নমস্কার শ্রোতাবন্ধুরা, "গল্প-কথার আসর"-এর আজকের বৈঠকে যোগদান করার জন্য অজস্র ধন্যবাদ । আমি রুদ্র দত্ত । আজকে একটি শ্রুতিপুস্তকের পাঠ আরম্ভ করবো - শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস, "তুমি সন্ধ্যার মেঘ" । বেশ প্রমাণ সাইজের উপন্যাস, নʼটি নাতিদীর্ঘ পরিচ্ছেদে বিভক্ত । এক-একটি এপিসোডে এক-একটি পরিচ্ছেদ পাঠ করছি । প্রতি এপিসোডের গোড়ায় তার আগে যা ঘটেছে তার একটু খেই ধরিয়ে দেবার চেষ্টাও করবো ।
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর সাহিত্যকর্ম নিয়ে আগে এই আসরে কিছু বক্তব্য রেখেছি, এখন আর নতুন করে কিছু বলার কোনো কারণ নেই । এই উপন্যাস, এবং তার পাঠ সম্পর্কে কয়েকটি ছোট্ট কথা পাঠ আরম্ভ করার আগে সেরে নিই । প্রথমেই বলি, এই নʼটি পরিচ্ছেদের প্রতিটিই আবার বেশ কয়েকটি নম্বর দেওয়া ভাগে বিভক্ত । কাহিনীর গতির সঙ্গে তাল মিলিয়েই এই বিভাগ - পরিচ্ছেদ বা বিভাগ কোনোটিরই কোনো নাম নেই । তাই আমার পাঠে পরিচ্ছেদগুলির উল্লেখ রাখছি, কিন্তু বিভাগগুলি শুধু সামান্য সঙ্গীতধ্বনি দিয়ে সূচিত করেছি ।
শরদিন্দুর অনেক গল্পই ইতিহাসভিত্তিক, তার অনেকগুলি বন্ধুবর রাজীব এই পডকাস্টে পাঠও করেছে । এই উপন্যাসটিও তাই । যদিও শরদিন্দুর ঐতিহাসিক পটভূমিকায় রচিত গল্প বা ছোটো উপন্যাস আরো আছে, তাঁর পাঁচটি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস বিশেষভাবে "ঐতিহাসিক" বলে চিহ্নিত, এবং আনন্দ প্রকাশনীর প্রামাণ্য অমনিবাস সংস্করণের তৃতীয় খন্ডে সংগৃহীত । কিন্তু ঐতিহাসিক পটভূমিকায় রচিত হলেও, এগুলি ইতিহাস নয়, উপন্যাসের যা প্রধান ধর্ম, অর্থাৎ গল্পকথন, তাই এর আসল মালমশলা । অন্য একটি উপন্যাসের ভূমিকায় শরদিন্দু নিজেই লিখেছেন, "আমার কাহিনী fictionalized history নয়, historical fiction" । "তুমি সন্ধ্যার মেঘ" আরম্ভ হয়েছে ঐতিহাসিক পটভূমিকার গম্ভীর, সুন্দর বর্ণনা দিয়ে - কিন্তু প্রথম পরিচ্ছেদের মাঝামাঝি অবধি এসেই ঘটনার ঘনঘটা, নানা চরিত্রদের সুখদুঃখ, তাদের ঘাত-প্রতিঘাত, সবই এসে পড়েছে । কুশীলবদের কেউ কেউ পরিচিত ঐতিহাসিক চরিত্র, কিন্তু তাদের অন্তরের চিন্তার, মনের ভাবের সঙ্গে যে পরিচয় শরদিন্দু করিয়ে দেন, তা ইতিহাসের পাতায় মেলে না । শরদিন্দুর লেখা পড়তে পড়তে তারা আমাদের অত্যন্ত কাছের মানুষ হয়ে পড়ে । আর তার মধ্যে একটি সুন্দর প্রেমের গল্পের পাশাপাশি রীতিমত অ্যাডভেঞ্চারের উত্তেজনা, পাঠকের মনোহরণ করে ।
