নমস্কার শ্রোতাবন্ধুরা, গল্প-কথার আসরের আজকের বৈঠকে যোগদান করার জন্য আপনাদের অজ্স্র ধন্যবাদ । আমি রুদ্র দত্ত । রবীন্দ্র-জন্ম-জয়ন্তীর সপ্তাহান্তে এই পডকাস্টে আমাদের তিন কথকের তিনটি নিবেদন, তাঁর তিনটি গল্পগ্রন্থের থেকে গল্প পাঠ । মহাশ্বেতা পাঠ করেছে রবীন্দ্রনাথের সর্বাধিক প্রচলিত গল্পসংগ্রহ "গল্পগুচ্ছ" থেকে তিনটি গল্প, রাজীব পাঠ করেছে রবীন্দ্রনাথের কাব্যধর্মী গল্পসংগ্রহ "লিপিকা" থেকে তিনটি গল্প, আর আমি নিয়ে এসেছি রবীন্দ্রনাথের শেষবেলার অন্তরঙ্গ অথচ সুদূরপ্রসারী চেতনাচারণের গল্পসংগ্রহ "গল্পসল্প" থেকে তিনটি গল্প । রবীন্দ্রনাথ বা তাঁর সাহিত্যের আলোচনা করার বৈদগ্ধ্য আমাদের নেই - সে চেষ্টা আমাদের পক্ষে ধৃষ্টতা হতো । সে কাজ অনেক জ্ঞানী-গুণীজনে করেছেন, তার থেকে স্বল্প কিছু, আর নিতান্ত পাঠক হিসেবে আমাদের নিজেদের কিছু কথাই শুধু বলছি ।
প্রথমেই বলি এই তিনটি এপিসোডকে এই পরম্পরায় কেন সাজিয়েছি । "গল্পগুচ্ছ" বইয়ের প্রথম প্রকাশ ১৯০০ সালে - বঙ্গাব্দ ১৩০৭ সনে । "লিপিকা" গ্রন্থের প্রকাশ ১৯২২, আর "গল্পসল্প" কবির প্রয়াণের সময়, ১৯৪১ সালে । মনে হতে পারে এই অনুক্রম অনুসরণ করাই উচিত ছিলো, কিন্তু আমরা করছি তার ঠিক উল্টো । আসলে আমাদের মনে হয়েছে রবীন্দ্রনাথের চেতনার ব্যাপ্তিকে কালানুক্রমের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখা চলে না । রবীন্দ্রনাথের উপর ছিলো মহাকালের ছায়া - শেষ বলে কিছু নেই, তাঁর আশি বছরের সৃষ্টিজীবনের শেষের দিকের কীর্তি দেখে বা পড়েও তাঁর যৌবনের বা এমনকি বলা চলে কৈশোরের সৃষ্টিকেও প্রয়োজনাতিরিক্ত মনে করা চলে না - বরং তা আবার গভীর ভাবে পড়ে নতুন উপলব্ধি লাভ করার সুযোগ হয় । তাছাড়া, ১৯০০ সালে প্রকাশিত "গল্পগুচ্ছ"-র পরে আরো একাধিক খন্ড প্রকাশিত হয়েছিলো - সেই প্রথম খন্ডটিতে তিরিশ কি বত্রিশটি গল্প ছিলো মাত্র, অখন্ড "গল্পগুচ্ছ"-তে স্থান পেয়েছে পঁচানব্বইটি গল্প । মহাশ্বেতা তার থেকে যে তিনটি বেছে নিয়েছে তার একটি রবীন্দ্রনাথের রচিত সর্বপ্রথম গল্প - "লিপিকা"-র অনেক আগের রচনা - আর অন্য একটি রবীন্দ্রনাথের অসমাপ্ত রচনার খসড়াগুলির মধ্যে একটি - অর্থাৎ "গল্পসল্প"-এর গল্পগুলিরও পরের রচনা । তাই এই অনুক্রম ।
এবার "গল্পসল্প" সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলে আমার পাঠ আরম্ভ করবো । আগেই বলেছি, কবির প্রয়াণবর্ষে, ১৯৪১ সালে, এর প্রকাশ । শুধু তাই নয়, এই সংকলনের অতিক্ষুদ্র গল্পগুলি - এবং প্রত্যেকটির অনুবর্তী কবিতাগুলি - সবকটিই হয় ১৯৪০ নয় ১৯৪১ সালে রচিত, কেবল একটি ১৯৩৮ । অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের