নমস্কার শ্রোতাবন্ধুরা, "গল্প-কথার আসর"-এর আজকের বৈঠকে যোগদান করার জন্য অজস্র ধন্যবাদ । আমি রুদ্র দত্ত । এই ষষ্ঠ সীজনে চেনা সাহিত্যিকদের অচেনা চরিত্রদের আপনাদের কাছে নিয়ে আসার যে প্রচেষ্টা আমরা করছি, আজকের পাঠ তার একটি ।
আমাদের অতি পরিচিত নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়কে টেনিদা-র স্রষ্টা হিসেবে আমরা সবাই চিনি; আবার স্বাধীনতার অব্যবহিত পূর্বের আর পরের সময়ের সামাজিক পটভূমিতে তাঁর প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য লেখা রুদ্ধশ্বাস, বিদ্রোহমূলক সমাজচিত্রের গল্পের সঙ্গেও আমাদের পরিচয় আছে - এই পডকাস্টের সেইরকম গল্পও আমরা বেশ কিছু পাঠ করেছি । কিন্তু বড়দের জন্য মজার গল্প লিখতে গিয়ে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় সৃষ্টি করেছিলেন একটু ব্যতিক্রমী একটি চরিত্রের, যার নাম তপন চৌধুরী । এই চরিত্রকে নিয়ে তিনি গল্প রচনা করেছিলেন মাত্র আটটি । সেই গল্পগুলি পরে "তপন চরিত" বলে একটি সংকলন হিসেবে আনন্দ গোষ্ঠী প্রকাশ করেন ১৯৭৩ সালে - কিন্তু তার পরে বহুদিন তা out of print ছিলো । অনেক বছর পরে নিউস্ক্রিপ্ট প্রকাশনী আবার তা প্রকাশ করেন ২০১৭ সালে, আমি সেই সংস্করণ থেকেই পাঠ করছি । এই সংস্করণে নারায়ণের পুত্র অরিজিতের লেখা ভূমিকা থেকে জানতে পারি, তৎকালীন "দেশ" পত্রিকা সম্পাদক সাগরময় ঘোষ নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়কে অনুরোধ জানান বড়দের জন্যও মজার গল্প লিখতে, তার থেকেই তপনের জন্ম । গল্পগুলির একটা পরম্পরা থাকা সত্তেও, প্রত্যেকটিই স্বতন্ত্র একটি গল্প - কোনো বড় উপন্যাসের ধারাবাহিক অংশ নয় । আজ তার প্রথম গল্পটি পাঠ করবো ।
পাঠ আরম্ভ করার আগে দুটি কথা বলে নেওয়া দরকার । প্রথমতঃ, গল্পের পটভূমিকা এবং তপন আর লেখক-চরিত্র সুকুমারের আদান-প্রদান কিছুটা প্রাপ্তবয়স্ক ঢঙের হলেও, এই গল্পগুলির মধ্যে এমন কিছুই নেই যা শিশু পাঠকদের গ্রহণযোগ্য নয় - সত্যি বলতে কি, আমার মনে পড়ে যে আমি যখন প্রথম তপনের সন্ধান পাই, তখন আমি নেহাতই ছোটো - স্কুলের নীচু ক্লাস - এবং তা সত্তেও গল্পগুলি সানন্দে উপভোগ করেছিলাম । তবে একটা সূক্ষ্ম তফাৎ হয়তো আছে । আসলে যেখানেই কৌতুক, সেখানেই অন্তরালে একটু করুণ-রসও অনেক সময়েই থাকে । টেনিদা-র গল্পে সেই করুণ-রস বা pathos যতটা অন্তরালে, তপনের গল্পে হয়তো আর একটু বেশী প্রকট ।
