মধ্যমগ্রাম ঠাকুরবাড়ীর শারদ দুর্গোত্সব - ঠাকুর বাড়ীর দুর্গাপূজা : রত্নেশ্বর ঠাকূর
মধ্যমগ্রাম বিধানপল্লী ঠাকুর বাড়ীর দুর্গাপূজোর শুরু সেই ১৯০৫ সালে (তদানিন্তন ব্রিটিশ ভারত-এর বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি অন্তর্গত) বর্তমান বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ মহকুমার (কোটালীপাড়া উপজেলার)১ ব্রাহ্মণ-প্রধান হরিণাহাটি গ্রামের ৺পার্বতীচরণ ঠাকুর২ মশাইয়ের পরিবারে। এই দীর্ঘ সময় সীমার মধ্যে কতো না বিচিত্র ঘটনার সমাবেশ ঘটেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু ও শেষ হয়েছে। যুদ্ধের হাত ধরে এসেছে সর্বনাশা দুর্ভিক্ষ ও অসংখ্য নিরন্ন মানুষের শোচনীয় মৃত্যু। দেশ বিভাগের মধ্য দিয়ে এসেছে বহু প্রতিক্ষীত স্বাধীনতা এবং তার সঙ্গে এসেছে ওপার বাংলা থেকে এপার বাংলার অজস্র ছিন্নমুল সর্বহারা মানুষের স্রোত। সময়ের প্রবাহে আমাদের পরিবারেরও সাংগঠনিক পরিবর্তন হয়েছে, পরিবর্তিত হয়েছে পূজার স্থানও - হরিণাহাটি (১৯০৫ সাল) থেকে কলকাতা এবং সেখান থেকে মধ্যমগ্রামে (১৯৫০ সাল)। পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে পূজার নানা অঙ্গে। তবু আমাদের পূজা এগিয়ে চলেছে সময়ের সঙ্গে পা মিলিয়ে ….
স্মারকগ্রন্থটির দেখতে ক্লিক করুন
স্মারকগ্রন্থটি ডাউনলোড করতে ক্লিক করুন
ঠাকুরবাড়ীর দুর্গোত্সব সমিতি (কমিউনিটি)
Thakurbarir Durgotsav Samity (Blog)
Thakurbarir Durgotsav Samity (Page)
ঠাকুরবাড়ী দুর্গোত্সব সমিতি (প্রোফাইল)
দক্ষিণ বঙ্কিম পল্লী ( বিধানপল্লী), মধ্যমগ্রাম,
উত্তর চব্বিশ পরগনা, কোলকাতা - ৭০০১২৯
২০১৮ ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপূজার ১১৪তম বর্ষের আজ দশমী, সন্ধ্যেবেলায় প্রতিমা বিসর্জন।
যেয়োনা, রজনি, আজি লয়ে তারাদলে!
গেলে তুমি দয়াময়ি, এ পরাণ যাবে ! –
উদিলে নির্দয় রবি উদয় – অচলে
নয়নের মণি মোর নয়ন হারাবে!
বার মাস তিতি , সতি , নিত্য অশ্রুজলে,
পেয়েছি উমায় আমি! কি সান্ত্বনা-ভাবে –
তিনটি দিনেতে, কহ , লো তারা-কুন্তলে,
এ দীর্ঘ বিরহ-জ্বালা এ মন জুড়াবে?
তিন দিন স্বর্ণদীপ জ্বলিতেছে ঘরে
দূর করি অন্ধকার; শুনিতেছি বাণী –
মিষ্টতম এ সৃষ্টিতে এ কর্ণ-কুহরে!
