রুদ্রঃ নমস্কার শ্রোতাবন্ধুরা, পদ্যকথার আসরের আজকের বৈঠকে যোগদান করার জন্য আপনাদের অশেষ ধন্যবাদ । আমি রুদ্র দত্ত । আজ -
রাজীবঃ এই রুদ্র ! কি ভুলভাল বকছিস ! আমাদের আসর তো গল্পকথার ।
রুদ্রঃ তা তো বটেই ।
রাজীবঃ তাহলে "পদ্যকথার আসর" - এই কথাটা বললি কেন ? বিজয়া দশমীর সিদ্ধি খেয়ে আর ভূতচতুর্দশী - থুড়ি হ্যালোইনের - ভূত দেখে তোর কি মাথা গুলিয়ে গেলো ?
রুদ্রঃ মাথা গোলায়নি । এই একবিংশ শতাব্দীতে ভূতের দেখা পাওয়া দুস্কর, আর আজকের মার্কিন মুলুকে খাঁটি সিদ্ধি পাওয়াও শক্ত ।
রাজীবঃ মার্কিন মুলুকে কেন, সারা পৃথিবীতেই এখন অন্যকে সিদ্ধি পাওয়ানোর চেয়ে স্বার্থসিদ্ধির দিকেই লোকের ঝোঁক বেশী । কিন্তু তাহলে ?
রুদ্রঃ আসল কথা এই যে, আজকের বৈঠকে আমাদের সেই বহুকাল ধরে করে আসা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে চলেছি । এই সীজনের গোড়াতেও আবার প্রতিশ্রুতি করেছিলাম যে কবিতার মধ্যে দিয়ে কাহিনী কথনের যে ধারা বাংলা ভাষায় বহুদিন আগে থেকে চলে আসছে, সেইসব সাহিত্য থেকেও আমরা মাঝে মাঝে পাঠ করবো ।
রাজীবঃ ও হ্যাঁ, সেই দৃঢ়তর প্রতিশ্রুতি ! যাক, এতদিন বাদে সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে চলেছি তবে আমরা ! খুবই ভালো কথা - কিন্তু তার জন্য আসরের নামটাই পাল্টে দেওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে ?
রুদ্রঃ না, না, নাম আসলে পাল্টাচ্ছে না - আজকে একটি কাব্যকাহিনী পাঠ করবো, এইটাই একটু কায়দা করে প্রথমে বলে নিচ্ছিলাম আর কি ।
রাজীবঃ বেশ । কায়দা তো রক্ষা হয়েছে, এবারে বল পাঠ কি করছিস । বাংলায়, অন্য ভাষার মতোই, গদ্যে কাহিনী রচনার অনেক আগে থেকেই তো কবিতায় কাহিনীকথন চলেছে । মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সত্যেন্দ্রনাথ, এইসব আধুনিক বাংলার কবিদের আগেও মধ্যযুগে মুকুন্দরাম, মালাধর এবং অন্যান্যদের রচিত বিভিন্ন মঙ্গলকাব্য, ময়মনসিংহের গীতিকা, কৃত্তিবাস আর কাশী দাস তো বটেই - বাংলা কাব্যকাহিনীর গভীরতা তো কম নয় ।
রুদ্রঃ তা তো বটেই । তারও আগে প্রাচীন যুগে বাংলা লিখনের যে প্রথম নিদর্শন পাওয়া যায়, অর্থাৎ হাজার বছরেরও বেশী পুরোনো চর্যাপদ, তাও তো কবিতা; অবশ্য তাতে আধ্যাত্মিক চেতনার কথাই বেশী, হয়তো তাকে কাহিনী বলতে দ্বিধা হতে পারে । কিন্তু মানুষের প্রকৃতিই হলো গল্প বলা, কাজেই ভাষা যবে থেকে ছিলো গল্পকথাও ততদিন থেকেই ছিলো নিশ্চয়ই, যদিও হাজার বছরের থেকে বেশী পুরোনো লিখিত কোনো নিদর্শন আর পাওয়া যায় নি ।
রাজীবঃ তা এই প্রাচুর্যের মধ্যে থেকে তুই কি দিয়ে আরম্ভ করবি ভাবছিস ?
