নমস্কার শ্রোতাবন্ধুরা, "গল্প-কথার আসর"-এর আজকের বৈঠকে যোগদান করার জন্য অজস্র ধন্যবাদ । আমি রুদ্র দত্ত । আজ পাঠ করবো নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি গল্প । কিন্তু আজ এই আসরে এই প্রথম নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের এমন গল্প পাঠ করবো, যা ছোটোদের জ্ন্য লেখা মজার গল্প নয় । সেরকম গল্প, বিশেষ করে টেনিদার গল্প, এই পডকাস্টে আমরা বেশ কিছু পাঠ করেছি । বাঙালী পাঠকের কাছে এই রচনাগুলিই হয়তো বর্তমানে সবথেকে বেশী পরিচিত এবং জনপ্রিয় হয়ে আছে । কিন্তু নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের মূল পরিচয় কিন্তু সমাজমনস্ক, ইতিহাস-সচেতন, মানবদরদী সাহিত্যিক হিসেবে । বাংলা ভাষা আর সাহিত্য যদি ভবিষ্যতে অব্যাহত থাকে, তাহলে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের সাহিত্যরচনার প্রকৃত মূল্যায়নে হয়তো এই রচনাগুলিই তাঁর সার্থক কীর্তি হিসেবে স্বীকৃতি পাবে । আমাদের পডকাস্টে আমরা চেষ্টা করেছি যা পরিচিত ও বহুচর্চিত শুধু তাই পাঠ না করার - বরং বাংলার যে মণিরত্নগুলি এই মুহূর্তে বাঙালী পাঠকসমাজের দৃষ্টির একটু বাইরে, তারই উপরে আলোকপাত করার । তাই নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের সাহিত্যের এই দিক থেকে কিছু গল্প, যা মজার গল্প নয়, যা চিন্তাশীল বয়ঃপ্রাপ্ত পাঠকের জন্য লেখা, তাই এই পডকাস্টে আপনাদের কাছে নিয়ে আসবো । আজকের পাঠ সেইরকমই একটি গল্প ।
এই গল্পগুলির ঐতিহাসিক গুরুত্বও আছে । নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯১৮ সালে । ছাত্রজীবন থেকেই কবিতা লেখা আরম্ভ, তারপর গল্প-উপন্যাস - প্রথম পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস "তিমির-তীর্থ" প্রকাশ পায় ১৯৪৬ সালে । কাজেই সশস্ত্র বিপ্লব, অহিংস অসহযোগ আন্দোলন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, এইসবেরই জীবন্ত ইতিহাস তাঁর জীবন - এবং তাঁর সাহিত্যে তারই সুস্পষ্ট প্রতিফলন । বিদগ্ধ মহলে তাঁর প্রথম দিকের উপন্যাস "উপনিবেশ", এবং পরের দিকের উপন্যাস "শিলালিপি", বোধহয় সবথেকে বেশী প্রশংসা পেয়েছে । বিপ্লব তাঁর জীবনে শুধু কলমের ডগাতেই আবদ্ধ ছিলো না মনে হয় - ১৯৩৫ সালে ইংরেজ সরকার তাঁকে বিপ্লবের সঙ্গে যুক্ত থাকার সন্দেহে জেলে অন্তরীণ করে । পরবর্তী জীবনে সিটি কলেজে এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করার মাধ্যমেও, সেই সময়ের অনেক কবি-সাহিত্যিকের মতোই, তিনি নিজের রাজনৈতিক সমাজসচেতনতা, বৈপ্লবিক মনোভাব, রেখে গেছেন তাঁর উত্তরসূরীদের জন্য - সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, সকলেই নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ছাত্র ছিলেন । এই মানুষকে শুধু টেনিদার স্রষ্টা হিসেবে মনে রাখা অনুচিত - হোক না সে সৃষ্টি যতই কালজয়ী ।
একটা মজার কথা বলতে ইচ্ছা করছে, যেহেতু এই পডকাস্টে সাহিত্যিক নরেন্দ্রনাথ মিত্রের কয়েকটি গল্প এর আগে পড়েছি । একটা সময়ে উত্তর কলকাতার এক মেসবাড়িতে একই ঘরে আরো তিনজন বাসিন্দার সঙ্গে থাকতেন দুই তরুণ সংগ্রামী সাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, আর নরেন্দ্রনাথ মিত্র । নরেন্দ্রনাথের পুত্র অভিজিতের জবানীতে পাই, নরেন্দ্রনাথ নাকি বাবু হয়ে বসে লিখতেন, আর নারায়ণ লিখতেন উপুড় হয়ে শুয়ে । নারায়ণ তাঁর প্রথম দিকের উপন্যাস "তিমির-তীর্থ" উৎসর্গ করেন এই বন্ধুকেই - "কথাশিল্পী নরেন্দ্রনাথ মিত্র সুহৃত্তমেষু" - এই লিপি লিখে ।
আজ যে গল্পটি পাঠ করবো, সেটির নাম "ইতিহাস" । ইতিহাস-সচেতনতা আর সমাজ-সচেতনতা অভিন্ন - সমাজের অতীতকে না জেনে তার বর্তমানের দোষগুণ বা উন্নতির উপায় বোঝা মনে হয় অসম্ভব । শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক উপন্যাস পাঠ করার সময়ে দেখেছি, শরদিন্দু নিজে বলেছেন, "বাঙ্গালী যতদিন না নিজের বংশগরিমার কথা জানিতে পারিবে ততদিন তাহার চরিত্র গঠিত হইবে না; ততদিন তাহার কোনো আশা নাই । যে জাতির ইতিহাস নাই, তাহার ভবিষ্যৎ নাই ।" নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের সাহিত্যসৃষ্টি আরম্ভ স্বাধীনতা প্রাককালে, বিপ্লব ও দাঙ্গার সেই রক্তঝরানো দিনগুলিতে; তাই তাঁর সাহিত্যে সেই ইতিহাস-সচেতনতা আর সমাজ-সচেতনতার পূর্ণরূপে বিদ্যমান । এই গল্পেও তার পরিচয় আমরা পাবো । আরম্ভ করছি আজকের পাঠ, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্প, "ইতিহাস" ।