দ্বিগুন আঁধার ঘর হবে, আমি জানি,
নিবাও এ দীপ যদি!” – কহিলা কাতরে
নবমীর নিশা-শেষে গিরীশের রাণী।
কলকাতার বনেদি বাড়ির দুর্গাপুজো
শোভাবাজার রাজবাড়ির দুর্গাপুজো (দেব পরিবার)
এই শহরের ঐতিহ্যশালী পারিবারিক পুজোগুলির অধিকাংশই উত্তর কলকাতায়। সেখানকার পুজোগুলির মধ্যে প্রথমে আসা যাক উত্তর কলকাতার অন্যতম শোভাবাজার রাজবাড়ির কথায়। কলকাতায় এই পরিবারের স্থপতি হলেন, রাজা নবকৃষ্ণ দেব। তাঁর পিতা রামচরণ ব্যবহর্তা ছিলেন নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর এক জন নিমক-কালেক্টর। পরে হন কটকের দেওয়ান। কিন্তু তিনি বর্গিদের হাতে মারা যাওয়ার পরে তাঁর বিধবা স্ত্রী তিন ছেলে ও পাঁচ মেয়েকে নিয়ে কলকাতার কাছে গোবিন্দপুর (এখনকার ফোর্ট উইলিয়ম) অঞ্চলে পালিয়ে আসেন। ওই রামচরণের কনিষ্ঠ পুত্র নবকৃষ্ণ মায়ের উৎসাহে ইংরেজি, ফারসি ও আরবি শেখেন এবং তার ফলে প্রথমে ওয়ারেন হেস্টিংসের ফারসি-শিক্ষক নিযুক্ত হলেন। সেখান থেকে নিজের যোগ্যতা ও বুদ্ধি-বলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মুনশির পদ লাভ করলেন। লর্ড ক্লাইভ তখন কোম্পানির প্রভাবশালী ব্যক্তি। নবকৃষ্ণ ক্রমে তাঁর কাছের লোক হয়ে উঠলেন। খুব স্বাভাবিক ভাবেই সিরাজদ্দৌল্লার বিরুদ্ধে ইংরেজদের বিরোধে রাজা রাজবল্লভ, নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়, মীরজাফর, জগত শেঠদের সঙ্গে নবকৃষ্ণও কোম্পানির সঙ্গে হাত মেলালেন।
পলাশির যুদ্ধে ইংরেজদের জয়লাভের পর সিরাজের বিশাল টাকার সম্পত্তির একটি ভাগও তিনি লাভ করেন। উত্তর কলকাতার শোভাবাজার অঞ্চলে তৎকালীন বড় ব্যবসায়ী শোভারাম বসাকের কাছ থেকে একটি প্রাসাদোপম বাড়ি নবকৃষ্ণ কিনেছিলেন আগেই। যুদ্ধের পর, ১৭৫৭-এ ৩৫ রাজা নবকৃষ্ণ স্ট্রিটের ১৩ বিঘে ৬ কাঠা পাঁচ ছটাক জমির উপর তৈরি সেই প্রাসাদের সঙ্গে নবকৃষ্ণ তৈরি করালেন দেওয়ানখানা, নাচঘর, লাইব্রেরি, নহবতখানা ইত্যাদি। আর একটি সুবিশাল সাত-খিলানের ঠাকুর পুজোর দালান। যুদ্ধ-জয়ের স্মারক হিসাবে তিনি ওই বছরেই ওই দালানে সূচনা করেন দুর্গোৎসবের।
কলকাতার মানুষ সেই প্রথম দেখল, দুর্গাপুজোর মোচ্ছব কাকে বলে। পনেরো দিন ধরে চলেছিল সে উৎসব। এক দিকে সনাতন রীতি-পদ্ধতি মেনে পুজো, চণ্ডীপাঠ, বলি ব্রাহ্মণভোজন, গরিবদের জন্য দানছত্র! আবার তার পাশাপাশি নাচ-গান-আমোদ-আহ্লাদের ফোয়ারা। লখনউ, দিল্লি, মুর্শিদাবাদ-সহ অন্যান্য জায়গা থেকে আনা হল বিখ্যাত সব বাইজিদের। সে এক এলাহি ব্যপার। রাজা নবকৃষ্ণই প্রথম ব্যক্তি, যিনি ধর্মীয় অনুষ্ঠান দুর্গোৎসবে সাহেবদের নিমন্ত্রণ করে নিয়ে আসেন। পুজোকে কেন্দ্র করে বাইজি-নাচ আমোদ-আহ্লাদ, দেখিয়ে নিজের উন্নতির পথ আরও সুগম করে তোলেন!
