নমস্কার শ্রোতাবন্ধুরা, গল্পকথার আসরের আজকের বৈঠকে যোগদান করার জন্য আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ । আমি রুদ্র দত্ত । শ্রাবণ মাস অতিক্রান্ত হতে চললো - দিন দশেক আগে ছিলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণতিথি বাইশে শ্রাবণ । এই বাইশে শ্রাবণে আমাদের স্মরণ এবং শ্রদ্ধার্ঘ হিসেবে, আজ থেকে পাঠ করতে আরম্ভ করবো একটি শ্রুতিপুস্তক, যাতে লেখিকা রবীন্দ্রনাথের শেষ জীবনকে অতি যত্ন এবং ভালোবাসা নিয়ে ধরে রেখেছেন - রানী চন্দের লেখা "গুরুদেব" । এই বই থেকে দুটি পরিচ্ছেদ আগে একবার পাঠ করেছিলাম - এখন পুরো বইটিই পাঠ করবো, শ্রোতাবন্ধুদের সুবিধার জন্য সেই দুটি পরিচ্ছেদের পাঠও এর মধ্যে থাকবে ।
রানী চন্দ রবীন্দ্রনাথের বিশেষ স্নেহধন্যা হওয়ার ফলে সেইটাই হয়তো আমাদের অনেকের কাছে রানী চন্দের প্রধান পরিচয় হয়ে দাঁড়িয়েছে । আর আজ যে শ্রুতিপুস্তকটির পাঠ আরম্ভ করছি, সেটি অবশ্যই সম্পূর্ণভাবে রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করে । কিন্তু রানী চন্দ নিজে একজন বিশিষ্ট স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব । তাঁর অন্য ভাইবোনেদের মতই তিনি ছিলেন শিল্পী, আবার সুলেখিকাও ছিলেন । তাঁর "পূর্ণকুম্ভ" গ্রন্থের জন্য তিনি রবীন্দ্র-পুরষ্কারে ভূষিত হন । শান্তিনিকেতনে তাঁকে নিয়ে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং - সেই গল্প আজ যে বইটি পাঠ করবো তাতেই আছে । রানীর বাবা কুলচন্দ্র দে ছিলেন রবীন্দ্রনাথের নিকট বন্ধু । শান্তিনিকেতনে প্রথমে রানীর চর্চা ছিলো সঙ্গীত, নৃত্য, ও শিল্প নিয়ে । রবীন্দ্রনাথের প্ররোচনাতেই রানী প্রথম কলম ধরেন - অবনীন্দ্রনাথের মুখে শোনা রবিকাকার গল্প নিয়ে তৈরী হয় বই, যার নাম দেওয়া হয় "ঘরোয়া" । অবনীন্দ্রনাথ বইয়ের গোড়ায় লিখে দিয়েছিলেন, "কল্যাণীয়া রানী, আমি বলেছি, তুমি লিখেছো।" রবীন্দ্রনাথ নিজে "ঘরোয়া" বইটি পড়ে খুব খুশী হয়েছিলেন - বলেছিলেন, "এই বইটা বের হলে একটা সময়কার ইতিহাস জানতে পারবে ।" পরের জীবনে রানী পেয়েছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সোনার মেডেল, সাহিত্যকীর্তির জন্য রবীন্দ্রভারতীর সম্মানসূচক ডি. লিট । স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে, ১৯৪২ সালে, ইংরেজ সরকার তাঁকে জেলে অন্তরীণ করেছিলো - সেই নিয়ে তিনি তাঁর "জেনানা ফাটক" গ্রন্থ রচনা করেন । স্বাধীন ভারতের প্রতিনিধি হয়ে একাধিক বার সাংস্কৃতিক দৌত্য করতে ইউরোপ ও রাশিয়ায় গেছিলেন । শেষের জীবনে ফিরে এসেছিলেন শান্তিনিকেতনে ।
"গুরুদেব" বইটিতে রানী চন্দের জীবনে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি লিপিবদ্ধ আছে । প্রথমে বন্ধু কুলচন্দ্র দের মেয়ে হিসেবে, পরে ব্যক্তিগত সেক্রেটারি অনিলচন্দ্র চন্দ-র স্ত্রী হিসেবে, এবং কবির শেষ জীবনে বস্তুতঃ গুরুদেবের ডান হাত হিসেবে রানী-র যে অভিজ্ঞতা, তা সত্যিই অনন্য । ডান হাতের কথাটা অত্যুক্তি নয় - কবিগুরুর শেষ কিছু কবিতা নিজের হাতে লিখে রাখার ক্ষমতা তাঁর ছিলো না - তিনি মুখে মুখে বলতেন, আর রানী লিখতেন । এই বইটিতে সেই সব অভিজ্ঞতার কথাই আছে ।
