রাজীব: পরাশর? ওই নামে একজন মুনি ছিলেন না পুরাণে?
রুদ্র: ছিলেন। তাতে কি হল?
রাজীব: পরাশর বর্মা? শর্মা নয়, একেবারে বর্মা? এটা কি ভার্মার বঙ্গীয় করণ?
রুদ্র: মনে হয় না। বর্মন এর অপভ্রংশ ও হতে পারে। পরাশর বর্মন - ছন্দ ভাঙতো আর পরাশর শর্মা? নৈব নৈব চ।
রাজীব: হুম। শ্রোতা বন্ধুরা, আমাদের এই আজব আলাপ চারিতা শুনে অবাক হচ্ছেন তো? হওয়ারই কথা! রুদ্র কে প্রথমেই বলেছিলাম যে বেমোক্কা এই রকম নামের পতন মানে namedrop করা মোটে ভালো কাজ না।
রুদ্র: তুই থাম। শ্রোতা বন্ধুরা, গল্প কথার আসরের আজকের অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্যে আপনাদের অশেষ ধন্যবাদ। আমি রুদ্র দত্ত।
রাজীব: আর আমি রাজীব ঘোষ।
রুদ্র: আজ আমরা দুজনেই একসাথে আসরে ঢুকে পড়েছি কারণ আজ আপনাদের কাছে কোনো এক বিশেষ সাহিত্যিক কে নয়, এক পরিচিত সাহিত্যিকের এক বিশিষ্ট চরিত্র কে প্রথম বার উপস্থিত করার তাগিদে।
রাজীব: প্রেমেন্দ্র মিত্র বাংলা সাহিত্যে বলা যায় এক যুগান্তরী পুরুষ ছিলেন। একাধারে তিনি প্রথিতযশা কবি, সামাজিক গল্প উপন্যাসের কালজয়ী রচয়িতা, অন্যদিকে আবার তিনিই কল্প বিজ্ঞান ভিত্তিক গল্প উপন্যাসের কান্ডারী, চিত্রনাট্য লেখক, চলচিত্র পরিচালক - মানে একজন মানুষের পক্ষে যা কিছু করা সম্ভব সব কিছু তিনি করে ছেড়েছেন। এই প্রেমেন্দ্র মিত্রের সৃষ্টি করা এক অসাধারণ চরিত্র পরাশর বর্মা আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়।
রুদ্র: পরাশর বর্মা প্রেমেন্দ্র মিত্রের গোয়েন্দা গল্পের ডিটেকটিভ। শ্রোতা বন্ধুরা হয়ত বলবেন, তো সে আর কি এমন মহার্ঘ্য ব্যাপার ! প্রায় প্রতি বাঙালী সাহিত্যিকই তো একজন করে গোয়েন্দা চরিত্রের সৃষ্টি করে গেছেন । ব্যাপার আছে। পরাশর বর্মা যে সে গোয়েন্দা না, সে একাধারে দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা, অন্যদিকে, সে আধুনিক কবি!
রাজীব: এই রাজ জোটক ব্যাপারটা বাংলা সাহিত্যে ঠিক ঘটে নি কখনও। ব্যোমকেশ, ফেলুদা, কিরীটি, জয়ন্ত, ইন্দ্রনাথ রুদ্র, দীপক অধিকারী কাউকেই এই দ্বৈত ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা যায় নি।
রুদ্র: শুধু তাই নয়, পরাশরের ওয়াটসন কৃত্তিবাসের সঙ্গে প্রথম পরিচয়েই, পরাশরের নিজের জবানীতে এ কথা পরিষ্কার, যে পরাশর প্রথমত ও প্রধানত কবি, সেটাই তার আসল পরিচয় । গোয়েন্দাগিরিটা খুবই গৌণ, একটা শখের ব্যাপার বলা যেতে পারে ।
রাজীব: পরে অবশ্য জানা যায়, যে গোয়েন্দাগিরিতে অসামান্য প্রতিভাধর পরাশরের সঙ্গে যোগাযোগ আছে পুলিশ থেকে সি আই ডি-র সমস্ত উপরমহলের, যাঁরা পরাশরের মতামতকে বেশ শ্রদ্ধা করেন ।