লর্ড ক্লাইভ ছাড়াও সে যুগের বহু গণ্যমান্য সায়েবসুবোরা এ বাড়ির পুজোয় নাচ দেখতে, খানাপিনা করতে এসেছেন একাধিকবার! নবকৃষ্ণর দুর্গাপুজোর বিপুল ঘটা দেখে সাহেবরা পর্যন্ত বিস্মিত হতেন, নিজেদের মধ্যে তারা ঠাট্টা করে বলতেন— ‘পলাশির যুদ্ধের স্মৃতি উৎসব!’ প্রতিষ্ঠার ইতিহাস যতই কলঙ্কজনক হোক না কেন, নবকৃষ্ণের আড়াইশো বছর পেরিয়ে যাওয়া সেই প্রাচীন ঠাকুরদালান আর নাচঘর ভগ্নপ্রায় হয়ে এখনও দাঁড়িয়ে আছে বাঙালির অন্যতম শ্রেষ্ঠ উৎসবের সাক্ষী হয়ে।
নবকৃষ্ণের সাত জন স্ত্রীর কোনো সন্তানাদি না হওয়ায় ১৭৭০-এ তাঁর বড় দাদা রামমুন্দরের পুত্র গোপীমোহনকে দত্তক নেন। কিন্তু ১৭৮২তে তাঁর সপ্তম স্ত্রীর গর্ভে রাজকৃষ্ণ জন্মানোর পর, দেববাড়ির সম্পত্তি দু-ভাগে হল। পুরনো বাড়ির দক্ষিণ দিকে আরও একটি বিশাল প্রাসাদ তৈরি হল। ১৭৯২ থেকে সেখানেও আরম্ভ হল দুর্গাপুজো এবং আদি বাড়ির রীতি-পদ্ধতি মেনেই।
এখানে দেবী দুর্গা বৈষ্ণবী হিসেবে পূজিতা হন। অব্রাহ্মণ পরিবার বলে পুজোয় অন্নভোগের আয়োজন করা হয় না। তার পরিবর্তে গোটা ফল, গোটা আনাজ, শুকনো চাল, কচুরি, খাজা, গজা, মতিচুর-সহ নানা ধরনের মিষ্টি দেবতাকে ভোগ দেওয়া হয়। বোধনের দিনই চণ্ডীর প্রতিষ্ঠা হয়। বোধন থেকে ষষ্ঠী অবধি প্রতিদিন ব্রাহ্মণেরা চণ্ডীপাঠ করেন। আগে ভারতের চার প্রান্ত থেকে ব্রাহ্মণরা আসতেন চণ্ডীপাঠ করতে, এখনস্থানীয়রাই করেন। নবমী অবধি প্রতিদিনই চণ্ডীর আরতি হয়। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী এই তিন দিনে সাত দফায় বলি দেওয়া হয়। এক সময় এ বাড়ির পুজোতে পশুবলি দেওয়া হত। পরে এক সময়ে তা বন্ধহয়ে যায়। এখন প্রথা হিসাবে চালকুমড়ো, আখ, মাগুরমাছ এই সব বলি দেওয়া হয় (তবে নবকৃষ্ণের ছোট ছেলে রাজকৃষ্ণর পরিবারের পুজোতে অবশ্য এখনও পশুবলি বন্ধ হয়নি)।
দশমীর দিন প্রতিমা নিরঞ্জন হয় নিমতলা ঘাটে। আগে বাড়ি থেকে প্রতিমা নিয়ে বেরোনোর সময় একটি এবং প্রতিমা জলে পড়লে আর একটি নীলকণ্ঠ পাখি ওড়ানো হত। ইদানিংসরকারি আদেশে সেই পাখি ওড়ানো বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
ঠাকুরবাড়ীর দুর্গাপূজা 2017 The First Look
শোভাবাজার রাজবাড়ির দুর্গাপুজো