রুদ্রঃ সত্যিই সেটা নিয়ে বেশ ভাবতে হয়েছিলো । রচনাকালের যেমন ব্যাপ্তি, তেমনি বৈচিত্র্য দৈর্ঘ্যে - গদ্যে যেমন সুদীর্ঘ উপন্যাস থেকে নিয়ে বড় গল্প, ছোটো গল্প, অনুগল্প - সবই আছে, তেমনই সুদীর্ঘ মঙ্গলকাব্য থেকে নিয়ে ছোট্টো কয়েক লাইনের কবিতার মধ্যে দিয়ে সম্পূর্ণ কাহিনীর কথন, সবই আছে বাংলায় । সবদিক ভেবেচিন্তে রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে আরম্ভ করাই সবথেকে ঠিক মনে করলাম । আজ পাঠ করবো তাঁরই একটি কবিতা ।
রাজীবঃ বাঃ - খুব ভালো - খুব ভালো । কবিগুরুকে স্মরণ করেই আমাদের কাব্যকাহিনীতে - বা পদ্যকথায় - পদার্পণ শুরু । - তাহলে আর কথা না বাড়িয়ে আরম্ভ করে দে পাঠ, শ্রোতাবন্ধুরা, আপনারা শুনতে থাকুন রুদ্রর আজকের পাঠ, আমি আজকে আসি, আবার আপনাদের কাছে ফিরে আসবো আমার পরবর্তী এপিসোডে ।
---------------------
রুদ্রঃ শ্রোতাবন্ধুরা, গল্পকথার আসরের আজকের বৈঠকে যোগদান করার জন্য আপনাদের অশেষ ধন্যবাদ । আমি রুদ্র দত্ত । আমরা আজ থেকে এই আসরে পদ্যকথা পাঠ আরম্ভ করতে চলেছি এ কথা সত্য, কিন্তু আমাদের আসর গল্পকথার - অর্থাৎ কাহিনীমূলক রচনার । যে সব কবিতা প্রধানতঃ কাব্যমূলক, যাতে সেইসব কথা আবছাভাবে বলা আছে যা শুধু কবিতাতেই বলা যায়, সেইধরণের কবিতা কিন্তু আমাদের লক্ষ হবে না । যে কবিতায় কাব্য আসলে গল্পের বাহন, সেইসব কাহিনীমূলক কবিতাই আমরা এই পডকাস্টে পাঠ করতে চাই । কাজেই আমাদের আসর গল্পকথারই থেকে যাচ্ছে - কেবল কখনো সে গল্প গদ্যে বলা, কখনো পদ্যে । চতুর্থ সীজনের শেষে আমরা এই কথা আপনাদের বলেছিলাম, শ্রোতাবন্ধুরা; আরম্ভ করতে অনেক দেরী হয় গেলো বলে লজ্জিত বোধ করছি, কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্যটা আগের মতোই আছে ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গদ্য গল্পই আমরা এর আগে এই পডকাস্টে পাঠ করেছি, যদিও রবীন্দ্রনাথ কবিগুরু - কবিতার মধ্যে দিয়েই তাঁর সঙ্গে বিশ্বের পরিচয় । তাঁর সবথেকে গভীর, ভাবোদ্দীপক, অনন্তের ছোঁয়া লাগা কবিতাগুলি, যা আজও সারা পৃথিবীর সাহিত্যজগতের বিস্ময় হয়ে আছে এবং বোধহয় চিরকালই থাকবে, সেগুলি প্রায় সবই কাব্যমূলক । রবীন্দ্রনাথ কিন্তু শিল্প-সাহিত্যের সর্বত্র পারদর্শী - এবং পথিকৃৎ । তিনি কাহিনীমূলক কবিতাও লিখেছেন বেশ কিছু । তারই একটি আজ পাঠ করবো ।