রুদ্র: অথচ পরাশরের কাছে তা ছেলেখেলা । আবার পরাশরের কাছে যা সত্যি তাৎপর্যময়, সেই কবিত্বে কিন্তু পরাশর একেবারেই পারদর্শী নয় । খাতার পর খাতা ভরতি কবিতা লিখে থাকলেও, তার একটা লেখাও কিন্তু ছাপার অক্ষরে গৃহীত হয়নি । আর যে কৃত্তিবাস গোয়েন্দাগিরিতে পরাশরের গুণমুগ্ধ, সেই একই কৃত্তিবাস, পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে, পরাশরের কবিতা পাঠ করে নাক কুঁচকে তা ছাপতে অস্বীকার করেছে বারে বারে ।
রাজীব: গল্পের মধ্যে এই যে একটা বাড়তি মজার সূত্রপাত, এবং গল্পের নায়কের মধ্যে একই সঙ্গে একটু pathos, একটু বেদনার ভাব, তা প্রেমেন্দ্র মিত্রের আশ্চর্য প্রতিভারই একটি প্রকাশ । পরাশর আর কৃত্তিবাসের এই দ্বৈত সম্পর্ক - গোয়েন্দাগিরিতে কৃত্তিবাস ছেলেমানুষ, পরাশর অভিজ্ঞ - আবার সাহিত্য প্রকাশনার জগতে কৃত্তিবাসই ক্ষমতাশীল, পরাশর দয়াপ্রার্থী - এও বেশ অভিনব ।
রুদ্র: আর তারও মধ্যে প্রচ্ছন্ন আছে সাহিত্যের সব শাখায় যাঁর অবাধ বিচরণ, সেই প্রেমেন্দ্র মিত্রের একটু চাপা হাসি । পরাশর যে কবিতাগুলি নিয়ে কৃত্তিবাসের দ্বারস্থ হয়, সেগুলি অবশ্যই প্রেমেন্দ্রকেই লিখে দিতে হয়েছে । এবং গতানুগতিক না হলেও, কবিতাগুলি আসলে বেশ চমকপ্রদ এবং আসলে খুব modern - কোনো অর্থেই তা খারাপ লেখা বলা যায় না । অথচ কৃত্তিবাস সেগুলোকে waste paper basket ছাড়া কোথাও স্থান দিতে নারাজ । তৎকালীন বাংলা সাহিত্যজগতে কোনো কোনো সম্পাদক বা প্রকাশনার গোঁড়ামিকে লক্ষ করেই বোধহয় প্রেমেন্দ্র মিত্র এই irony-টুকু ঢুকিয়েছিলেন ।
রাজীব: আচ্ছা, গোয়েন্দা আবার কবি, এরকম চরিত্রের প্রস্তাবনা করাটা কি নেহাৎ কষ্টকল্পনা ? আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে, কঠিন কাজ, অপরাধ জগৎ আর অপরাধীর মনস্তত্ত্ব নিয়ে যাদের কাজ কারবার, তাদের কবিতা লেখার সময় কোথায় মশাই? প্রেমেন্দ্র তাঁর জবাব দিয়েছেন নিজের জবানীতে। এডগার অ্যালান পো যিনি ছিলেন কবি ও রোমাঞ্চ গল্পের বিখ্যাত মার্কিন লেখক, তাঁরই লেখার অনুপ্রেরণায় দুনিয়ার বিখ্যাত গোয়েন্দা নায়ক দের জন্ম - এরক্যুল পোয়ারও বা শার্লক হোমস্। কাজেই কবিতার সাথে কোথাও বুঝি রহস্যময়তার একটা যোগসূত্র থেকে গেছে অলক্ষ্যে বা অজান্তেই ।
রুদ্র: পরাশর এর জন্ম টাও ভারী অদ্ভুত ভাবে, প্রেমেন্দ্র লিখে গেছেন। এক দিন তিনি যখন কোনো একটা ওষুধ কোম্পানির প্রচার সচিব হিসেবে কাজ করছেন আর তার সাথে একটা পত্রিকার সম্পাদনাও করছেন তখন একজন পত্রিকা তে বিজ্ঞাপন দিতে এসে তাঁর কাছে একটা অদ্ভুত খুঁটিয়ে দেখার ক্ষমতা প্রকাশ করে প্রেমেন্দ্র কে অবাক করে দিয়েছিলেন। ঠিক তার পরেই ফিরে এসে তিনি পত্রিকার জন্যে জমা দেওয়ার কবিতার বান্ডিল গুলো দেখেন আর তৎক্ষণাৎ তাঁর মাথায় পরাশর বর্মা র নামটা মাথায় আসে!