বইয়ের গোড়াতেই রানী লিখছেন - "সন তারিখ মনে নেই - মনে থাকেও না ।" অন্যান্য পরিচ্ছেদেও একাধিকবার উল্লেখ করেছেন যে সময়ের বিশেষ পরম্পরা মানার চেষ্টা না করে যখন যে স্মৃতি কথাপ্রসঙ্গে এসেছে তাই লিখেছেন । কিন্তু একদম কালানুক্রমিক না হলেও, রানীর রবীন্দ্র-অভিজ্ঞতার পরম্পরা এই বইয়ে মোটামুটি বজায় আছে । এই বইয়ের ব্যাপ্তি আনুমানিক তেরো বছর । বইয়ের গোড়ায় রানী ষোলো বছরের অপরিণতা কিশোরী, আর সাতষট্টি বছর বয়স্ক প্রৌঢ় রবীন্দ্রনাথ খ্যাতি ও কর্মযজ্ঞের শিখরে । আর বইয়ের শেষ আশি বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণ দিয়ে । তাই পাঠক হিসেবে, কখন কোন বয়সের রানীর চোখে আমরা কোন বয়সের রবীন্দ্রনাথকে দেখছি, তা একটু খেয়াল রাখলে এই বইটির মূল্য, এবং এর থেকে আমাদের উপভোগ ও প্রাপ্তি, অনেকটা বাড়ে বলেই আমার মনে হয় ।
রানীর জন্ম ১৯১২ খৃস্টাব্দে । বিভিন্ন বিবরণ থেকে যতদূর বুঝতে পারি, মাত্র পাঁচ বছর বয়সে তিনি বাবা কুলচন্দ্র দে-কে হারান । রানীর রবীন্দ্রনাথকে প্রথম স্বচক্ষে দেখা যখন তাঁর সতেরো বছরের বড় বড়দা শিল্পী মুকুলচন্দ্র দে তাঁকে - এবং ছোটো বোন অন্নপূর্ণাকে - শান্তিনিকেতনে নিয়ে যান, ১৯২৭ কি ২৮ সালে - এই ঘটনা দিয়েই রানী চন্দ-র "গুরুদেব" গ্রন্থের শুরু । চৌরঙ্গীর বাড়িতে যখন রবীন্দ্রনাথ তাঁদের সঙ্গে এসে কিছুদিন থেকেছিলেন, তা তার অনতিবিলম্বেই । মনে করে আশ্চর্য লাগে, যে যখন পিতৃহারা কিশোরী দুই বোনকে তিনি শান্তিনিকেতনে নিজের আশ্রয়ে নিয়ে চললেন, কয়েকবছর পরে যখন রানীর বিয়ে নিয়ে জটিলতা দেখা দিলো, তখন নিজে সেইদিকে দৃষ্টি দিয়ে নিজের হাতে যখন তার বিয়ের দায়িত্ব তুলে নিলেন - যে কথা এই বইয়ের তৃতীয় পরিচ্ছেদে আছে - তখন রবীন্দ্রনাথ এক বিশ্ববরেণ্য মানুষ - সমস্ত পৃথিবীর দ্বার যাঁর কাছে খোলা, যাঁর প্রতিটি কথা শোনার জন্য দেশবিদেশ থেকে টমাস মান, রবার্ট ফ্রস্ট, বার্নার্ড শ, বা রোমা রোলাঁর মত মানুষেরা অপেক্ষা করে থাকেন । আবার যখন শুনি রানীর স্বামী অনিলচন্দ্র পোষাকী ব্যানকোয়েটে খেতে বসে টুপি খুলে রাখার জন্য রবীন্দ্রনাথের কাছে ধমক খাচ্ছেন, তখন সমাজপতি, বিশ্বনাগরিক রবীন্দ্রনাথকে চিনে নিতে অসুবিধা হয় না । আর তার অনেক পরে, জীবনের গোধূলির ম্লান আলোয় দেখি অন্য এক রবীন্দ্রনাথকে, যিনি একাধারে জীবনের রহস্যভেদী কাব্য সৃষ্টি করে চলেছেন, আবার নিজের জীবনে শিশুর মতো সরল ছেলেখেলা আরম্ভ করেছেন খাদ্য, পরিধেয়, বাসস্থান নিয়ে । এ কথা ঠিক যে রানী স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কোথাও কোথাও পরের কথা আগে বলেছেন, আবার ফিরে এসেছেন । কিন্তু যেসব ঘটনা রানী বর্ণনা করেছেন, তার প্রতি একটু খেয়াল রাখলে কালের পরম্পরা বুঝতে অসুবিধা হয় না । আর সবচেয়ে বড় কথা এই যে, যে শ্রদ্ধা-ভক্তি-ভালোবাসা-স্নেহ নিয়ে রানীর দৃষ্টি রবীন্দ্রনাথকে জড়িয়ে থেকেছিলো, তা রানীর স্বচ্ছ, সাবলীল ভাষার দ্বারা শুধু আমাদের বোধগম্যই হয় না, একেবারে হৃদয় জয় করে নেয় । সব মিলিয়ে, রানী চন্দের "গুরুদেব" বাংলা ভাষা আর সংস্কৃতির এক মূল্যবান দলিল তো বটেই, আবার অপূর্ব সাহিত্যসৃষ্টিও বটে ।
শ্রোতাবন্ধুরা, আরম্ভ করছি আজকে পাঠ । শুনতে থাকুন শ্রুতিপুস্তক, রানী চন্দ রচিত "গুরুদেব" । আজ প্রথম পর্ব ।