আর দ্বিতীয় যে কথাটি বলতে চাই, তা হয়তো আসলে এই করুণ রসেরই একটি উদাহরণ । তপন চরিত্রটিকে নারায়ণ কল্পনা করেছেন একটু তোতলা হিসেবে । কথা বলতে গিয়ে যাঁদের জিভে এবং মুখগহ্বরে আটকে যায়, কষ্ট হয়, তাদের নিয়ে হাসাহাসি করাটা অভব্য এবং স্থুল মনে করাটাই এখনকার সুধী পাঠক বা শ্রোতার পক্ষে স্বাভাবিক । মনে হতে পারে যে উনিশশো-ষাটের দশকে হয়তো বাঙালীর রুচিতে তা বাধতো না, এবং নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় যুগধর্মই পালন করেছেন । কিন্তু গল্পগুলি পড়লে দেখা যায় যে তপনের তোতলামোকে লেখক অসভ্য হাসির খোরাক হিসেবে ব্যবহার করেননি - তার থেকে বেশ বুদ্ধিদীপ্ত হাস্যরসই সৃষ্টি করতে চেয়েছেন । সবথেকে বড় কথা এই যে এইধরণের বাকপ্রতিবন্ধকতা মানুষকে যেভাবে marginalized বা প্রান্তিক করে রাখে, তপনের ক্ষেত্রে কিন্তু কিছুমাত্র তার লক্ষণ দেখা যায় না । বরং তার ব্যবহারে মনে হয় সে এটাকে গায়ই মাখে না - এটা বেশ স্বাভাবিক; উল্টে যখন তার মুখে সুকুমারের নাম সু-সু-সুক হয়ে যায়, তখন তপন সেটাকে বেশ ডাঁটের মাথায় সুকুমারের মোটা হয়ে যাওয়ার প্রবৃত্তির দিকে কটাক্ষ করার উপলক্ষ করে তোলে । সত্যি বলতে, অনেকটা টেনিদা-র মতোই, তপনকে কিছুটা মাস্তান, যাকে ইংরেজীতে বলে bully, বলে বোধ হয় ।
তাই মনে হয় নিছক হাল্কা হাসি ছাড়াও তপনকে তোতলা করার পিছনে যেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের কোনো সূক্ষ্মতর উদ্দেশ্য ছিলো । সর্বপ্রথম, একজন তোতলা মানুষ সেইজন্য নিজেকে প্রতিবন্ধী মনে করছে না, সেইটা দেখানো । আর সেইসঙ্গে হয়তো যে কথাটা তিনি মনে করিয়ে দিচ্ছেন তা হলো এই যে আমরা সকলেই আসলে কোনো না কোনো অর্থে প্রান্তিক, সংখ্যালঘিষ্ঠ । মোটা লোকের ওজন নিয়ে ঠাট্টা করাটাও তো ভদ্রজনোচিত নয় ! কিন্তু বন্ধুত্বের দাবীতে আমরা অনেক কিছুই মেনে নিতে পারি, সুকুমারের মেদ আর তপনের তোতলামো, বা তাই নিয়ে পরস্পরকে খোঁটা দেওয়া, কোনোটাই তাদের মধ্যে অলঙ্ঘ্য বাধা হয়ে ওঠে না । পাঠকদেরও, টেনিদা বা তপন, কাউকেই প্রধানতঃ bully বলে ঘৃণা করার কথা মনে হয় না - তাদের বন্ধু পরিচয়টাই মুখ্য হয়ে ওঠে । আসলে সেটাই হয়তো মনে করিয়ে দেওয়া নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের আসল উদ্দেশ্য ছিলো । আমরা প্রত্যেকেই তো এক হিসেবে একা - minority of one ; ঠিক আমাদের মতো সামর্থ্য আর অসামর্থ্যের সমন্বয় তো আর কোনো একজন মানুষের নেই । কিন্তু এই বিশাল পৃথিবীতে সেই একা একা আমরা যদি পরস্পরের সঙ্গে বন্ধুভাবাপন্ন হতে পারি, তবে আমাদের অসামর্থ্য কাটাকুটি হয়ে যায়, আর আমরা যে বৃহত্তর সামর্থ্য গড়ে তুলতে পারি, তার নামই তো মানবসমাজ । তাই দুজন ত্রুটিপূর্ণ মানুষের বন্ধুত্বের গল্পই হয়তো পৃথিবীর সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ গল্প । তপনের গল্পগুলি শোনার সময়ে এই কথাটা খেয়াল রাখবেন আশা করি, শ্রোতাবন্ধুরা ।
তাহলে আরম্ভ করছি আজকের পাঠ, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের "তপন চরিত"-এর প্রথম গল্প, "গান শোনাবার নিমন্ত্রণ" ।