ বলেই অক্লেশে পাঠ করে ফেলি আমরা। আর শিখেও নি। আরেকটা বিশেষত্ব না বললেই নয়। মতি নন্দীর গল্পে কিছু চরিত্র থাকবেই যারা যথার্থ শিক্ষক, বাইরে তাঁদের শিক্ষক সুলভ কাঠিন্য হয়ত কিন্ত অন্তরে অমলিন ছাত্র দরদ, ছাত্রের উন্নতিতে অসীম আনন্দে ভাসেন তাঁরা কিন্তু বাইরে তার প্রকাশ হয় না। ছাত্রের থেকে তার সেরাটুকু বের করে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উদ্দেশ্য থাকে না তাদের। এই স্বার্থহীন চরিত্র গুলো আমাদের ভাবায়, কাঁদায়, শ্রদ্ধায় অবনত করে প্রতিবার যখন তাঁর লেখা পড়ি। আমরা সবাই আমাদের জীবনে এইরকম শিক্ষক পেয়েছি। তাঁদের স্মরণ করি প্রতিবার। আর একটি চরিত্র থাকে, যে গল্পের প্রটাগোনিস্ট, সে লড়াকু, বা বেপরোয়া, সোনা, কিন্তু কষ্ঠী পাথরে ঘষতে হয় তাকে। সে জানে না তার মধ্যে কি আছে। জীবন যুদ্ধে সে ক্ষত বিক্ষত হয়ত। খেলাটা তার প্যাশন কিন্তু জীবন তাকে অন্য দিকে টানতে চায়। সাফল্য সহজে আসে না, ক্ষমতার কুটিল রাজনীতি তাঁকে বাধা দেয়, ভ্রুকুটি করে। এই protagonist এর একমাত্র ভরসার স্থল তার কোচ, তার শিক্ষক, মাষ্টারমশাই। এদের দুজনের যৌথ প্রচেষ্টায় সাফল্য আসে অবশেষে স্বেদ যুক্ত হয়ে, আনন্দের অশ্রুতে প্লাবিত করে সবাই কে। এই যে আন্ডারডগ এর জয়, প্রাপ্য জয়, এইটাই আমাদের মতি নন্দীর গল্পে বুঁদ করে রাখে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত।
২০১০ সালের তেসরা জানুয়ারি মতি নন্দীর প্রয়াণ কলকাতায়। বহু পুরস্কার পেয়েছেন তিনি তাঁর সাহিত্যে কর্মের জন্যে।
১৯৭৪ সালে তিনি পান আনন্দ পুরস্কার আর ১৯৯১ সালে সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার। এছাড়াও ২০০৮ সালে তিনি সাংবাদিকতার জন্যে লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট আওয়ার্ড পান। কলকাতার মোহন বাগান ক্লাব ২০২২ সালে তাদের বেস্ট স্পোর্টস জার্নালিস্ট award এর নাম বদল করে মতি নন্দী award রাখে।
ওনার দুটি উপন্যাস নিয়ে দুটি বিখ্যাত চলচ্চিত্র হয়েছে, শমিত ভঞ্জ অভিনীত স্টপার আর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনীত কনি। এই দুই দিকপাল অভিনেতা মতি নন্দীর এই দুই প্রায় কালজয়ী উপন্যাস কে রুপোলি পর্দায় ও অমর করে গেছেন।
শ্রোতা বন্ধুরা, এইবার আজকের পাঠের কোথায় আসি। আজকে যে গল্পটি পাঠ করবো, এটি আনন্দ পাবলিশার এর আনন্দমেলা পুজোবর্ষিকি তে ১৯৭১ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। ক্রিকেট নিয়ে এই গল্পের নাম "ননী-দা" । আসুন, শুরু করি পাঠ, মতি নন্দীর গল্প, "ননী-দা"।