নমস্কার শ্রোতাবন্ধুরা - গল্পকথার আসরের আজকের বৈঠকে যোগদান করার জন্য আপনাদের অশেষ ধন্যবাদ । আমি রুদ্র দত্ত । শ্রোতাবন্ধুরা জানেন, এই রবীন্দ্রজন্মতিথির সপ্তাহান্তে গল্পকথার আসরের তিনজন কথক রবীন্দ্রনাথ রচিত তিনটি গল্প পাঠ করছি, যা পরবর্তী কালে তিনটি সার্থক চলচ্চিত্রের প্রেরণা হয়ে দাঁড়ায় । আমি পাঠ করছি "খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন", যা তাঁর গল্পগুচ্ছ গ্রন্থের অন্তর্গত । রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আর নতুন কিছু বলতে যাওয়ার বোধহয় কোনো সার্থকতা নেই; এই গল্পটি এবং চলচ্চিত্রটি সম্বন্ধে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কথা বলি ।
গল্পটি রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ১৮৯২ সালে, অর্থাৎ একত্রিশ বছর বয়সে । রবীন্দ্রনাথের মতো মানুষের ক্ষেত্রে একে পরিণত বয়সের পাকা হাতের লেখা বলতে দ্বিধা নেই । রবীন্দ্রনাথ তখন শিলাইদহে - গল্পগুচ্ছের অনেক গল্পই এই শিলাইদহ-বাসের সময় রচিত । সাধারণ মানুষের দুঃখ দারিদ্র্যের সঙ্গে পরিচয় ভালোভাবেই ঘটেছে - যার বেদনা, যার প্রতি সহানুভূতি, গল্পগুচ্ছের অনেক গল্পেই আছে । আর মানবচরিত্রের বিচিত্র গতিবিধি, অতি সাধারণ মানুষের মনেরও যে জটিলতা, তার ছাপও অনেক গল্পে সুস্পষ্ট - যেমন আজকে যে গল্পটি পাঠ করবো সেটিতে ।
গল্পটির সাহিত্যমূল্যর উপরেও একটু নজর দিতে হয় । গল্পগুচ্ছের বিভিন্ন গল্পের মেজাজ, কথনভঙ্গী, রচনাশৈলী, ভিন্ন ভিন্ন ধরণের - গল্পের প্রয়োজন বুঝে, এবং কিছুটা হয়তো রবীন্দ্রনাথের আপনাকে জানার জন্য গবেষণার খাতিরেও । অনেকের মতে, তৎকালীন ফরাসী গল্পে ছাড়া ছাড়া সংক্ষিপ্তচিত্র অর্থাৎ vignette-ধর্মী প্রয়োগ রবীন্দ্রনাথকে আকৃষ্ট করেছিলো - এবং তিনি নিজেও কিছু সেইরকম সাহিত্য রচনা করেছিলেন । এই প্রসঙ্গে "চতুরঙ্গ" উপন্যাসটির কথা সাধারণতঃ উঠে থাকে । আমার মনে হয়েছে, "খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন" গল্পটিও কিছুটা এই ধাঁচে রচিত । গল্পে তিনটি পরিচ্ছেদ - প্রথমটি এবং তৃতীয়টি এক-একটি বিশেষে সময়ের ঘটনা যা স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে রবীন্দ্রনাথের বর্ণনায় । মাঝখানের পরিচ্ছেদটি যেন নেহাতই পটভূমি - তাকে ইচ্ছে করেই যেন কিছুটা দূরত্ব রেখে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হয়েছে, যাতে তা দুইটি ছবির মাঝখানে সেতু রচনা করে মাত্র, ব্যবধান যেন না রচনা করে ।
"খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন" চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায় ১৯৬০ সালে, অর্থাৎ রবীন্দ্রশতবার্ষিকীতে । ১৯৬০ এবং ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকে স্মরণ করার, এবং তার অনুসরণে নতুন শিল্পসৃষ্টির প্রতি অনেকেই বিশেষ মনোযোগ দেন - এই ছবিটিও সম্ভবতঃ তারই একটি নিদর্শন । এর পরিচালকের নাম ছিলো অগ্রদূত । এই অগ্রদূত বাংলা চলচ্চিত্রের এক অদ্ভুত ঘটনা - যার তুলনা অন্য কোনো চলচ্চিত্র পরম্পরায় আছে বলে আমার জানা নেই । ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভের সময় থেকে প্রায় চল্লিশ বছর ধরে অগ্রদূত খান তিরিশেক সিনেমা করেছিলেন, যার মধ্যে "খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন" ছাড়াও রয়েছে "অগ্নিপরীক্ষা", "পথে হলো দেরী", বা "ছদ্মবেশী" প্রমুখ জনপ্রিয় অনেক চলচ্চিত্র - কিন্তু অগ্রদূত কোনো একজন মানুষ ছিলেন না । বেশ কয়েকজন সিনেমাকর্মী - যাঁরা নিজেরা কেউই প্রাথমিক ভাবে পরিচালক ছিলেন না - একত্রে অগ্রদূত নাম নিয়ে, অন্য কোনো পরিচালকের ব্যবহার ছাড়াই, সিনেমা বানাতেন । সময়ের সঙ্গে এই গোষ্ঠীর সদস্যদের অদল-বদল ঘটেছে - কেউ বিদায় নিয়েছেন, তো নতুন কেউ যোগদান করেছেন - কিন্তু অগ্রদূত এগিয়ে চলেছে । অবশ্য অনেকেই স্বীকার করেছেন যে ক্যামেরাম্যান বিভূতি লাহা ছিলেন অগ্রদূতের মধ্যমণি, এবং প্রধান হোতা । আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে এইরকম গোষ্ঠীমূলক চলচ্চিত্র পরিচালনার উদাহরণ বাংলা সিনেমাতে আরো আছে - যেমন অগ্রগামী, যাত্রিক, এবং আরো কেউ কেউ । কিন্তু যতদূর জানি বাকি গোষ্ঠীগুলির সবকটিতেই অন্ততঃ একজন পরিচালক ছিলেন - এবং সবগুলিরই পত্তন অগ্রদূতের পরে । অগ্রদূত সত্যিই অগ্রদূত ।
এই সিনেমাটির একটি বৈশিষ্ট্য অবশ্যই উত্তমকুমারের অভিনয় । উত্তমকুমার নায়ক হয়ে যান তাঁর চলচ্চিত্র জীবনের প্রথম দিকেই - এবং ক্রমে মহনায়ক - আশ্চর্য অভিনয়-প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও গতানুগতিক অভিনয় ছাড়া ভালো চরিত্রাভিনয় করার সুযোগ তিনি খুব বেশীবার পাননি, কারণ মহানায়ককে পার্শ্ব চরিত্রে কল্পনা করার সাহস বা আগ্রহ প্রায় কারুরই থাকতো না । অবশ্যই সত্যজিৎ রায়ের "নায়ক" ছবি এর অন্যতম ব্যতিক্রম - যেখানে উত্তমকুমার এক নায়ক চরিত্রের ভূমিকাতেই চরিত্রাভিনয় করে দেখিয়েছেন । মাত্র পঞ্চান্ন বছর বয়সে তাঁর প্রয়াণ - নইলে হয়তো উত্তমকুমারের অভিনয়-প্রতিভার সার্থক প্রয়োগ এবং মূল্যায়ন দুই হতে পারতো । তবুও, এরই মধ্যে, উত্তমকুমার কিছু ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন, যা প্রধান চরিত্র, কিন্তু নায়কোচিত নয় - যেখানে তাঁর অভিনয়ের ব্যাপ্তি প্রকাশ পায় । "ধনরাজ তামাং" ছবিটির কথা এই প্রসঙ্গে কেউ কেউ উল্লেখ করেন । এবং বহু দর্শকই একমত, যে "খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন" তাঁর অভিনয়ক্ষমতার একটি নিদর্শন । মহানায়ক যে দীনহীন চাকরের ভূমিকায়ও অভিনয় করতে পারেন, তা অনেকেরই কল্পনার বাইরে ছিলো ।
আর কথা বাড়াচ্ছি না । রবীন্দ্রজন্মের তিথি আগতপ্রায় । এই পুণ্য তিথিতে তাঁর চেতনা ও স্মৃতির উদ্দেশ্যে প্রণাম জানিয়ে আরম্ভ করছি আজকের পাঠ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প, "খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন" ।