কেন মন্থন
রোজকার অভ্যেস বদলে যাচ্ছে। খবরের কাগজ, পত্র-পত্রিকার তুলনায় দূরদর্শনের এখন রমরমা। কেবল্-টিভির দৌলতে বিশ্বের নানান কোনায় কি ঘটছে জানতে হলে ইচ্ছে মতো বোতাম টিপলেই হলো। পৃথিবীটা যোগাযোগের বিচারে খুব ছোট হয়ে গেছে। দুনিয়া থেকে আলাদা হয়ে নিজের মতামত, মূল্যবোধ নিয়ে অনড়ভাবে চলার দিন আর নেই। প্রতিটি দেশের মানুষের কাছে অন্য দেশের মানুষের জীবনচর্চা মূল্যবোধ জীবন্তভাবে হাজির হচ্ছে। ভাল-মন্দর মাপকাঠি ক্রমাগত বদলে যাচ্ছে। শহুরের জীবনের প্রায় প্রতি ক্ষেত্রে এই টানা-হ্যাঁচড়ার ছাপ পড়ছে, গ্রামও এর বাইরে দাঁড়িয়ে নেই। পড়াশুনা, জামা-কাপড়, খাওয়া-দাওয়া, ঘর-বাড়ী; কিম্বা খেলা-ধূলো, গান-বাজনা, নাটক-সিনেমা; কিম্বা প্রতিযোগিতা - পরীক্ষা, চাকরী-ব্যবসা; কিম্বা পরিবেশ-প্রকৃতিতে মানুষের বিচরণ সর্বত্র পরিবর্তনের ঢেউ ক্রমাগত বাড়ছে। এমনকি জীবনবোধ, ভালবাসা, স্নেহ-মমতা, কিম্বা ধর্মীয় বিশ্বাস ও সাম্প্রদায়িক আচরণ, চিন্তাভাবনার সমস্ত স্তরেও নড়াচড়া ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। বিভিন্ন ধরণের এই আলোড়ন কিন্তু সর্বত্র একভাবে একই অভিমুখে চলছে এমনটা এখনও বলা যাচ্ছে না। তবে কতকগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য অবশ্যই চোখে পড়েছেঃ সমস্ত ক্ষেত্রেই বর্তমানের প্রতি একধরণের অসহিষ্ণুতা, ক্ষোভ, অবজ্ঞা বাড়ছে। অন্য কিছু, নতুন কিছুর প্রতি আকর্ষণ বাড়ছে। চলে আসা বিভিন্ন ধরণের আদর্শবাদগুলি, কি তত্ত্ব, কি প্রয়োগের বিচারে, আজকের দুনিয়ায় প্রশ্নের উর্দ্ধে নয়। সমস্ত স্তরের মানুষের কাছে বৈষয়িক মূল্য দিয়ে সমস্ত কিছু বুঝে নেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। নয়া প্রজন্মের মধ্যে আবেগের উপাদান যেমন কমছে, সেইসঙ্গে কমছে মানবিক মূল্যবোধও। ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি প্রচলিত আদর্শ/ মতবাদের দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্যের বয়ানগুলি সাধারণ মানুষের কাছে অস্পষ্ট। সাধারণ মানুষ নিজ নিজ গন্ডীতে যে কোনো রকম অর্থনৈতিক উন্নতির কার্যক্রমের প্রতি বেপরোয়াভাবে আগ্রহী। সমষ্টিগত, ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার পরিবর্তে এককভাবে চলা, বিচ্ছিন্নভাবে থাকার ঝোঁক বাড়ছে। মানুষের বিভিন্নভাবে বজায় থাকা সম্প্রদায়গত পরিচয়গুলি নানা নতুনতর চেহারায় সমাজের বুকে ভেসে উঠেছে। তৈরী হচ্ছে নতুন আকারের দ্বন্দ্ব, নতুন সমস্যা। সমস্ত ধরণের চিরাচরিত আদর্শভিত্তিক সংগঠনের সংকট অত্যন্ত তীব্র হয়ে উঠেছে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের স্বীকৃতি প্রসঙ্গটি নয়া প্রজন্মের কাছে রোজকার জীবনযাপনে অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য। ছোট-বড় বাম-ডান সমস্ত ধারার রাজনৈতিক সংগঠনের প্রতি, নেতৃত্বের প্রতি মানুষের মৌলিক অনাস্থা ক্রমবর্ধমান। প্রায় প্রতিটি দেশে বিশেষত, আমাদের দেশে রাজনীতি সম্পর্ক অত্যন্ত জঘন্য ধরণের ধারণা দাঁড়িয়ে গেছে, যাকে আদৌ অযৌক্তিক বলা চলে না। প্রযুক্তিগত উন্নতির দ্রুততার থেকে ঢের পিছনে পড়ে যাচ্ছে বৈজ্ঞানিক চেতনার বিকাশ। সেইসঙ্গে এটাও ঘটনা নানাধরণের নতুন বিষয়ের চর্চা বাড়ছে। ভালভাবে বাঁচা আর ভাল হয়ে বাঁচা এই দুইকে মেলাতে কালঘাম ছুটে যাছে যে কোনো সাধারণ মানুষের। স্বপ্নের পৃথিবী রৌদ্রের জীবনকে মেলানোর এই মন্থন চলছে। এই মন্থন আগামীতে আরো বিস্তৃতি পাবে। দ্রুততর ছুটে চলা শহর থেকে শুরু করে ধীরগতি গ্রাম পর্যন্ত, যেখানে যতই আপাত-তুচ্ছতা নিয়ে বা ছোট গন্ডীতে এই চলুক না কেন - আমরা প্রত্যেকেই একই সমাজ-সমুদ্রে মন্থন করছি। কোনো কিছুই আর কেবল মেনে নেওয়ার নয়, নতুন যুগের কষ্টিপাথরে সবকিছু আরো ভালভাবে যাচাই করে গ্রহণ করতে হবে। ভুল করবো, ঠকবো, অন্যের কাছে শিখবো। মানবাত্মার সার্বিক বিকাশ পর্যন্ত এই মন্থন চলবে। মন্থনে বিষ উঠবে, অমৃতও উঠবে। সেই ভয়ে মন্থন বন্ধ করা চলে না। মানুষের যা কিছু প্রয়োজন নিতে হবে। যা কিছু ধ্বংসাত্মক, বর্জনীয় তার বিপরীতে দাঁড়াতে হবে নতুন সমাজ-চেতনায় উদ্বুদ্ধ শ্রমজীবি শ্রেণীকে - সৃষ্টির প্রতি অবিচল এটাই হোল প্রকৃত সমাজ; যাকে বর্জ্য পদার্থকেও এমনভাবে কাজে লাগাতে হবে যা ঘুরিয়ে মানুষের প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। মন্থনের মাপকাঠি "বৈজ্ঞানিক-যুক্তি ও মানবিক মূল্যবোধ"। মন্থন যে কোনো সামাজিক-গুরুত্বের প্রসঙ্গে মতামত বিনিময়ের একটা মাধ্যম। মন্থনে ছোট-ছোট সংবাদের নিরবিচ্ছিন্ন আলোড়ন। মন্থন সর্বদা অন্যের চিন্তাকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে সেই চিন্তার সমালোচনার সাদর অভ্যর্থনা। |
|
দ্বি মা সি ক বাং লা লি ট ল ম্যা গা জি ন
মন্থন সাময়িকী
দ্বি মা সি ক বাং লা লি ট ল ম্যা গা জি ন