নমস্কার শ্রোতাবন্ধুরা, "গল্প-কথার আসর"-এর আজকের বৈঠকে যোগদান করার জন্য অজস্র ধন্যবাদ । আমি রুদ্র দত্ত । আজকের এই এপিসোড থেকে আরম্ভ করছি শ্রুতিপুস্তক - শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক উপন্যাস, "কালের মন্দিরা" ।
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক উপন্যাস এই পডকাস্টে এর আগে পাঠ করেছি - আমাদের তৃতীয় সীজনের শেষে আমি পাঠ করেছিলাম "তুমি সন্ধ্যার মেঘ", আর চতুর্থ সীজনের শেষে রাজীব পাঠ করেছিলো "গৌড়-মল্লার" । "তুমি সন্ধ্যার মেঘ"-এর ঘটনাকাল আজ থেকে প্রায় হাজার বছর আগে, মহম্মদ ঘোরীর ভারত আক্রমণেরও আগে । "গৌড়-মল্লার" আরো আগের কথা - আজ থেকে তেরোশো বছর আগে, বাংলার অরাজক সময়ের কাহিনী - শশাঙ্কদেবের গৌড় সাম্রাজ্যের পতনের পর, আর গোপালদেবের নেতৃত্বে পাল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠার আগে । আর "কালের মন্দিরা", আজ থেকে যার পাঠ আরম্ভ করবো, তারো আগের কথা - এখন থেকে পোনেরোশো বছর আগে, ভারতে হুন আক্রমণের সময় ।
ঐতিহাসিক উপন্যাসে শরদিন্দু অনন্য, সেকথা "তুমি সন্ধ্যার মেঘ" পাঠ করার সময় বলেছি; চমকপ্রদ ঘটনাবিন্যাস, নিখুঁত চরিত্রচিত্রণ, আর মর্মস্পর্শী আবেগের দ্বারা অতীতের সমাজচিত্রকে অতি অন্তরঙ্গ বাস্তব রূপ দিতে শরদিন্দু যেরকম পেরেছেন সেরকম দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত বাংলা সাহিত্যে বোধহয় আর নেই, সারা বিশ্বের সাহিত্যেই বোধহয় তা বিরল । একটা মজার কথা মনে পড়ছে; এই পডকাস্টের একেবারে গোড়ার দিকে, আমাদের প্রথম সীজনে, তিরিশ নম্বর এপিসোডে, শরদিন্দুর লেখা যে আমাদের চোখের সামনে প্রায় চলমান ছবি এঁকে দেয় তার উদাহরণ দিতে গিয়ে বন্ধুবর রাজীব এই "কালের মন্দিরা" উপন্যাসেরই একটি অনুচ্ছেদ বেছে নিয়েছিলো ।
কিন্তু আগেও বলেছি, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় শুধু মুখরোচক গল্পের সামগ্রী হিসেবে, শুধু পাঠকদের চিত্তবিনোদনের তৈরি রসদ হিসেবে ইতিহাসকে দেখেননি । বরং ইতিহাসকে মুখরোচক করে তোলার কঠিন কাজ শরদিন্দু হাতে নিয়েছিলেন একটা কর্তব্য হিসেবেই । শরদিন্দু নিজে ঐতিহাসিক ছিলেন না, কিন্তু ইতিহাসমনস্ক ছিলেন - এবং তাঁর প্রজন্মের সাধারণ বাঙালী যে ইতিহাসবিমুখ, তা তাঁর কাছে ক্ষোভের বিষয় ছিলো বলেই বুঝতে পারি । সেইজন্যই তিনি বলেছেন, "বাঙ্গালী যতদিন না নিজের বংশগরিমার কথা জানিতে পারিবে ততদিন তাহার চরিত্র গঠিত হইবে না; ততদিন তাহার কোনো আশা নাই । যে জাতির ইতিহাস নাই, তাহার ভবিষ্যৎ নাই ।"