কাহিনীমূলক কবিতার মধ্যেও অনেক দিক আছে । পুরাকাল থেকে প্রচলিত রীতি অনুযায়ী, এইধরণের কবিতা সাধারণত ছন্দের উপর বিশেষভাবে নির্ভর করে, এবং সাধারণতঃ অন্ত্যমিলের ওপরেও । তার একটা কারণ হয়তো এই যে প্রাচীন সময়ে থেকে ধরলে, এই ধরণের কাহিনীর এবং সে কাহিনী কথনের জন্ম লেখা আবিষ্কারের আগে । বেদ-উপনিষদের মতোই, এইসব কাহিনী হয়তো প্রাচীনকালে বেঁচে থাকার জন্য নির্ভর করেছে শ্রুতি ও স্মৃতির উপরে - পরের কোনো যুগে লিপিবদ্ধ হয়েছে । তাছাড়া লেখার আবিষ্কারের পরেও বহুদিন বেশিরভাগ মানুষই লিখতে বা পড়তে পারতো না - তা ছিলো বিশেষ শিক্ষাদীক্ষাসম্পন্ন মানুষের কাজ । তাই মুখেমুখে পুনরাবৃত্তিই ছিলো গল্পকথার প্রধান মাধ্যম - যে কাজে ছন্দ ও মিল প্রচুর সাহায্য করে ।
আবার পরের যুগে আমরা দেখেছি যে সাহিত্যিকেরা কাহিনীকবিতাকে অন্য আকৃতি দিয়েছেন । মাইকেল মধুসূদনের মহাকাব্যে ছন্দ সুস্পষ্ট এবং নিখুঁত, কিন্তু অন্ত্যমিলের কোনো বালাই নেই । সংস্কৃত কাব্যের আদলে এই অমিত্রাক্ষর ছন্দ বাংলাতে প্রথম তিনিই প্রবর্তন করেন । তারও পরে বিভিন্ন কবিরা - রবীন্দ্রনাথ তো বটেই - প্রতি পংক্তির এক দৈর্ঘ্য বা অনুষ্টুপ ছন্দের বেড়া ডিঙিয়ে আরো অনেক মুক্ত ছন্দের প্রবর্তন করলেন । আর শেষে জন্ম হলো গদ্যকবিতার - তাতে ছন্দও সুস্পষ্ট নয়, মিল তো নেইই - শুধু এক অধরা কাব্যগুণেই তা কবিতা । এইরকম কবিতাও বাংলায় প্রথম লেখেন রবীন্দ্রনাথ - সেই প্রথম গদ্যকবিতাগুলি সংকলিত আছে "লিপিকা" কাব্যগ্রন্থে । আমরা "লিপিকা" থেকে এর আগে এই পডকাস্টে পাঠ করেছি - কাজেই এক হিসেবে আমাদের এই আসরে পদ্যকথার শুরু হয়ে গেছে কিছুদিন আগেই । প্রসঙ্গতঃ, অনেকে রবীন্দ্রনাথের প্রথম গদ্যকবিতা বলতে ১৯৩২ সালে প্রকাশিত "পুনশ্চ" কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলির কথা মনে করেন, এবং তাই বলেন যে প্রেমেন্দ্র মিত্রই বাংলায় প্রথম গদ্যকবিতা রচনা করেন । প্রেমেন্দ্র মিত্রের প্রতি আমার শ্রদ্ধার অন্ত নেই, কিন্তু বলতে বাধ্য যে এই কথা সত্য নয় । রবীন্দ্রনাথ ওই "পুনশ্চ"-র ভূমিকাতেই লিখে গেছেন যে তাঁর মনে "লিপিকা"-র লেখাগুলি কবিতা, এবং সেগুলি প্রথম যখন ছাপা হয় তখন - তাঁর নিজের ভাষায় - "বাক্যগুলিকে পদ্যের মতো খণ্ডিত করা হয় নি -- বোধ করি ভীরুতাই তার কারণ" । যতদূর বুঝতে পারি, বিশ্বভারতী প্রকাশনার ইচ্ছাতেই, রবীন্দ্রনাথের নিজের মতের বিরুদ্ধে, কবিতাগুলিকে গদ্যের আকারে ছাপা হয় । "লিপিকা"-র প্রকাশকাল ১৯২২, কবিতাগুলি তারও আগেই লেখা ।