একই সঙ্গে উল্লেখ করতে হয় শরদিন্দুর ভাষার প্রয়োগের । একে পূর্ণদৈর্ঘ্য উপন্যাস, তায় ঐতিহাসিক, তা আবার সাধুভাষায় লেখা - পড়তে গিয়ে একটু শঙ্কা হতেই পারে । কিন্তু কি আশ্চর্য সাবলীল এই ভাষা । ভাষার যেসব লব্জ নেহাত কথিত ভাষাতেই চালু, তা শরদিন্দু উপন্যাসের ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় বিশেষ মেজাজ সৃষ্টি করার জন্য অবলীলাক্রমে চালিয়ে দিয়েছেন । আর তার ফলে ওই সাধুভাষাতেই কখনো গম্ভীর, কখনো হাল্কা, কখনো উত্তেজক পরিস্থিতি প্রায় নাটক কি চলচ্চিত্রের মতো পাঠককে মুগ্ধ করে রাখে । হঠাৎ কোনো অকস্মাৎ শব্দে চমকে গেলে আমরা কথায় বলি, পিলে চমকে গেলো । শরদিন্দুর গল্পেও দেখি, কোনো চরিত্র প্লীহাচমকপ্রদ শব্দে ভীত হচ্ছেন । এই চলিত ইডিয়মকে সংস্কৃত তৎসম শব্দে সাজিয়ে উপস্থিত করা শুধু সাধু ভাষার প্রয়োজনেই নয়, এই বৈষম্যের মধ্যে দিয়ে কিছু হাস্যরস উদ্রেক করার জন্যেও । কোনো চরিত্র যখন অপর একটি চরিত্রকে গ্রন্থিচ্ছেদক আখ্যা দেন, তখন নিমেষের জ্ন্য সাধুভাষার প্রয়োগে আমাদের মনে হয়তো একটু সম্ভ্রম হয়, কিন্তু তার পরই যখন বুঝি যে তাকে গাঁটকাটা বলে গালাগাল দেওয়া হলো, তখন একটু মুচকি হাসি আসতে বাধ্য ।
এই কাহিনী ইতিহাস না হলেও, যে ঐতিহাসিক ছোঁয়াটুকু তার মধ্যে আছে, তা কিন্তু সম্পূর্ণ সঠিক । ইতিহাসের পটভূমিকায় কাহিনী লেখার মধ্যে একটা দায়িত্ব এসে যায় তো । সেই দায় শরদিন্দু সম্পূর্ণ পালন করেছেন । এই প্রসঙ্গে, ওই পূর্বোল্লিখিত সংস্করণের গ্রন্থ-পরিচয়ের অন্তর্ভুক্ত, সুগবেষক সুকুমার সেনের লেখা থেকে বাংলা সাহিত্যে ঐতিহাসিক গল্পের ভূমিকা সম্বন্ধে একটু উদ্ধৃত না করে পারছি না । সুকুমারবাবু লিখছেন -
"ইতিহাসের কাহিনী নিয়েই আমাদের দেশে গদ্য গল্পের ... এইখানেই ঐতিহাসিক গল্পলেখক রূপে তাঁর বিশেষ কৃতিত্ব ।"
ওই সংস্করণেই শোভন বসুর লেখা গ্রন্থ-পরিচয় থেকে জানতে পারি, এইগুলির সম্বন্ধে শরদিন্দু নিজে ডায়রিতে লিখেছেন,
"ইতিহাস অবলম্বন করিয়া কাহিনী লেখা বঙ্গভাষায় প্রচলিত নয় । ... যে জাতির ইতিহাস নাই, তাহার ভবিষ্যৎ নাই ।"
এবার এই উপন্যাসের গোড়ায় শরদিন্দুর লেখা উৎসর্গবাণী, এবং ছোট্ট ভূমিকাটি পড়ে নিই । শরদিন্দু লিখছেন -
"উৎসর্গ ॥ যাঁহার প্ররোচনায় ... (ভাদ্র ১৩৬৫)"
এইখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন । এই ভূমিকাতে, এবং গল্পের মধ্যেও, শরদিন্দু নশো বছরের মহারাত্রির কথা উল্লেখ করেছেন । কাহিনীর সময় শকাব্দ - বা খৃস্টাব্দ - দশম শতক, মামুদ গজনীর ভারত আক্রমণের কাছাকাছি সময়ে - ব্রিটিশ রাজ্যের আগে, মুঘলদের আগে, লোদীদের আগে, সৈয়দ, তুঘলক, খলজী, ঘোরীদেরও আগে । এই সময় থেকে নিয়ে, দিল্লীর সুলতানি আমল, তারপর মুঘল আমল, এবং সর্বশেষে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য, এই সময়কেই শরদিন্দু মহারাত্রি বলেছেন তা স্পষ্ট । এর থেকে মনে হতেই পারে, যে শরদিন্দু ভারত বলতে হিন্দু ভারতই বুঝেছেন, এবং বোঝাতে চেয়েছেন । এই ভাবটিকে আধুনিক পাঠকের কিছুটা সাম্প্রদায়িক মনে হতেই পারে ।
শরদিন্দু যে নিজে হিন্দু ছিলেন, এবং হিন্দু ধর্ম ও ইতিহাস নিয়ে তাঁর সহানুভূতি ছিলো, তার সন্দেহ নেই - আর তা থাকাই স্বাভাবিক । কিন্তু সাম্প্রতিককালের উগ্র মৌলবাদী হিন্দুত্বের সঙ্গে তার তুলনা করলে ভুল হবে মনে হয় । অন্য অনেক গল্পে উপন্যাসে শরদিন্দু তাঁর উদার মনের পরিচয় দিয়েছেন । আর একটি ঐতিহাসিক উপন্যাসের ভূমিকাতে শরদিন্দু লিখছেন -
"এই আখ্যায়িকায় নিছক গল্প বলা ছাড়া ... তাহারা শুধু বিচারমূঢ় নয় - মিথ্যাচারী ।"
তাই মনে হয় এই নয়শত বৎসরের রাত্রির ব্যাপারটা বিশেষভাবে ধর্মের প্রতি কোনো ঈঙ্গিত নয় । গজনী ও ঘোরীর আক্রমণের পূর্বে ভারতে উত্তরাপথ, দাক্ষিণাত্য, পূর্বাঞ্চল বিভিন্ন ছোটো ছোটো রাজ্যে বিভক্ত ছিলো তা নিয়ে সন্দেহ নেই, এবং তাদের মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহও লেগেই ছিলো, কিন্তু অনেক ঐতিহাসিকের মতে তার মধ্যে একটা সামঞ্জস্য ছিলো, একটা অকথিত বোঝাপড়া ছিলো । আর্যাবর্ত দিয়ে দশম শতক থেকে আরম্ভ করে, দশকে দশকে, শতকে শতকে, সম্পূর্ণ নতুন হানাদারদের আক্রমণে কিন্তু সেই ভারসাম্য আর রইলো না । নবাগত আক্রমণকারীরা কালক্রমে হয়তো ভারতকে নিজের দেশ ভেবে তার উন্নতিসাধনে এবং পালন ও প্রতিরক্ষায় মনোযোগ দিয়েছেন; খলজীরা মোঙ্গোলদের আক্রমণের প্রতিরক্ষা করেছেন, আকবর দীন-ইলাহি প্রবর্তনের চেষ্টা করেছেন । কিন্তু হানাদারদের প্রথম উদ্দেশ্য সবসময়ই থাকে লুঠতরাজ - উপদ্রুত অঞ্চলকে নিজেদের দেশ মনে করে তার যত্ন করার কোনো প্রচেষ্টা তখন থাকে না । শত্রুদের প্রতিহত করার মতো শক্তি না থাকলে সেই দেশের সমাজ সংস্কৃতি তখন তছনছ হয়ে যায় । ভারতে বহুশত বছর ধরে বারবার তাই হয়েছিলো । সম্ভবতঃ একেই শরদিন্দু মহারাত্রি বলেছেন ।