একেবারে শেষের জীবনের রচনা । জীবনযুদ্ধে বহু আঘাতপ্রাপ্ত, মানুষের বিশ্বাসঘাতকতায়, মূঢ়তায় ব্যথিত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উন্মাদনায় স্তম্ভিত, মানবজাতির ত্রাণ সম্পর্কে শঙ্কিত, বহু শারীরিক পীড়ায় জর্জরিত, রবীন্দ্রনাথের এই মূর্তি আমাদের অনেকের কাছেই অপেক্ষাকৃত অপরিচিত । প্রকৃত মহামানবের মতোই, তাঁর চেতনা তখন অনন্তের প্রতি নিবদ্ধ । তারই মধ্যে তিনি এক একটি শাশ্বত সত্যের বিন্দু রেখে গেছেন "গল্পসল্প"-এর এক একটি অতিক্ষুদ্র অনুগল্পের মধ্যে । মুখে মুখে বলে গেছেন - লিপিবদ্ধ করেছেন রানী চন্দ, বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে হয়তো অধ্যাপক ক্ষিতীশ রায় ।
প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও সাহিত্যগবেষক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথের ছোটো গল্পের বিষয়ে কয়েকটি প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন, পরে সেগুলি একত্রিত আকারে "কথাকোবিদ রবীন্দ্রনাথ" নামের একটি বই হিসেবে প্রকাশ পায় । রবীন্দ্রানুরাগী শ্রোতাবন্ধুদের বলবো, বইটি যদি না পড়ে থাকেন, তাহলে অবশ্যই পড়বেন । সেখানে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় "গল্পসল্প" সম্পর্কে বলেছেন, "সাহিত্য হিসেবে বইটির স্বাতন্ত্র্য হয়তো বেশী নেই, কিন্তু স্বাদ আছে । ভাষায় সেই পরিণত বয়সের বুদ্ধিদীপ্ত স্বচ্ছতা, অল্প কথায় এক একটি ছবি ফুটিয়ে তোলার সেই ইন্দ্রজাল; মন্তব্যে সেই শাণিত ঈঙ্গিত । জীবনের শেষ সীমান্তে দাঁড়িয়েও অদ্বিতীয় সেই রবীন্দ্রনাথ ।"
গল্পসল্পের সূচনার কথা জানতে পারি রানী চন্দের লেখা "গুরুদেব" জীবনী থেকে, সপ্তদশ অধ্যায়ে । একদিন রবীন্দ্রনাথ ডেকে পাঠিয়েছিলেন রানীকে, কিন্তু কেন তা রানী প্রথমে বুঝতে পারেননি । রানীর নিজের কথাতেই শুনুন -
"কি হল, কেন ডাকলেন ? হতভম্বের মতো দাঁড়িয়েই থাকি । খানিক বাদে বুড়ি কাজ সেরে নীচে নেমে গেল ।
গুরুদেব এবার মুখ ফিরিয়ে বললেন, কলমটা পাওয়া যাচ্ছে না ।
সে কি কথা? ঘাবড়ে গেলাম ।
গুরুদেব বললেন, খোঁজ পড়ে গেল মশারির চাল পর্যন্ত ।
স্তম্ভিত, বিস্মিত, ভীত যা-কিছু, তখন আমি সব রকমেরই ।
গুরুদেব গম্ভীরতর হয়ে বললেন, আচ্ছা, এই কলমটাই নাও ।
নিলাম ।
বললেন, দেখছ কি? লিখে ফেলো । ʼনীলুবাবুর কলমটা পাওয়া যাচ্ছে না, খোঁজ পড়ে গেল মশারির চাল পর্যন্ত ।ʼ
বাঁচলাম । দম বন্ধ হয়ে এসেছিলো প্রায় । গুরুদেবের মুখেও হাসির রেখা ফুটে উঠল, বলে যেতে লাগলেন - ডেকে পাঠালেন পাড়ার মাধুবাবুকে। বললেন, ʼওহে মাধু, আমার কলমটা?ʼ মাধুবাবু বললেন, ʼজানলে খবর দিতুম।ʼ ধোবাকে ডাক পড়ল, ডাক পড়ল হারু নাপিতকে।
