নমস্কার শ্রোতাবন্ধুরা, "গল্প-কথার আসর"-এর আজকের বৈঠকে যোগদান করার জন্য অশেষ ধন্যবাদ । আমি রুদ্র দত্ত । আজকে পাঠ করবো অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি ছোটো গল্প । অবনীন্দ্রনাথের লেখা আমাদের আসরে এই প্রথম পাঠ করতে চলেছি, তাই তাঁর সম্পর্কে দু-চার কথা বলে নিই ।
জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের ইতিহাস তো সকলের কাছেই সুপরিচিত । ঠাকুর এবং তৎপূর্ব কুশারী বংশের ইতিহাস আরো অতীতে প্রসারিত, কিন্তু সিপাহী বিদ্রোহের কিছু আগে এই বংশের যাঁরা বাংলার পশ্চিম অংশে বসবাস করতে চলে আসেন, এবং শেষ পর্যন্ত স্থায়ী ভাবে জোড়াসাঁকোতে বসতবাড়ি করেন, ঠাকুর পরিবার বলতে আমরা তাঁদের কথাই প্রধানতঃ বুঝি । তার প্রধান কারণ এই যে, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরকে দিয়ে আরম্ভ করে এই একটি পরিবারে পরবর্তী দুশো বছরে প্রতিভার এমন আশ্চর্য চাঁদের হাট লেগেছিলো যে তা বিশ্বাস করা কঠিন । শিক্ষা, সংস্কৃতি, সমাজসেবা, সবদিক দিয়ে এমন সব ব্যক্তিত্বরা এই পরিবারে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন যে তাঁদের যে কোনো একজনের আবির্ভাব হলেও ইতিহাস মনে রাখতো - কিন্তু সময়ের এতো স্বল্প পরিসরে এই একটি পরিবারে এতগুলি বহুমুখী প্রতিভার ছড়াছড়ি যেন প্রায় অবাস্তব বলে মনে হয় । তাঁদের সবাইকে ছাপিয়ে যাঁর প্রতিভা শুধু সারা বাংলা নয়, সারা বিশ্বকে সমৃদ্ধ করে দিয়েছিলো তিনি অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ । আর রবীন্দ্রনাথের পর যাঁর নাম আমাদের সবথেকে বেশী মনে রয়ে গেছে , তিনি বোধহয় অবনীন্দ্রনাথ; প্রতিভা এবং কীর্তির দিক থেকেও রবীন্দ্রনাথের পরেই মনে হয় তাঁর স্থান ।
অবনীন্দ্রনাথ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্র - রবীন্দ্রনাথের জ্যাঠামশাই ছিলেন অবনীন্দ্রনাথের পিতামহ । অবনীন্দ্রনাথ ছিলেন শিল্পী - এবং শিল্পবিপ্লবী । নিজে শিল্পচর্চা তো করেছেনই, কিন্তু তিনি শুধু ছবি আঁকেনইনি, পুরো চিত্রকলা শিল্পটাকেই পাল্টে দিয়ে গেছেন । পাশ্চাত্য অনুকরণে ছবি আঁকাই যখন প্রচলিত ছিলো, তখন অবনীন্দ্রনাথ খাঁটি, সাবেকী ভারতীয় চিত্রশিল্পের কল্পনা করেছেন, স্বপ্ন দেখেছেন । আদি ভারতীয় চিত্রমানসিকতা খুঁজতে তিনি বিগত মুঘল ও রাজপুত শিল্পঘরানা, অজন্তা, ইলোরার গুহাচিত্র, এ সবেরই অনুসন্ধান ও অনুশীলন করেছেন - আবার চীনা, জাপানী শিল্পকলা, ইউরোপীয়ান তৎকালীন শিল্পপদ্ধতি, এসবও গ্রহণ করেছেন । তা থেকে যা বেরিয়ে এসেছে, তা অতীতের নকল নয় - বরং অতীত ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে এক সম্পূর্ণ নতুন আধুনিক শিল্পচিন্তাধারা । বড় দাদা গগনেন্দ্রনাথের সঙ্গে একযোগে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন Indian Society of Oriental Art; ভারতীয় শিল্পের ইতিহাসে যাকে বলে বেঙ্গল স্কুল, অবনীন্দ্রনাথই তার পত্তন করেন । প্র্কৃত অর্থে, আধুনিক ভারতীয় শিল্পকলার শুরু অবনীন্দ্রনাথের হাত ধরেই ।
শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথের কথা আরো বহুক্ষণ ধরে বলে চলা যায় । কিন্তু আমাদের এই আসর তো গল্পকথার, তাই আমরা এবার অবনীন্দ্রনাথের লেখার প্রতি মনোনিবেশ করবো । ছোটোদের জন্যেই সবচেয়ে বেশী লিখেছেন অবনীন্দ্রনাথ । যখন বিশেষ করে ছোটোদের জন্য লেখেননি, তখনো যেন তাঁর লেখা হৃদয়ের কোন শিশুচেতনা থেকেই উৎসারিত হতো - একটা শিশুসুলভ সারল্যে লেখাগুলি ফুটে উঠতো । ক্ষীরের পুতুল, নালক, বুড়ো-আংলা, রাজকাহিনী - বাঙালী পাঠক মাত্রেরই এই নামগুলি সুপরিচিত । আর সেই লেখার প্রধান গুণ হলো অতি বাস্তবধর্মী নিখুঁত পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা - পাঠকের চোখের সামনে যা ছবি হয়ে ভেসে ওঠে, তা সে রাজপুতানার দোলপূর্ণিমার রাতই হোক, আর আবছা আলো-আঁধারিতে দেখা ভূত-পতরীর দেশই হোক । আজ যে গল্পটি পড়বো, তাতে ঘটনা বলতে প্রায় কিছুই নেই - বীরভূমের আদিগন্ত খোয়াইয়ের মাঠে বন, আকাশ, আলো-ছায়া, বাতাসের খেলার বর্ণনা । কিন্তু অবনীন্দ্রনাথের কল্পনায় এই নৈসর্গিক দৃশ্যে চরিত্র জন্ম নিয়েছে - বাতাসের আওয়াজ, গাছের পাতা নাড়া, আলো-ছায়ার যাতায়াত, সবই সেই চরিত্রদের কথোপকথন, অঙ্গসঞ্চালন হয়ে দাঁড়িয়েছে । আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, এ কি আসলে গদ্যে লেখা কবিতা ? কিন্তু এই কল্পনা কিছুটা কাব্যপ্রবণ হলেও, এতে প্রতীক বা রূপকের ব্যবহার কাব্যধর্মী নয় - শিশুমনের কল্পনায় গাছ পাতা ছায়া কথা বলে উঠলেও, গল্পটা কিন্তু যা যা সত্যিই ঘটছে তারই সরল বিবরণ । আসলে এটা কথায় আঁকা একটি কল্পনাপ্রবণ ছবি । আকাশে মেঘ দেখে আমরা সকলেই কখনো কখনো কল্পনার জোরে হয়তো বলে উঠি - "ওই একটা গাছ - ওই একটা ঘোড়া" । হয়তো তার থেকে অল্প একটু গল্পও তৈরী হয় আমাদের মনে - যখন ঘোড়াটা হয়তো দৌড় মারে । অবনীন্দ্রনাথের লেখা পড়লে বুঝতে পারি, তাঁর খাঁটি শিল্পীমনে সবকিছুই ছবি হয়ে ফুটে উঠতো - আক্ষরিক অর্থেই তিনি ছবির ভাষায় ভাবতেন । আর তার থেকে যা গল্প হতো তা লিখতেন । বুড়ো-আংলা গল্পে তিনি নিজেই নিজের লেখা সম্বন্ধে আসল কথাটি লিখে গেছেন - "কোন ঠাকুর ? ওবিন ঠাকুর - ছবি লেখে ।"
আজ যে গল্পটি পড়বো, সেটি অনেকেরই পরিচিত - গল্পটির নাম "দেয়ালা" । "দেয়ালা" শব্দটির অর্থ শিশুর স্বপ্নে হাসিকান্না । ঘুমন্ত শিশুর মুখের দিকে যাঁরাই কখনো তাকিয়েছেন, সেই মুখে হঠাৎ হঠাৎ আনন্দ বা ভয়ের অভিব্যক্তি যাঁরাই দেখেছেন, নিসর্গপ্রকৃতির পটপরিবর্তনের সঙ্গে তার কি চিত্রগত সাদৃশ্য, তাঁরা হয়তো অবনীন্দ্রনাথকে অনুসরণ করে তা অনুভব করতে পারবেন ।
তাহলে আরম্ভ করছি আজকের পাঠ, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প, "দেয়ালা" ।