শ্রোতাবন্ধুরা, "গল্প-কথার আসর"-এর আজকের বৈঠকে যোগদান করার জন্য অজস্র ধন্যবাদ । আমি রুদ্র দত্ত ।
আজ ইংরেজী ২০২১ সালের ৯ই মে, বাংলা পঁচিশে বৈশাখ, আমাদের সবার অতি পরিচিত, অতি প্রিয় দিন । অতিমারীর বিপন্নতার মধ্যেও আমরা যে কয়েকটি আদি, শ্বাশ্বত সত্যের কথা মনে রেখে আমাদের ক্লান্ত, ক্ষতবিক্ষত দেহমনকে বিশ্রাম দিতে পারি, তার অনুপম পথপ্রদর্শক যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তাঁর জন্মদিন । এই দিনে স্বভাবতই অনেক কথা হৃদয়ে আসে; আমরা অনেকেই তা বলবো, শুনবো । গল্পকথার আসরও তার ব্যতিক্রম হতে পারে না । তবে আমাদের আসর তো গল্পকথার, আর রবীন্দ্রনাথের সম্বন্ধে নতুন কিছু কথা আপনাদের শোনাতে পারবো, তা ভাবার ঔদ্ধত্য আমাদের নেই - তাই আমরা পঁচিশে বৈশাখের প্রণাম রবীন্দ্রনাথের গল্পপাঠ করেই করবো । এই কবি-জয়ন্তীর সপ্তাহান্তে আমি, রাজীব, এবং মহাশ্বেতা, তিনজন রবীন্দ্রনাথ বিরচিত তিনটি গল্প পরপর এপিসোডে পাঠ করবো । রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনের আশীর্বাদের পূর্ণ বিশ্বাসে, তাঁর রচনায় এই আমাদের আসরের প্রথম পদক্ষেপ ।
শেষ পদক্ষেপ নয় অবশ্য; রবীন্দ্রনাথের গল্প ভবিষ্যতে আস্তে আস্তে আরো অনেক পড়ার ইচ্ছা রইল । তাঁকে আমরা প্রধানতঃ কবি ও গীতিকার হিসেবেই সবচেয়ে বেশী পেয়েছি; তাঁর গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য, এমনকি কাব্যনাট্যও আমাদের খুবই পরিচিত । কিন্তু তাঁর গল্প-উপন্যাসের সঙ্গে আমাদের অনেকেরই পরিচয় প্রধানতঃ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে, বা কখনো কখনো নাট্যায়নের মাধ্যমে । সেইসব চলচ্চিত্র আর নাট্যায়নের অনেকগুলিরই মান খুব উঁচু হলেও, মাঝে মাঝে মনে হয় যে রবীন্দ্রনাথের নিজের লিখিত ভাষা পড়লে যেন আরো একটু কিছু উপরি পাওয়া যায় । এক-একটা গল্পে মনে হয়, যেন তাঁর গান-কবিতার থেকেও বেশী করে, মানুষ রবীন্দ্রনাথ আমাদের কাছে ধরা দিয়েছেন । কোন চরিত্রের কোন ব্যথায় তিনি নিজে ব্যথিত হয়েছেন, কার পুলকে তিনি আনন্দিত হয়েছেন; সমাজের কোন অনুচিত বিধানে তাঁর নিজের শুধু ঘৃণা হয়েছে তাই নয়, তিনি তা পাঠকের সামনে নির্মম ভাবে তুলে ধরেছেন - হয়তো এই বিশ্বাসে যে আমাদেরও চোখ খুলবে; বিশ্বনিয়তির কোন অমোঘ বিচারে তিনি নিজে একটু ক্ষুণ্ণ, কোনটায় তুষ্ট; তা যেন এইসব গল্পের মধ্যে দিয়ে সবথেকে আমাদের কাছে প্রকট হয়ে ওঠে । কিন্তু আশ্চর্য কথা এই যে, গল্পগুলি কিন্তু তার ফলে প্রবন্ধ, উপদেশ, বা তিরষ্কার কি প্রশস্তি হয়ে ওঠেনি; নিপুণ হাতে রবীন্দ্রনাথ সার্থক গল্পই সৃষ্টি করেছেন, যাতে রক্তমাংসের বাস্তব চরিত্ররা সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় আচরণ করেছে, আর তাদের আদানপ্রদানে ফুটে উঠেছে মানুষের, সমাজের, পৃথিবীর নিখুঁত ছবি ।
কথা বলবো না বলেও অনেক ভণিতা হয়ে গেলো । এবারে গল্পপাঠ আরম্ভ করি । কবি-জয়ন্তীতে যে তিনটি গল্প আমরা এই আসরে পড়ছি, তা তিনটি বিভিন্ন স্বাদের । আমি আজকে পড়বো "অতিথি" - বর্ণনাধর্মী ও কাব্যধর্মী একটি গল্প । তারপর বন্ধুবর রাজীব পড়বে "ডিটেকটিভ" - কিছুটা নাট্যধর্মী, কিন্তু গল্প শেষ হলে বোঝা যায় যে নাট্যের ছলে রবীন্দ্রনাথ সমাজ ও মানুষের সদা-সন্দিগ্ধতাকে একটু ব্যঙ্গ করে নিলেন । শেষে মহাশ্বেতা পড়বে "মহামায়া" - এই গল্পের কথনশৈলী নৈর্ব্যক্তিক, চরিত্রদের সুখদুঃখের সংলাপ থেকে লেখক যেন নিজের বর্ণনাকে একটু চেষ্টা করেই দূরে সরিয়ে রাখছেন, কোনো মূল্যবিচারে যাচ্ছেন না; পরম বিশ্বাসে তাদের পাঠকের হাতেই তুলে দিয়ে বলছেন - এবার তোমরাই বিচার করো । সাহিত্যিক হিসেবে এই ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের গল্প তৈরী করায় রবীন্দ্রনাথের পারদর্শীতাও লক্ষণীয়, এবং আজও, তাঁর প্রয়াণের প্রায় একশো বছর পরে, শিক্ষণীয় ।
তাহলে আরম্ভ করছি আজকের পাঠ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প, "অতিথি" ।