"কালের মন্দিরা" উপন্যাসও এই ইতিহাসের প্রতি কর্তব্যপালনের এক নজির । ১৯৩৮ খ্রীষ্টাব্দে শরদিন্দু এই লেখা আরম্ভ করেন । সমাজে ভাঙ্গন, ভাইয়ে ভাইয়ে বিভেদ, সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ, তখনই হয়তো শরদিন্দুর চোখে পড়েছিলো, ব্রিটিশ শাসকের প্ররোচনায় যা বাড়তেই থেকেছিলো । লেখায় ছেদ পড়ে যায়, কিন্তু দীর্ঘ দশ বছর বাদে, ১৯৪৮ সালে, শরদিন্দু এই উপন্যাসের বাকিটা লিখে শেষ করেন , হয়তো একই তাড়নায় । কারণ উপন্যাসের ভূমিকায় শরদিন্দু খুব পরিষ্কার করে বলে দিয়েছেন যে এই কাহিনীর মূল মন্ত্র হলো ঐক্যের, ধারাবাহিকতার, মিলনের । বিভেদের নয় । মানবসমাজের ইতিহাসে সহস্র সহস্র বছর ধরে যত যুদ্ধ, শান্তি, বৈরী, মৈত্রীর পুতুলখেলা, তার পিছনে মহাকালের যে মহানৃত্যের করতাল নিরবচ্ছিন্নভাবে বেজে চলেছে, শরদিন্দু তা শুনতে পেয়েছিলেন, আর তা পাঠকের শোনাতে চেয়েছিলেন ।
তাঁর নিজের লেখা ভূমিকাটুকু পড়ে নিয়ে কাহিনীপাঠ আরম্ভ করবো । তার আগে পাঠ সম্পর্কে একটা কথা বলে নেওয়া প্রয়োজন মনে হয় । শরদিন্দুর প্রখ্যাত পাঁচটি ঐতিহাসিক উপন্যাসের মধ্যে এইটিই সবথেকে আগে লেখা । হয়তো সেইজন্যই, কিংবা হয়তো বিষয়বস্তুর সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখার জন্যই, এই উপন্যাসে সাধুভাষার সবথেকে বেশী প্রয়োগ । আজকের পাঠকদের কাছে প্রথমদর্শনে - বা শ্রবণে - তা একটু ভীতিকর হতেই পারে । কিন্তু আসলে ভয় পাবার সেরকম কোনো কারণ নেই । এক-একটি একটু হোঁচট খাওয়ার মতো অপ্রচলিত বা প্রাচীন শব্দে মাঝে মাঝে থাকলেও, এই উপন্যাসের বেশিরভাগই যথেষ্ট সরল ভাষায় রচিত । আর শক্ত শব্দগুলিও, যেসব বাক্যে যেমনভাবে ব্যবহার হয়েছে, তাতে আপনাআপনিই মানে বুঝিয়ে দেয় । শ্রোতাবন্ধুরা জানেন, আমাদের লক্ষ্য সাহিত্যিকদের সৃষ্টি যতটা সম্ভব ঠিক যেমনটি তাঁরা রচনা করেছেন, তেমনই পাঠ করা । এখানেও তাই করছি । এই কথা আবার বলার কারণ এই যে, অতি দুঃখের সঙ্গে বলছি, যে আজকের যুগের কোনো স্বনামধন্য পেশাদারী বিনোদনশিল্পী এই উপন্যাসের একটি সংস্করণ প্রকাশ করেছেন, তাকে "পাঠ" বলতে ইচ্ছা হচ্ছে না, কারণ সমস্ত অপ্রচলিত শব্দ বাদ দিয়ে, সমস্ত সাধুভাষাকে নিজের মতো চলিত ভাষা করে নিয়ে, কোনো একরকম ভাবে গল্পটি বলেছেন । এই প্রচেষ্টা আমাদের ভালো লাগেনি । অবশ্যই সাধুভাষা বুঝতে সামান্য একটু চেষ্টা করতে হতে পারে - কোনো শব্দের অর্থ না জানলে সেটা বুঝে নিতে - বা নেহাৎ দরকার হলে অভিধান দেখে নিতে - একটু সামান্য কষ্ট করতে তো হতেই পারে । সে কষ্ট করার মতো অবস্থায় সব শ্রোতা সবসময়ে না থাকতেই পারেন । কিন্তু যাঁদের যখন এইরকম বই পড়ার - বা তার শ্রুতিপুস্তক শোনার - প্রবৃত্তি হবে না, তাঁদের তো নিজেদের কষ্ট দেওয়ার কোনো প্রয়োজ্ন নেই । পড়ার, শোনার, দেখার জিনিষের তো অভাব নেই । কিন্তু কোনো লেখক যে লেখা লিখে গেছেন, তার অঙ্গহানি করে, তাকে বিকৃত করে পরিবেশন করার কি প্রয়োজন ? অন্য কোনো শিল্পবস্তু নিয়ে এই ব্যবহার করা আমরা