নমস্কার শ্রোতাবন্ধুরা, গল্পকথার আসরের আজকের বৈঠকে যোগদান করার জন্য আপনাদের অজস্র ধন্যবাদ । আমি রুদ্র দত্ত । আজ আপনাদের কাছে আবারও নিয়ে আসছি এমন এক সাহিত্যিকের রচনা, যাঁর লেখা আগে এই পডকাস্টে পাঠ করিনি । গত সীজন থেকে আরম্ভ করে আমরা বাংলায় কল্পবিজ্ঞান এবং তার বিবর্তনের দিকে একটু বিশেষ ভাবে মনোনিবেশ করছি, নিয়মিত শ্রোতাবন্ধুরা তা জানেন । আজকে আপনাদের কাছে নিয়ে আসবো সেইরকমই একজনকে - তিনি এণাক্ষী চট্টোপাধ্যায় ।
এণাক্ষী-র জন্ম ১৯৩৪ সালে, পাটনায়; তাঁদের পরিবারের আদি নিবাস ছিলো নদীয়া জেলায় । পড়াশুনা পাটনাতেই, যতদূর বুঝতে পারি, পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক ও ইংরেজী সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন । বিয়ের পরে চলে আসেন কলকাতা - স্বামী শান্তিময় চট্টোপাধ্যায় ছিলেন মেঘনাদ সাহার প্রিয় শিষ্য । হয়তো কলেজের প্রথম ডিগ্রী বিজ্ঞানের হওয়ার ফলে, হয়তোবা পরমাণু-বিজ্ঞানী স্বামীর সাহচর্যে, বিজ্ঞান নিয়ে লেখাই তাঁর জীবনের ব্রত হয়ে দাঁড়ায় । কিছু ভ্রমণকাহিনী, কিছু আত্মজীবনী মূলক লেখা বাদ দিলে, তাঁর বেশীরভাগ লেখাই বিজ্ঞান সম্পর্কিত । কল্পবিজ্ঞান তো লিখেছেনই, কিন্তু তাঁর বিজ্ঞান সম্পর্কিত অন্য সৃষ্টিগুলি আরো মূল্যবান - মেঘনাদ সাহা এবং সত্যেন্দ্রনাথ বসুর প্রামাণিক জীবনী, এবং ভারতে বিজ্ঞানচর্চার বর্ণনা । এই সবকটি বইই এণাক্ষী এবং শান্তিময়ের যৌথ রচনা - অনুমান করি, শান্তিময় যোগাতেন বিজ্ঞানের তত্ব ও তার ঐতিহাসিক তথ্য, আর এণাক্ষী যোগাতেন সাহিত্যে তার রূপায়ন । দুজনের যৌথভাবে লেখা "পরমাণু-জিজ্ঞাসা" বইটি সবথেকে সমাদৃত হয়, এবং এইজন্য তাঁরা রবীন্দ্র-পুরস্কার পান । সাহিত্যকর্মের জন্য আরো বিভিন্ন পুরস্কার এণাক্ষী পেয়েছিলেন । বেশ কিছুদিন ধরে জনপ্রিয় "আনন্দমেলা" পত্রিকায় ধাঁধা প্রকাশ হতো "ভানুমতী" নামক লেখিকার কলমে; প্রকৃতপক্ষে এণাক্ষীই ছিলেন ভানুমতী । বিজ্ঞানকে সবার কাছে সুগম করে পৌঁছে দেওয়া তাঁর লক্ষ্য ছিলো । ওই "পরমাণু-জিজ্ঞাসা" বইয়ের ভূমিকাতেই তিনি বলেছেন, বিজ্ঞানের সঙ্গে আজকের যুগের সর্বসাধারণের যোগ আছে, তাই জীবিকা ব্যাপারে প্রত্যক্ষ সংযোগ না থাকলেও তার খবরাখবর রাখা, তার বুদ্ধিমান দর্শক হওয়া, আমাদের সকলের প্রয়োজন - আর জোর গলায় এও বলেছেন, যে যদি বিজ্ঞানের তত্ব সর্বসাধারণের গ্রহণযোগ্য না করে তোলা যায়, তার দোষ উপস্থাপকের, পাঠকের নয় । এই দুরূহ সাধনা তিনি নানাভাবে করে গেছেন সারাজীবন, এবং পরমাণু-বিজ্ঞানের মতো কঠিন বিষয়কেও এনে দিতে পেরেছিলেন সকলের কাছে । এই কিছুদিন আগে, ২০২১ সালে, তিনি পরলোকগমন করেন ।
কিন্তু আমাদের আসর তো গল্পকথার, তাই আমরা এণাক্ষীর লেখা গল্পের দিকেই বেশী মনোযোগ দেব । বেশ কিছু কল্পবিজ্ঞান লিখে গেছেন এণাক্ষী চট্টোপাধ্যায় । বেশ বোঝা যায়, নিজের গল্প রচনার থেকে সাহিত্যের ভালো ভালো গল্প অন্য ভাষাভাষী পাঠকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার বিষয়ে তাঁর আগ্রহ কম কিছু ছিলো না । প্রেমেন্দ্র মিত্রের দুটি কল্পবিজ্ঞান উপন্যাস, আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের "পূর্ব-পশ্চিম"ও, তিনি ইংরেজীতে অনুবাদ করেছিলেন; আবার বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন বিক্রম শেঠের "আ সুটেবল বয়", জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকারের এবং আসিমভ, আর্থার ক্লার্ক প্রমুখ বেশ কিছু পাশ্চাত্য সাহিত্যিকের কল্পবিজ্ঞানের গল্প । পাঠকদের কাছে ভালো জিনিষ পৌঁছে দেবার জন্য নিজেকে সরিয়ে রেখে অন্যের কীর্তির বিস্তারের চেষ্টা বেশীরভাগ লেখক মানুষই করেন না - এটাও এণাক্ষীর একটি বিশেষত্ব ।
অধুনা কল্পবিশ্ব প্রকাশনী এণাক্ষী চট্টোপাধ্যায়ের একটি কল্পবিজ্ঞান রচনাসমগ্র প্রকাশ করেছেন, যার সম্পাদক সন্তু বাগ ও দীপ ঘোষ । এতে এণাক্ষীর নিজের লেখা গল্প আর অনুদিত গল্প দুইই আছে । কিন্তু দুঃকের সঙ্গে দেখছি যে সেই তথ্যাদি একেবারে সম্পূর্ণ নয় - বেশ কয়েকটি গল্প যে আসলে অনুবাদ বা অন্য গল্পের ছায়াবলম্বনে, যেমন জন ওয়াইণ্ডহ্যামের "কমপ্যাশন সার্কিট", আসিমভের "জোকস্টার", হাইনলাইনের "অ্যাণ্ড হি বিল্ত আ ক্রুকেড হাউজ" - তা পাঠকের কাছে সুস্পষ্ট হলেও, বইতে উল্লেখ করা নেই । তাই আজ যে গল্পটি পড়ব, তা এণাক্ষীর নিজের রচনা তা একেবারে জোর দিয়ে বলতে পারি না - কিন্তু বিষয়বস্তু, বাচনভঙ্গী, সব মিলিয়ে সেটাই মনে হয় । মনে হয় এই গল্পটি একেবারেই মৌলিক । এর পরেও এই আসরে মাঝে মাঝে তাঁর গল্পপাঠের ইচ্ছা রইলো ।
আরম্ভ করছি আজকের পাঠ, এণাক্ষী চট্টোপাধ্যায়ের গল্প, "তারসপ্তক" ।