শ্রোতা বন্ধুরা, গল্পকথার আসরের আজকের অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য অশেষ ধন্যবাদ । আমি রুদ্র দত্ত ।
আজকে পাঠ করবো বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি ছোটো গল্প । সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পরিচয় নতুন করে দেবার কোনো প্রয়োজন নেই ; বাঙালী পাঠক মাত্রেই এই নামের সঙ্গে অতি পরিচিত । তাঁর ছাপ্পান্ন বছরের জীবৎকালের প্রায় পুরোটাই ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্দ্ধে । পেশায় আইনজীবী, যশোরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্র্রেট এবং পরে ডেপুটি কালেক্টার, কিন্তু তাও ইংরেজ শাসকের মুখর সমালোচক, অথচ পরবর্তী জীবনে রায়বাহাদুর খেতাব এবং অন্যান্য সম্মানপ্রাপ্ত - বঙ্কিম কিন্তু আগে সাহিত্যিক, পরে সমাজসচেতন আইনজীবী । কবিতা লিখতে শুরু করেন ছাত্রজীবনেই - প্রথম প্রকাশিত রচনাও কবিতা, কবি ঈশ্বর গুপ্তের সম্পাদিত পত্রিকায় । প্রথম গদ্য রচনা ইংরেজীতে - কারণ বোধহয় এই যে তখন বাংলাতে উপন্যাস লেখার চল ছিলো না । ১৮৬৫ সালে, সাতাশ বছর বয়সে, তাঁর প্রথম বাংলা উপন্যাস "দুর্গেশনন্দিনী" প্রকাশিত হয়, যা বাংলা ভাষার প্রথম গদ্য উপন্যাসও বটে । মোটকথা, বাংলা সাহিত্যে যাকে আধুনিক যুগ বা নবজাগরণের যুগ বলা যায়, যার অগ্রণী এবং অমিতবলশালী হোতা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অনেকের হিসেবেই তার শুরু কিন্তু রবীন্দ্রনাথের অল্প আগে - বঙ্কিমচন্দ্রের হাতেই সেই যুগের সর্বপ্রথম অভিষেক ।
কিছু প্রবন্ধ এবং ধর্মবিষয়ক টীকাটিপ্পনি ছাড়া বঙ্কিমচন্দ্রের যে প্রধান অবদান, তা অবশ্যই উপন্যাস । বিষবৃক্ষ, আনন্দমঠ, দেবী চৌধুরাণী, প্রমুখ উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের মুকুটরত্ন । আজ যা পাঠ করতে চলেছি, সেটাকে কিন্তু ছোটো গল্পই বলতে হবে । নেশাখোর, স্পষ্টদর্শী, বীতরাগ অথচ সম্পূর্ণ অরসিক নয় - এইরকম একটি চরিত্র সৃষ্টি করেন বঙ্কিম, যার নাম দেন কমলাকান্ত । এই কমলাকান্তের জীবনদর্শন নিয়ে বেশ কয়েকটি ছোটো ছোটো গল্প রচনা করেন । একত্রে সেগুলি নাম "কমলাকান্তের দপ্তর" । তার মধ্যে কয়েকটি আবার চিঠির আকারে রচিত - আর একটি আধা-গল্প, আধা-নাটক, যার নাম "কমলাকান্তের জবানবন্দী" । এই রচনাগুলির পরিচয় দিতে আবার বঙ্কিম আমদানী করেছেন শ্রীভীষ্মদেব খোসনবীশ বলে এক চরিত্রের - পরে খোসনবীশ জুনিয়রের উল্লেখও পাই, তিনি যে আইনজীবী তাও অনুমান করা যায় - বঙ্কিমেরই আর এক বেশ তা পাঠককে বলে দিতে হবে না ।
কমলাকান্তের গল্পগুলির বৈশিষ্ট্য এই যে, তাঁর অন্য রচনায় বঙ্কিম প্রধানতঃ বাস্তবানুগ চরিত্র চিত্রণ করেছেন, এবং তাদের উপযোগী ঘটনা ও সংলাপ রচনা করেছেন - কাহিনীকারের যা প্রধান কর্তব্য । কিন্তু কমলাকান্তের সৃষ্টি হয়েছে কমলাকান্তকে দিয়ে বঙ্কিম যে কথাগুলি বলিয়ে নিতে চান, তার প্রয়োজনেই । বঙ্কিমের বাঁকা হাসি, ব্যঙ্গ, কখনো ক্ষোভ, দুঃখ, কখনো হতাশা প্রকাশের জন্যই কমলাকান্তের ডাক পড়েছে । কমলাকান্ত প্রকৃত অর্থেই বঙ্কিম ।
এই গল্পগুলির ভাষা প্রধানতঃ সাধুভাষা, এবং তা আজকের পাঠকের পক্ষে সম্পূর্ণ সুগম নয় । মাঝে মাঝে আবার সংস্কৃত উদ্ধৃতিও আছে । তৎকালীন রাজনীতি ও সাহিত্যের উল্লেখও বারবার কমলাকান্তের কথায় চলে আসে, তা সম্পূর্ণভাবে বুঝতে গেলে গল্প পড়া ছেড়ে ইতিহাস অধ্যয়ন করতে বসতে হয় । কিন্তু তা না করলেও, কমলাকান্তের দপ্তরে আধুনিক পাঠকের পক্ষে যথেষ্ট রসাস্বাদনের সুযোগ রয়েছে । সেইটুকু যদি আপনাদের কাছে পৌঁছে দিতে পারি - এই আশায় আজকের পাঠ; এর পরেও মাঝে মাঝে কমলাকান্তের গল্প কিছু পড়ার ইচ্ছা রইল । আজকে প্রথমে পাঠ করছি শ্রীভীষ্মদেব খোসনবীশের ভূমিকা, তারপর কমলাকান্তের দপ্তরের প্রথম সংখ্যা । তাহলে আরম্ভ করছি আজকের পাঠ, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের গল্প, "একা" ।