নমস্কার শ্রোতাবন্ধুরা, "গল্প-কথার আসর"-এর আজকের বৈঠকে যোগদান করার জন্য অজস্র ধন্যবাদ । আমি রুদ্র দত্ত । আমাদের চারশো-তম এপিসোডে উল্লেখ করেছিলাম, যে ১৯২৬-এর ইতালী ভ্রমণ থেকে ফেরার ঠিক পরে রবীন্দ্রনাথের যে সব গল্প প্রকাশিত হয়, তার কোনো কোনোটি পাঠ করার ইচ্ছা আছে । আজ যে গল্পটি পাঠ করবো, সেটি প্রথম প্রকাশ পায় ১৯৩০ সালে, প্রবাসী পত্রিকায় - ১৯২৬-এর ইউরোপ ভ্রমণ আর ১৯২৭-এর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া (বালি, যবদ্বীপ, ইত্যাদি) ভ্রমণের পরে, এবং ১৯৩০-এ আবার ইউরোপ যাত্রার ঠিক প্রাককালে । এই গল্প প্রকাশের ঠিক আগে এক বছরেরও বেশী সময় ধরে রবীন্দ্রনাথের আর কোনো ছোটো গল্প প্রকাশ পায়নি - আর এক বছর আগে যে দুটি গল্প প্রকাশ পেয়েছিলো, তা আমরা এই আসরে এর আগেই পাঠ করেছি - অল্পদিন আগেই মহাশ্বেতা পাঠ করেছে "বলাই", আর আগের এক পর্বে আমি পাঠ করেছি "সংস্কার" । এই গল্পগুলি থেকে ইউরোপ সফরের পরে রবীন্দ্রনাথের মনের ভাবের সামান্য একটু আভাস পাওয়া যেতে পারে, এ আশা হয়তো একেবারে দুরাশা নয় ।
ওই দুটি গল্পের মতোই, এই গল্পটিতেও সবথেকে বেশী ফুটে ওঠে রবীন্দ্রনাথের মানবিকতাবোধ, নৈতিক বা শৈল্পিক চেতনায় উন্নত কিন্তু সাংসারিক ভাবে সরল বা অক্ষম, যাকে বলে আন্ডারডগ, তার প্রতি গভীর মমতা । কিন্তু তা ছাড়াও আরো কয়েকটি বিষয় হয়তো লক্ষণীয় ।
প্রথমতঃ, তাঁর সাম্প্রতিক ইউরোপ ভ্রমণ, বা ইতালী বা মুসোলিনীর, কোনো ছাপই কিন্তু এই গল্পগুলির কোনোটিতেই প্রত্যক্ষ দেখা যায় না । গল্পগুলি সবকটিই বাংলার তৎকালীন সমাজ থেকে সহজ ভাবে জন্ম নিয়েছে - বলে না দিলে কোনো পাঠকেরই এই গল্পগুলি পড়ে ইউরোপের বা যবদ্বীপের কথা মনে আসবে না । অবশ্য রবীন্দ্রনাথের পক্ষে তা খুবই স্বাভাবিক - প্রায় সত্তর বছর বয়সে সারা বিশ্বে খ্যাতি ও সম্মানের শিখরে যে কবি-দার্শনিক-সমাজপর্যালোচক, পৃথিবীর অন্ততঃ ত্রিশটি দেশ যাঁর তখন ঘোরা হয়ে গেছে, তাঁর বিরাট বিশ্বচেতনায় এক-একটি ভ্রমণ এমন বিশেষ ভাবে ছায়াপাত করতে পারে যে তা তাঁর রচনার বিষয়বস্তুতে দখল বসাবে, তা মনে করাই হাস্যকর । সেইসব ভ্রমণ তাঁর মনে যে সব চিন্তার জন্ম দিয়েছে, তা তিনি খুব পরিস্ফুট করেই লিখে গেছেন তাঁর প্রবন্ধে আর চিঠিতে ।
কিন্তু কিছু অস্ফুট অনুরণন হয়তো থাকতে পারে । "চিত্রকর" গল্পটির প্রধান একটি ভাব হলো মানুষের বৈষয়িক চিন্তা, অর্থলোভী মানুষের পয়সার পিছনে ছোটার তাড়নার প্রতি ঘৃণা । পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রতি যদি রবীন্দ্রনাথের কোনো মোহ জন্মে থাকতো, তাহলে বোধহয় তার পরিচয় এইরকম হতো না । বরং পাশ্চাত্য সভ্যতার বস্তুতান্ত্রিক কাড়াকাড়ির ভাব দেখে কিছুটা বীতশ্রদ্ধই হয়তো হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ - তারই হয়তো এই প্রতিক্রিয়া । এটাও লক্ষণীয় যে "বলাই" গল্পতেও ব্যবহারিক চিন্তার থেকে প্রকৃতির কাছে ফেরার কথাই আছে ।
