নমস্কার শ্রোতা বন্ধুরা। গল্পকথার আসরের আজকের অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য আপনাদের অশেষ ধন্যবাদ। আমি রাজীব ঘোষ । আজ থেকে পড়া শুরু করতে চলেছি সাহিত্যিক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস "গৌড় মল্লার" ।
এই উপন্যাস টি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৫৪ সালে। গুরুদাস চট্টপাধ্যায় এন্ড সন্স নামক প্রকাশনী সংস্থা থেকে । পরবর্তী কালে আনন্দ পাবলিশার্স শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক উপন্যাস গুলিকে অমনিবাস আকারে প্রকাশ করেন - আমি তাদের প্রকাশ করা তৃতীয় খণ্ড থেকেই এই পাঠ করবো। লেখকের ডাইরি থেকে জানা যায় যে এই উপন্যাসের প্রথমে নাম ছিল "মৌরী নদীর তীরে" । কয়েক পরিচ্ছেদ লেখার পরে নতুন নামকরণ হয় - "গৌড় মল্লার" । উপন্যাস টি শরদিন্দু লেখা শুরু করেন ১৭ই জুন ১৯৫০ সালে এবং শেষ করেন ২০শে সেপ্টেম্বর ১৯৫২ সালে। অর্থাৎ প্রায় সোয়া দুই বছর ব্যাপ্ত ছিল এই লেখার পরিধি।
শ্রোতা বন্ধুরা, "গৌড় মল্লার" উপন্যাস টি বাংলার ইতিহাস নির্ভর, এটি বাঙালির প্রাচীন ইতিহাস। গল্পের সময়কাল খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকের গোড়ার দিকের থেকে মাঝ বরাবর। ঐতিহাসিক সময়কাল বিচার করে বলা যায় মোটামুটি ৬২৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৬৪৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত - যদিও গল্পে এই সময়কাল কে সঠিক ভাবে বলা নেই। স্বাধীন বাংলা দেশের প্রথম উত্থান বলা যায় গৌড় রাজ্য দিয়ে যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মহারাজ শশাঙ্ক দেব। ধর্মে তিনি ছিলেন শৈব কিন্তু অল্প বিস্তর উৎপীড়ন বাদ দিলে সেই সময়ের এক প্রধান ধর্ম বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে হিন্দু ধর্মের সহাবস্থান তাঁর রাজত্ব কালে বজায় ছিল। বাংলা তথা গৌড় এই সময়ে বাণিজ্যে, সংস্কৃতি তে, ধন সামগ্রী তে ভারত বর্ষে বিশেষ স্থান অধিকার করেছিল। অধুনা মুর্শিদাবাদ জেলায় কর্নসুবর্ন নগরে ছিল তাঁর রাজধানী। তাঁর মৃত্যুর পরে, কামরূপ-রাজ ভাস্করবর্মা গৌড় আক্রমণ করেন এবং কর্নসুবর্ন দখল করেন। শশাঙ্কদেবের পুত্র মানবদেব যুদ্ধে প্রাণ হারান এইরকমই ইতিহাস বলে। এই সময় থেকেই বাংলার দুর্দশার শুরু। তারপরে দীর্ঘ ১০০ বছর ধরে ঘোর নৈরাজ্য চলে যাকে বাংলার ইতিহাসে মৎসন্যয় বলে বর্ণনা করা আছে। শেষে পাল বংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপাল এসে শান্তি শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে। এই উপন্যাসে শরদিন্দু সেই মাৎস্যন্যায় এর প্রাথমিক পর্যায়ের গল্প কিছুটা শুনিয়েছেন যখন বাংলার বাণিজ্যলক্ষ্মী সাগরে বিসর্জিত হতে চলছে - একদিকে শক্তিশালী রাজার অভাবে, আর অন্যদিকে আরব জলদস্যুদের নতুন ধর্মের উদ্দীপনায়।
এরই মাঝে যে গল্পটি বলা হয়েছে তার কিছু কিছু চরিত্র ও ঘটনাস্থল ঐতিহাসিক হলেও মূল গল্পটি সম্পূর্ন লেখকের কল্পনা প্রসূত। নালন্দার মহাস্থবির শীলভদ্র, রাজা জয়নাগ এবং রক্তমৃত্তিকা মহাবিহার সম্পূর্ণ ঐতিহাসিক। বাকি চরিত্র ও ঘটনাবলী কাল্পনিক। ইতিহাস অনুযায়ী আচার্য্য শীলভদ্র প্রয়াত হন ৬৪৫ খ্রিস্টাব্দে আর ভাস্কর বর্মার শাসনকাল শেষ হয় ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে। এখানেও লেখক কিছুটা স্বাধীনতা নিয়েছেন ঘটনা বিস্তারে। তাতে আমার মতে কিছু মাত্র সমস্যা হয় নি।
এবারে বলি, এই গল্প পাঠ এর একটা নেপথ্য কারণ। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন যে বাঙ্গালী জাতি তার ইতিহাস বিস্মৃত হইয়াছে। যে জাতির ইতিহাস নাই তাহার ভবিষ্যত ও নাই। এই কথার গভীরতা আমাকে প্রভাবিত করেছিল বহুদিন। বর্তমান যুগে দাঁড়িয়ে আমার মনে হয়েছে আমরা বুঝি আবার এক মাৎস্যন্যায় পর্বের মধ্যে দিয়ে চলেছি।
সেই পরিপ্রেক্ষিতে "গৌড় মল্লার" উপন্যাসটির গুরুত্ব যেন অন্য মাত্রা পেয়েছে আমার কাছে। এই গল্পে শেষে দেখা যায় যে সিংহাসন প্রধান নয়, মনুষ্যত্বই আসল, মানবিকতাই প্রধান। এই সত্য যেমন দেড় হাজার বছর আগে সত্য ছিল তেমন আজও সত্য আছে। এই বোধ থেকেই "গৌড় মল্লার"-কে শ্রুতিপুস্তকের আকারে আপনাদের কাছে নিয়ে আসার ইচ্ছে জেগেছিল। প্রায় এক বছরের প্রয়াসে এই প্রকল্পটি বাস্তব রূপ পেল। আমার আশা আপনাদের ভালো লাগবে বাংলা ও বাঙ্গালীর এই প্রাচীন ইতিহাস। যদি ভালো লাগে, তাহলে দুটি অনুরোধ করবো। এক - অবশ্যই শরদিন্দু অমনিবাস এর তৃতীয় খণ্ডটি পারলে কিনে পড়বেন। আর দুই, ঘুরে আসবেন একবার মুর্শিদাবাদের কানসোনা থেকে, যার কাছেই ছিল ঐতিহাসিক কর্ণসুবর্ন নগর। ওর কাছেই আছে রক্ত মৃত্তিকা মহাবিহারের প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ যা ১৯৬০-এর দশকের খনন কার্যের আবিষ্কার। ওই অঞ্চলের মানুষদের ক্ষোভ এই যে, এইরকম একটি ঐতিহাসিক স্থান যথাযথ সংরক্ষণ ও প্রচারের অভাবে তার মর্যাদা পায় নি পর্যটকদের কাছে। এই গল্প শুনতে শুনতে হয়ত বুঝতে পারবেন যে তাদের এই অভিযোগ ভিত্তিহীন নয়। কর্নসুবর্ন এবং রক্তমৃত্তিকা বিহার সত্যিই বাংলার দুই উজ্জ্বল নক্ষত্র ।
এইখানে থামি এইবার। শুনতে থাকুন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালজয়ী ঐতিহাসিক উপন্যাস "গৌড় মল্লার" ।