আজ কিন্তু রবীন্দ্রনাথের যে কবিতাটি পাঠ করবো, তা তাঁর অতিপরিচিত "কথা ও কাহিনী"-র কবিতা নয়, আর পরবর্তীজীবনের গদ্যকবিতাও নয় । কবিতাটির নাম "নদী" । এই কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন একটি উপহার হিসেবে । এই একটি কবিতা একটি ছোট্ট বইয়ের আকারে ছাপা হয় ১৮৯৬ সালে, সেই বইয়েরও নাম "নদী" । বইয়ের গোড়াতেই উৎসর্গে লেখা আছে -
পরমস্নেহাস্পদ
শ্রীমান বলেন্দ্রনাথ ঠাকুরের হস্তে
তাঁহার শুভপরিণয়দিনে
এই গ্রন্থখানি উপহৃত হইল।
বলেন্দ্রনাথ ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ভাইপো; বলেন্দ্রনাথের বাবা বীরেন্দ্রনাথ ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্থ পুত্র, রবীন্দ্রনাথের চেয়ে পোনেরো বছরের বড় দাদা । বলেন্দ্রনাথ নিজে ছিলেন রবীন্দ্রনাথের চেয়ে মাত্র দশ বছরের ছোটো, এবং রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ । ঠাকুরপরিবারের অন্যদের মতোই, নিজে গুণী ছিলেন, কবিতা লিখতেন, বিভিন্ন প্রবন্ধ লিখেছিলেন, বিশেষ করে চিত্রশিল্প সম্পর্কিত প্রবন্ধ, যা তাঁর আগে বাংলায় খুব বেশী লোকে লেখেননি । দুঃখের বিষয় টিউবারকুলোসিসে আক্রান্ত হয়ে মাত্র আঠাশ কি ঊনত্রিশ বছর বয়সে মারা যান । দীর্ঘজীবী রবীন্দ্রনাথকেই তাঁর অসমাপ্ত রচনাগুলি শেষ করার দায়িত্ব নিতে হয় । - কিন্তু কল্পনা করি এসবের আগে, তরুণ বলেন্দ্রনাথের বিবাহ উপলক্ষে, একটি ঝলমলে দিনের জন্য, লেখা হয়েছিলো এই কবিতা । কবিতাটিও আশ্চর্য, যেন একটি যাত্রাকাহিনী, বা জীবনী - কিন্তু মানুষের নয়, একটি নদীর । কিম্বা হয়তো মানুষেরই জীবনের রূপক আসলে এই কবিতা । সে বিচার আপনারাই করবেন শ্রোতাবন্ধুরা । জগদীশচন্দ্র বসু-র "ভাগীরথীর উৎস সন্ধানে", যা আমরা এই পডকাস্টে এর আগে পাঠ করেছি, তার সঙ্গে এই কবিতার আরম্ভের উন্মনা প্রশ্নের কিছু মিল হয়তো কোনো কোনো শ্রোতাবন্ধু আমারই মতো পাবেন । কবিতাটিতে কথার মধ্যে ফাঁকের দ্বারা একটি বিশেষ পঠন ছন্দ নির্দেশ করা আছে - যাঁরা রবীন্দ্রনাথের "সহজ পাঠ" পড়েছেন, তাঁদের কাছে তা অতিপরিচিত মনে হবে, যেখানে রবীন্দ্রনাথ সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ দিয়েছেন - "এ ছন্দটি দুই মাত্রায় অথবা তিন মাত্রায় পড়া যায়; তিন মাত্রার তালে পড়লেই ভালো হয় । দুই মাত্রা, যথা - কাল । ছিল । ডাল । খালি । / আজ । ফুলে । যায় । ভʼরে । - তিন মাত্রা, যথা - কাল ছিল ডাল । খালি -- । আজ ফুলে যায় । ভʼরে -- ।" আমি যথাসম্ভব এই নির্দেশ পালন করেই পাঠ করার চেষ্টা করছি ।
আর কথা না বাড়িয়ে আরম্ভ করছি আজকের পাঠ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা, কাব্যগ্রন্থ, উপহার, জীবনদর্শন - "নদী" ।