গুরুদেব বলে যেতে লাগলেন আমি লিখতে থাকলাম । তখনি তখনি তৈরি হয়ে গেল গল্প - ʼবিজ্ঞানীʼ । গুরুদেব বললেন, যাও, বাইরে ক্ষিতীশ দাঁড়িয়ে আছে, তাকে দাওগে এটি ।
ক্ষিতীশ এসেছিলো গল্প চাইতে, বিশ্বভারতীর কি একটা কাগজে ছাপতে চায় । তাকে হ্যাঁ, না, কিছু আর কথা না দিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে আমাকে ডেকে পাঠালেন; সঙ্গে সঙ্গে গল্প লিখে দিলেন । গল্পসল্পের শুরু হল এমনি করে ।
অবশ্য এই আরম্ভের পরেও লেখাগুলির সংশোধন এবং পরিমার্জন চলতো । জীবনের এই শেষ সীমান্তেও রবীন্দ্রনাথের রচনাগুলি যে অবহেলায় রচিত নয়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় যে "বুদ্ধিদীপ্ত স্বচ্ছতা"-র কথা বলেছেন তার পিছনে যে আছে রবীন্দ্রনাথের স্বভাবসুলভ পরিশ্রম, সেই সাক্ষ্যও পাই রানী চন্দের লেখা থেকেই । রানী বলেছেন -
যেখানেই যুক্তাক্ষর বা শুদ্ধ ভাষা এসে যেত - তা কেটে কেটে তিনি বলার ভাষায় বদলাতেন । ʼরাজরানীʼ গল্পে যেমন শুরুতে হয়েছিল - ʼআচ্ছা, তা হলে রাজবেশ পরুন - হীরের হার, সূর্যকান্তমণির মুকুট আর প্রবালখচিত কঙ্কন, আর গজমোতির কুন্ডলʼ । তা কেটে করলেন; চুনি-পান্নার হার, মানিক-লাগানো মুকুট, হীরে-লাগানো কাঁকন, আর গজমোতির কানবালা ।
তেমনি - পরলেন কৌপীন নয় কপনি, গায়ে মাখলেন ভস্ম নয় ছাই, ললাটে আঁকলেন ত্রিপুন্ড্রক নয় তিলক, আর হাতে নিলেন কমন্ডলু আর বিল্ব নয় বেলকাঠের দন্ড ।
রবীন্দ্রনাথ কেন এই সহজ ভাষা অবলম্বন করার জন্য এত পরিশ্রম ব্যয় করলেন, তা জোর দিয়ে বলতে পারি না । কিন্তু মনে হয়, শুধু লেখাকে যুগধর্ম অনুগামী করাই তাঁর উদ্দেশ্য ছিলো না । এই লেখাগুলি তিনি নাতনী কুসমিকে বলার ভঙ্গীতে পরে সাজিয়েছেন - রানী চন্দের লেখা থেকেই জানতে পারি গল্পগুলির প্রথম রচনার সময়ে এই উপস্থাপনা ছিলো না, পরে তিনি কুসমির সঙ্গে কথাবার্তার অংশগুলি জুড়ে দিয়েছিলেন - বলেছিলেন, "নয়তো নেহাতই ছোটো গল্প হয়ে থাকতো এগুলো" । কিন্তু মনে হয় যে এই কথার অন্তর্নিহিত কিছু গভীরতর কারণও হয়তো রবীন্দ্রনাথের ছিলো । বইয়ের গোড়াতে ভূমিকার মতো যে কবিতাটি আছে, তাতে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, "আমাদের কাল থেকে, ভাই, এ কালটা আছে বহু দূরে, মোটা মোটা কথাগুলো তাই ব’লে থাকি খুব মোটা সুরে ।" মানে এই পরিণত বয়সের দূরদর্শী চেতনায় রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয়ই এটাও বুঝেছিলেন যে তাঁর এই বহুকষ্টলব্ধ চিন্তাগুলি সর্বজনের কাছে খুব সুখশ্রাব্য নাও হতে পারে । আর সেইজন্যই এই অতি সহজ ভাষার আশ্রয় - তাঁর বাণী গ্রহণের পথে অন্তরায় যতদূর পারা যায় সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা - যে সহজ ভাষাকে রবীন্দ্রনাথ স্বভাবসিদ্ধ লঘু বিনয়ের সঙ্গে বলেছেন "মোটা সুর" । আর কুসমির সঙ্গে কথোপকথনের অবতারণাও হয়তো এইজন্যই - কারণ এই সহজ ভাষায় বলা সহজ সত্যগুলিকে সহজে গ্রহণ করা হয়তো একমাত্র নিরহঙ্কার শিশুহৃদয়ের পক্ষেই সম্ভব ।