পরিশেষে আমার ব্যক্তিগত কথা একটু বলি । আমি নিজে এই উপন্যাসটি, এবং শরদিন্দুর অন্যান্য ঐতিহাসিক কাহিনী যখন প্রথম পড়েছি, তখন আমি স্কুলে পড়ি - মাঝামাঝি ক্লাসে । এইসব গল্প যে কত উপভোগ্য লেগেছিলো তা বলার নয় । তারপর কত বছর ধরে বারবার এইসব গল্পের কাছে ফিরে এসেছি, প্রতিবারই নতুন করে ভালো লেগেছে, আরো আরো ভালো লাগার জিনিষ খুঁজেও পেয়েছি । আশ্চর্যের কথা এই, যে শরদিন্দুর লেখনীতে সেই ছোটো বয়সেই ইতিহাসের যে ঔজ্জ্বল্য, যে রাজকীয়তা অনুভব করতাম, তৎকালীন সমাজের যে বৈচিত্র্যময়, বর্ণাঢ্য ছবি দেখতে পেতাম, তার সঙ্গে স্কুলের পাঠ্য বিবর্ণ, বিস্বাদ ইতিহাসের বইয়ের কোনো মিল নেই । সেই ইতিহাসটা এতই খারাপ লাগতো, যে প্রতিবারই ইতিহাসের পরীক্ষায় ফেল করার আশঙ্কা থাকতো । বড় হয়ে অনেকবার মনে হয়েছে, যদি স্কুলের বইয়ের বদলে শরদিন্দুর মতো কারুর লেখা থেকে ইতিহাসের পাঠ নিতে পারতাম, তাহলে হয়তো ছোটোবেলার অতগুলো বছর ধরে অতগুলো ঘণ্টা নষ্ট হতো না, আর নিজের দেশ-জাতি-সংস্কৃতির ইতিহাস সম্বন্ধেও আরেকটু বেশী ধারণা তৈরী হতো । … সুদূরপ্রসারী ইতিহাসের স্পর্শ, অ্যাডভেঞ্চারাস প্রেমের গল্প, মনোহরণ ভাষা, সব মিলিয়ে "তুমি সন্ধ্যার মেঘ" উপন্যাসটিকে আমার মনে হয় একটি অখন্ড রসবস্তু - বাংলা সাহিত্যের সর্বোজ্জ্বল মাণিকের একটি ।
আজকে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যোমকেশ বক্সীর গল্পগুলির প্রচুর কাটতি, যদিও তার কিছু কিছু শরদিন্দুর কাহিনীর সম্পূর্ণ মূলানুগ নয়, পুনর্কল্পনা । সেই কাহিনীগুলি অবশ্যই অসামান্য, কিন্তু ছোটো মুখে একটা বড় কথা বলি; আমার মনে হয় শরদিন্দু জন্মেছিলেন তাঁর ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলি রচনা করতেই । তাঁর নিজের কথাতেই শুনেছি - "কেহ কেহ বলেন এইগুলি আমার শ্রেষ্ঠ রচনা", কাজেই শরদিন্দুর সমকালীন পাঠকদেরও অনেকের এই মত ছিলো বোঝা যায় ।
কিন্তু সে বিচার তো আপনারা নিজেরাই করবেন, শ্রোতাবন্ধুরা । আমার কাজ পাঠ করা, এইবার তা আরম্ভ করবো । আমার মতো অনেক পাঠকেরই নিশ্চয়ই এই উপন্যাস অতিপ্রিয়; আমার পাঠ তাঁদের অতীত সুখস্মৃতির মর্যাদা রক্ষা করবে আশা করি । আর কোনো শ্রোতাবন্ধু যদি উপন্যাসটা না পড়ে থাকেন, আর আমার পাঠ শুনে যদি ভালো লাগে, তাহলে বিশেষ কৃতজ্ঞ বোধ করবো ।
পাঠ শুরু পরের এপিসোড থেকে । শুনতে থাকুন, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক উপন্যাস, "তুমি সন্ধ্যার মেঘ" ।