কি সহ্য করবো ? পিকাসোর অনেক ছবি বোঝা শক্ত, তা বলে নিজের সাধ্যমত মোমরঙ জলরঙে নিজের বোধশক্তির সীমারেখার মধ্যে কিছু একটা এঁকে সেটাকে পিকাসোর ছবি বলে প্রদর্শন করলে কি তা দণ্ডনীয় অপরাধ হয়ে দাঁড়ায় না ? ভাষার ক্ষেত্রেও তো একই কথা প্রযোজ্য - যাঁরা কোনোদিন কিছু লিখতে চেষ্টা করেছেন তাঁরাই একবাক্যে স্বীকার করবেন যে যথেচ্ছ কথার পরে কথা সাজিয়ে গেলেই তা সাহিত্য হয় না । আর বিশেষ করে সেই ভাষা যদি শরদিন্দুর কারুশিল্পের মতো সযত্নে গড়ে তোলা সাহিত্য হয়, তাহলে তার একটা কথ্য ভাষায় যেমন তেমন করে বলা সংস্করণ বাজারে চালিয়ে দিয়ে, মৌলিক শিল্পবস্তুটাকে সেকেলে বা অচল করে দেওয়ার প্রচেষ্টা, তাকে আড়াল করে দেওয়া, তো বাংলা ভাষা আর সংস্কৃতির উপর রীতিমত আক্রমণ । তার থেকে সেটাকে সেটার মতো থাকতে দেওয়াই তো ঠিক । কারণ কোনো না কোনো পাঠক, শ্রোতা, দর্শকও তো থাকবেন, যাঁরা মূল সাহিত্য, মূল শিল্পটার রস পেতে আগ্রহী, যাঁরা সেই সময়টা, সেই চেষ্টাটা দেওয়ার অবস্থায় আছেন । তাঁদের জন্যই রক্ষিত থাকবে সেই মণিরত্নগুলি - যেমন ইংরেজ সমাজে শেক্সপীয়রের কাব্যের একটা কথার বদলও সহ্য করা হয় না, এমনকি চসারের সুপ্রাচীন মধ্য ইংরিজি ভাষায় লেখা ক্যান্টারবরি টেলসও একই ভাবে সযত্নে রক্ষিত । আমরা বাঙালীরা আমাদের ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যগুলির প্রতি তার চেয়ে কম মনোযোগী হতে যাবো কেন ?
তাই আমাদের এই ছোট্ট পডকাস্টে, আমাদের সীমীত সাধ্যের মধ্যেও, গর্বের সঙ্গে জানাচ্ছি, শরদিন্দুর রচিত ভাষা, আনন্দ পাবলিশার্সের প্রামাণ্য ১৯৭৩ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত সম্পাদিত শরদিন্দু অমনিবাসের তৃতীয় খন্ড থেকে, অক্ষরে অক্ষরে পাঠ করছি । শুনতে গিয়ে এক-এক জায়গায় নিশ্চয়ই কোনো শ্রোতাবন্ধুর একটু হোঁচট লাগতে পারে - পাঠ করতে গিয়ে আমারও অনেকবার লেগেছে । কিন্তু তা সত্ত্বেও উপভোগটাই অনেক বেশী হবে, এই বিশ্বাস রাখি । আর নেহাৎ যদি কোনো কথার মানে নিয়ে খুবই বিব্রত বোধ করেন - শ্রোতাবন্ধুরা, আমরা পণ্ডিত নই, কিন্তু আমরা প্রতিজ্ঞা করছি, যদি আমাদের জানান, আমরা যেখান থেকে পারি তার অর্থ উদ্ধার করে দেবো । প্রশ্ন পাঠানোর জন্য ইউটিউবে কমেন্ট দিতে পারেন, বা আমাদের ওয়েবসাইট থেকে আমাদের ইমেইলগ্রুপে যোগদান করে ইমেইল পাঠাতে পারেন ।
অনেক কথা হলো, এইবার পাঠ আরম্ভ করি । প্রথমেই পাঠ করছি শরদিন্দুর এই উপন্যাসের জন্য রচিত ভূমিকা -
এই কাহিনীর ঐতিহাসিক পটভূমিকা ... তাহার তাল কাটে নাই । - শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, ৪-২-১৯৫০ মালাড্ ।
শুনতে থাকুন শ্রুতিপুস্তক, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক উপন্যাস, "কালের মন্দিরা"; আজ প্রথম পর্ব ।