লজ্জার সঙ্গে জানাচ্ছি যে কুসমি কে তা আমি নিঃসন্দেহ ভাবে জানি না । রবীন্দ্রবিষয়ে বিজ্ঞ শ্রোতাবন্ধুরা কেউ যদি কোনো প্রমাণ নির্দেশ করতে পারেন, অবশ্যই জানাবেন, আমি কৃতজ্ঞ থাকবো । এই বইয়ের উৎসর্গ রবীন্দ্রনাথের নাতনী নন্দিতাকে - নন্দিতা ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সর্বকনিষ্ঠা কন্যা মীরা দেবীর পুত্রী, যিনি পরে স্বাধীনতা-সংগ্রামী কৃষ্ণ কৃপালনীকে বিয়ে করেছিলেন । বইয়ের গোড়ায় রবীন্দ্রনাথ ও নন্দিতার ফোটোগ্রাফ আছে, কবির মৃত্যুর মাত্র কয়েকদিন আগের তোলা । নন্দিতার ডাকনাম ছিলো বুড়ি । অনুমান করি, নন্দিতাই "গল্পসল্প"-এর কুসমি - হয়তো তাঁর আর একটি ডাকনাম ।
"গল্পসল্প"-এর গল্পগুলির রচনাকালে নন্দিতার বয়স পঁচিশ । কিন্তু গল্পগুলি পড়লে কুসমিকে অনেক ছোটো মেয়ে বলে মনে হয় । তা অবশ্য হতেই পারে, কারণ রবীন্দ্রনাথ হয়তো বাল্যের কুসমিকে স্মরণ করেই লিখেছিলেন । পাঠ করার সময় আমি কুসমিকে ছোটো মেয়ে মনে করেই করেছি ।
আরম্ভ করার আগে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের থেকে আর একটি উদ্ধৃতি দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না । তিনি লিখেছেন - "প্রতিভায় মণি-রত্নের অভাব তো ছিল না কোনোদিন - মণি-মন্দির গড়া শেষ হয়ে গেল । তারপর যা কিছু ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ইতস্ততঃ পড়ে ছিল, তাই নিয়ে শিল্পীর খেয়ালের খেলা চলল । কিন্তু পাথরের টুকরোর ভেতরেও এখানে-ওখানে দু-চারটি হীরে-মানিক ছিল - গল্পসল্পের পাতায় পাতায় তারাই ঝিকমিক করে উঠেছে ।"
অনেক কথা হলো, এবার আরম্ভ করছি গল্পসল্প থেকে আজকে আমার নির্বাচিত প্রথম গল্পের পাঠ । ছোটো মেয়েকে বলা গল্প উপলক্ষ করে অতি সহজ ভাষায় এক শাশ্বত সামাজিক সত্য - প্রসঙ্গতঃ রবীন্দ্রনাথের নিজের সহানুভূতি সেই সমাজের কোন স্তরে, তাও পরিষ্কার করে বলা । রবীন্দ্রনাথের অনুগল্প "বড় খবর" ।
--------------
গল্পসল্প থেকে দ্বিতীয় যে গল্পটি পাঠ করবো, সেটির প্রধান রস এক অদ্ভুত ব্যক্তির অদ্ভুতত্বের থেকে উদ্ভুত । তার প্রতি ব্যঙ্গ আছে এই গল্পে, কিন্তু কিছুটা সহমর্মিতাও যেন আছে । আসলে অলৌকিক বা অতিপ্রাকৃত প্রসঙ্গ বিশ্বাস করার জন্য আমাদের মনে যে সহজাত বিশ্বাস করার তাগিদ আছে, ব্যঙ্গের প্রধান লক্ষ আসলে বোধহয় সেটাই । অপবিজ্ঞান বা সায়েন্টিজ্ম আজও আমাদের সমাজের অনর্থকারী, তাই এই গল্পও আজও সময়োপযোগী । রবীন্দ্রনাথের অনুগল্প "ম্যাজিশিয়ান" ।