রাজীব: অদ্ভুত সমাপতন! আচ্ছা, প্রথম পরাশরের গল্প তো ১৯৩২ সালে, তাই না? তারপরে বহুদিন বিরতি?
রুদ্র: হ্যাঁ, প্রথম একটি বা দুটি গল্প লেখার পরে অনেকদিন বোধহয় পরাশরকে ভুলেই গেছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র । তার পরে মুম্বাই তে তিনি লেখেন পরের গল্প ১৯৫৪ সালে যখন যখন তিনি ফিল্মিস্তান নামক ফিল্ম কোম্পানির কাজে মুম্বাইতে।
রাজীব: ঘন ঘন লেখেন নি পরাশর কে নিয়ে কিন্তু নিজেই বলেছেন যে, " জাত যদি যায় যাক, তবু নির্লজ্জভাবে স্বীকার করছি যে রহস্য কাহিনী আমি ভালবাসি!"
রুদ্র: পরাশরকে নিয়ে প্রেমেন্দ্র মিত্র যে গল্প-উপন্যাসগুলি রচনা করেছেন, তার কোনোকোনোটির স্বাদ অ্যাডভেঞ্চারের, কিন্তু অনেকগুলিরই স্বাদ খাঁটি রহস্য কাহিনীর মতো । এই দ্বিতীয় ধরণের লেখা কিন্তু বাংলায় আসলে খুব কম । বহু নামীদামী সাহিত্যিকই তাঁদের প্রিয় ডিটেকটিভ চরিত্রের সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু তাদের কীর্তিকলাপ যতই রোমাঞ্চকর হোক না কেন, তাতে অ্যাডভেঞ্চারের বা রোমহর্ষকতার স্থান বেশী - সত্যি রহস্য এবং রহস্যভেদের ভূমিকা কম । এর উজ্জ্বল ব্যতিক্রম শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যোমকেশ বক্সী ।
রাজীব: হ্যাঁ, প্রেমেন্দ্র মিত্র তো নিজেই লিখেছিলেন, "বর্তমান কালে অন্যান্য ভাষার মতো বাংলা সাহিত্যেও ডিটেকটিভ গল্পের প্রাচুর্য যথেষ্ট, কিন্তু দুঃখের কথা এই যে, উচ্চাঙ্গের এই জাতীয় মৌলিক রচনা খুব বেশী চোখে পড়ে না । শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর সমান দরের লেখকের নাম বলতে বেশ আকাশ-পাতাল ভাবতে হয় ।"
রুদ্র: পাঠক হিসেবে, এবং প্রেমেন্দ্র-পরবর্তীদের লেখা পড়েও, আমাদেরও এই কথাই মনে হয়েছে । আর তাই এই সপ্তাহান্তে আমি আর রাজীব দুজনেই পাঠ করছি পরাশর বর্মার গল্প । এর পরেও পরাশর বর্মাকে মাঝে মাঝে আপনাদের কাছে নিয়ে আসার ইচ্ছা রইলো । তাই তো, রাজীব?
রাজীব: ইচ্ছে তো তাই। আরেকটা কথা, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতোই, প্রেমেন্দ্র মিত্র ও চলচিত্র জগতের সাথে কিছুদিন গাঁটছড়া বেঁধে ছিলেন। পরাশর এর বেশ কিছু গল্প পড়তে পড়তে মনে হয় যেন একটা সিনেমা দেখছি। তোর মনে হয়েছে এটা রুদ্র?
রুদ্র: কিছুটা, হয়েছে বৈকি। সেটা অবশ্য প্রেমেন্দ্র মিত্রের লেখায় নতুন কিছু নয় - শরদিন্দুর মতোই, তাঁর বেশিরভাগ লেখাই যেন চোখের সামনে ছবি তুলে ধরে । পরাশরের কিছু কিছু গল্পেও, তা অতি স্পষ্ট ।
রাজীব: যাক, আর কিছু বলে দিলে বেশি বলা হয়ে যায়। শ্রোতা বন্ধু দের হাতে বা কানেই এই বার পরাশর কে ছেড়ে দেওয়া উচিৎ নয় কি?
রুদ্র: যথার্থ কথা। তবে তাই হোক। আমাদের বাচালতা বন্ধ করে এইবার তাহলে গল্প পাঠে ফিরি।
রাজীব: নমস্কার।