আর অন্য এক দিক থেকে কিন্তু মনে হয়, "চিত্রকর" গল্পটিতে রবীন্দ্রনাথের ইতালী ভ্রমণের স্মৃতি জ্বলজ্বল করছে । বিষয়বুদ্ধিতে কম, কিন্তু শৈল্পিক মর্যাদায় চিরন্তন, এই রূপের প্রতিমূর্তি হিসেবে রবীন্দ্রনাথ অনেক কিছুই নিতে পারতেন - তিনি নিজে কথাশিল্পী, চুণীলালের চরিত্রটিকে কবি হিসেবে কল্পনা করাই হয়তো তাঁর পক্ষে স্বাভাবিক হতো । কিন্তু তার বদলে তিনি চুণীকে করলেন চিত্রশিল্পী । কে বলতে পারে, এ হয়তো ইতালীতে দেখে আসা বহু শতাব্দীর রক্ষিত চিত্রকলারই প্রতিধ্বনি । এ কথাও স্মরণ করি, যে ভারতে তখন চিত্রশিল্পের নবজাগরণ আরম্ভ হয়ে গেছে, গগনেন্দ্রনাথ আর অবনীন্দ্রনাথের হাত ধরে - অবনীন্দ্রনাথের "দেয়ালা" গল্প পাঠ করতে গিয়ে তার কথা একটু বলেছিলাম - কিন্তু রবীন্দ্রনাথের নিজের ছবি আঁকা আরম্ভ এই সময়ের পর থেকে, রবীন্দ্রনাথের আশ্চর্য চিত্রশিল্পের প্রায় সবই তাঁর জীবনের শেষ দশ বছরের সৃষ্টি । তাই মনে হয়, ইতালী থেকে রবীন্দ্রনাথ যা মনের মধ্যে করে নিয়ে এসেছিলেন তা বোধহয় শৈল্পিক - সমালোচকরা যতই চেঁচামিচি করুন, মুসোলিনীর দর্পভরা ফাশিস্ট কল্পনা বোধহয় রবীন্দ্রনাথের মনে বেশী দাগ কাটে নি ।
আসলে ১৯২৬-এর সফরে যা ঘটেছিল তা তো আমরা নির্ভুল কেউই জানি না, আর যা জানা যায় তারও সুবিধামতো কিছু কিছু মনে রেখে কিছু কিছু উপেক্ষা করা তো খুব সহজ । রবীন্দ্রনাথ মুসোলিনীর রাজনীতির কথা শুনে প্রথমে মুগ্ধ হয়েছিলেন ঠিকই, এবং প্রশংসাও করেছিলেন । সেই প্রশংসার ভাষাতেও আমরা তাঁর মনের মধ্যে তখন কি ঘোরাফেরা করছিলো তার একটু আভাস পাই - তিনি বলেছিলেন মুসোলিনীর উদ্যম ও উৎসাহ মাইকেলেঞ্জেলোর ভাষ্কর্য সৃষ্টির বলিষ্ঠতা স্মরণ করিয়ে দেয় । যে দেশে তিনি অতিথি, সেই দেশের জননায়কের প্রতি ভদ্রতাও হয়তো একটু এই উক্তির উদ্দেশ্য ছিলো । কিন্তু তার পরে বিশদ আলোচনায় রবীন্দ্রনাথ ফাশিজমের বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন, সে কথা আজ আমরা ভুলে যাই । কৌতূহলী শ্রোতাবন্ধুরা কৃষ্ণা দত্ত ও আন্ড্রু রবিনসনের লেখা রবীন্দ্রনাথের জীবনী "মিরিয়ড-মাইন্ডেড ম্যান" বইতে তার উল্লেখ পাবেন । তারপর আর মুসোলিনীর সঙ্গে মধুর সম্পর্ক বজায় ছিলো না ।
মুসোলিনীর ফাশিস্ট পার্টি তখন জনপ্রিয়, জাজ্বল্যমান; আপাতদৃষ্টিতে অতীতের শিল্পকীর্তির থেকে অনেক বেশী মহান । কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তো রবীন্দ্রনাথই; মানুষের কোন কীর্তি অনন্তের সন্ধান দেয়, আর কোন কীর্তি নিতান্ত সংকীর্ণ আত্মকেন্দ্রিক, তিনি বোধহয় বুঝেছিলেন । সময়ের বিচার তারই সমর্থন দিয়েছে । আমার নিজের ছোট্ট কয়েকদিনের ইতালী ভ্রমণে দেখলাম পাঁচ, ছয়, সাতশো বছর আগের শিল্পকীর্তি কি সযত্নে রক্ষিত আছে - অর্ধ-সহস্র বছর আগে মৃত মাইকেলেঞ্জেলোর নাম আজও ইতালীর আপামর জনতার মুখে মুখে; যাঁর মৃত্যুর একশো বছরও হয়নি, সেই বেনিটো মুসোলিনীর নাম কিন্তু রাস্তার কোনো লোকের মুখেও একবারও উচ্চারিত হতে শুনলাম না ।
অনেক কথা হলো । সময়ের বিচার মানুষের মধ্যে দিয়েই । তাই এবার পাঠ আরম্ভ করছি, যাতে আপনারা নিজেরাই বিচার করতে পারেন, শ্রোতাবন্ধুরা, দীর্ঘ সময়ের লিপিপটে প্রায় শতবর্ষ আগে রচিত এই গল্পের স্থানই বা কোথায় । আজকের পাঠ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটো গল্প, "চিত্রকর" ।