---------------
গল্পসল্প থেকে আমার শেষ যে পাঠ, প্রথমে মনে হতে পারে তা একেবারেই ননসেন্স । কিন্তু এই গল্প যে কতটা ভবিষ্যতমুখী, তার পুরো মূল্যায়ন বোধহয় এখনো হয়নি । গল্পের নায়ক বাচস্পতি সম্পূর্ণ নতুন সব শব্দ সৃষ্টি করেন, আর তার থেকেও বড় কথা যে সেইসব শব্দের ব্যাকরণ বা অভিধান রচনা করা অপ্রয়োজনীয় মনে করেন । ভারী অদ্ভুত কথা, কিন্তু সুগভীর । প্রথমতঃ, নতুন শব্দ প্রচলনের চিন্তা বেশ বৈপ্লবিক । নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় লিখছেন, "ভাষা যখন বহু-ব্যবহৃত হতে হতে তার ধার এবং ব্যঞ্জনা-শক্তি হারিয়ে ফেলে - তখন স্বভাবতই শিল্পীকে নতুন ভাষা আবিষ্কার করতে হয়, তার নবায়ন ঘটে । কোনো কোনো স্বতন্ত্র বক্তব্যের জন্যে সম্পূর্ণ নতুন প্রকাশের প্রয়োজন পড়ে - সে কথা স্মরণে রেখেই জেমস জয়েস তাঁর ভাষা ও ভাষ্যের সমন্বীতি সাধন করেছিলেন - তাঁকে কেউ বাচস্পতির মতো পাগল বলার স্পর্ধা রাখে না ।"
এর থেকেও বড় কথা হলো, যে "শব্দের আপন কাজই হচ্ছে বোঝানো, তাকে আবার বোঝাবে কে", বাচস্পতির এই মন্তব্য এক প্রগাঢ় সত্য, যার সম্পর্কে কোনো ধারণাই বাচস্পতির সময়ের বৈজ্ঞানিকদের ছিলো না । আধুনিক ভাষাতাত্বিক গবেষণার একটি শাখা, মনোভাষাবিজ্ঞান বা সাইকোলিঙ্গুইস্টিকস, এই সত্যকে সবেমাত্র গত দুই দশকে উদ্ঘাটন করতে আরম্ভ করেছে । কিছু কিছু ধ্বনির বিশেষ বিশেষ সহজাত অর্থ আছে, যা মানুষের ভাষা সৃষ্টির থেকেও প্রাচীন, এবং যাকে অবলম্বন করেই আদিম মানুষের কথ্য ভাষা প্রথম গড়ে ওঠে, যেমন ম- বা ল-ধ্বনির সহজাত অর্থ নরম, আর ক- বা ট-ধ্বনির সহজাত অর্থ তার উল্টো । এইসব ধ্বনির সমন্বয়ে তৈরী শব্দের মানেও সেই সহজাত অর্থকে অনুসরণ করে, তাই কোনো কোনো শব্দ মোলায়েম এবং পেলব, আর অন্য কোনো শব্দ কঠিন বা কাঠখোট্টা । আর সেইজন্যই, কোনো অভিধানের তোয়াক্কা না করেই, বাচস্পতি যখন বলেন যে সেক্রেটারি চৌকি থেকে তড়তং করে উৎখিয়ে উঠলেন, তার মানে বুঝতে আমাদের অসুবিধা হয় না । কোনো কৌতূহলী শ্রোতাবন্ধু যদি এ বিষয়ে আরো জানতে চান, আন্তর্জালে সাইকোলিঙ্গুইস্টিকস, কিংবা বুবা-কিকি এফেক্ট (Bouba Kiki effect) সম্বন্ধে খোঁজ করলে নিশ্চয়ই পাবেন ।
একশো বছর আগে এ কথা প্রায় কেউই বোঝেননি, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন । তাঁর নিজের রচনায় তিনি কিছু শব্দের আর্ষ প্রয়োগ করে গেছেন, আর শেষ জীবনে বলে গেছেন বাচস্পতির কথা । রবীন্দ্রনাথের অনুগল্প, "বাচস্পতি" ।
---------------